ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যেখানে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়কেও গুরুত্ব দিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এমনকি মুসলিমের শারীরিক পবিত্রতা রক্ষার মতো ব্যক্তিগত আচরণও শরিয়তের আওতায় আসে। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো— ইস্তিঞ্জা বা মলমূত্র ত্যাগের পর নিজেকে পবিত্র করা। আমাদের সমাজে অনেক সময় একটি প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে— 👉 “শুধু পানি দিয়ে ইস্তিঞ্জা করলে নামাজ হবে কি?” 👉 “ঢিলা কুলুখ ব্যবহার না করলে কি নামাজ হবে না?”
ঢিলা কুলুখ ও ইস্তিঞ্জা । কী ও কেন?
‘ইস্তিঞ্জা’ একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ অপবিত্রতা দূর করা। শরিয়তের পরিভাষায়, ইস্তিঞ্জা হলো—মলমূত্র ত্যাগের পর নাপাকী দূর করার জন্য নির্গমনস্থল ধৌত করা, পানি বা অন্য বৈধ উপায়ে। আর ঢিলা কুলুখ বলতে বোঝায়—পাথর, মাটি, টিস্যু বা অনুরূপ কোনো কঠিন ও শুষ্ক জিনিস দিয়ে মল বা মূত্রস্থল পরিস্কার করা, যা নবীজি ﷺ-র যুগে একটি স্বাভাবিক ও স্বীকৃত পদ্ধতি ছিল।
🔹 কেন জরুরি?
ইসলামে নামাজসহ অধিকাংশ ইবাদতের জন্য শরীর, কাপড় ও নামাজের স্থান পবিত্র হওয়া আবশ্যক। যদি মল-মূত্রের সামান্য ছিটেও কাপড়ে বা শরীরে লেগে থাকে, তবে সেই অবস্থায় নামাজ সহিহ হবে না।
নবী ﷺ বলেছেন:
“তোমরা মূত্র থেকে বেঁচে থাকো, কারণ অধিকাংশ কবরের আযাব হয় মূত্রের কারণে।” (📚 সুনান দারাকুতনী, সহীহ ইবনে মাজাহ: ৩৪৮)
এ থেকে বোঝা যায়, মল-মূত্র থেকে সঠিকভাবে পবিত্র না হওয়া শুধু ইবাদতের বাধা নয়, বরং আখিরাতের কঠিন শাস্তিরও কারণ।
ঢিলা ব্যবহারের শরয়ি প্রমাণ
হ্যা, ঢিলা (যাকে আরবিতে “الأحجار” বা “الجمار” বলা হয়) ব্যবহার করে ইস্তিঞ্জা করার বিধান স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারা। বিশেষ করে নবী করীম ﷺ নিজেও কখনো শুধু ঢিলা, কখনো শুধু পানি এবং কখনো ঢিলা ও পানি একত্রে ব্যবহার করেছেন। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ তুলে ধরা হলো:
১. সহীহ হাদীসে ঢিলা ব্যবহারের অনুমোদন
রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন:
«إذا ذهب أحدكم إلى الغائط فليذهب معه بثلاثة أحجار يستطيب بهن، فإنها تجزئ عنه»
“তোমাদের কেউ যখন পায়খানায় যাবে, তখন যেন তিনটি পাথর সাথে নেয়, এবং তা দিয়ে নিজেকে পবিত্র করে, কেননা তা যথেষ্ট।” ( আবু দাউদ )
২. শুধু ঢিলা ব্যবহার বৈধ:
এক সাহাবী জাবের ইবন আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত—
«نهى النبي ﷺ أن يتمسح بعظم أو ببعر»
“নবী ﷺ হাড় বা গোবর দিয়ে ইস্তিঞ্জা করতে নিষেধ করেছেন।” ( সহিহ মুসলিম)
এর অর্থ, হাড় ও গোবর ছাড়া অন্যান্য জিনিস—যেমন পাথর, শুকনো মাটি, টিস্যু ইত্যাদি—ব্যবহার বৈধ, যদি তাতে স্থান পবিত্র হয়ে যায়।
৩. কুরআনে পরোক্ষ ইঙ্গিত: আল্লাহ তায়ালা মদীনাবাসীদের প্রশংসা করে বলেন:
فِيهِ رِجَالٌ يُحِبُّونَ أَن يَتَطَهَّرُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِينَ
“এখানে এমন কিছু মানুষ রয়েছে যারা পবিত্র হতে ভালোবাসে, আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।” ( সুরা তাওবা : ১০৮)
হাদীসে এসেছে, তারা ঢিলার পর পানি ব্যবহার করতেন (সুনানে তিরমিযী)। এতে ঢিলা ব্যবহারের গুরুত্ব ও বৈধতা উভয়ই প্রমাণিত হয়।
৪. সাহাবিদের আমল: সাহাবাগণ শুধু ঢিলা দিয়েই ইস্তিঞ্জা করতেন, অনেক সময় পানি ছাড়াও, বিশেষ করে যখন পানি সহজলভ্য ছিল না। তারা এতে কোনো ত্রুটি মনে করতেন না।
শুধু পানি দিয়ে ইস্তিঞ্জা । গ্রহণযোগ্যতা ও শর্ত
ইসলামী শরিয়তে পবিত্রতা অর্জনের মূল উদ্দেশ্য হলো—নাপাক বস্তু দূর করা এবং নামাজের উপযুক্ত পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা। এই পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে ঢিলা (কুলুখ) এবং পানি—উভয়ই বৈধ ও অনুমোদিত উপায়। তবে কেবল পানি দিয়েও ইস্তিঞ্জা করা সম্পূর্ণ বৈধ এবং অনেক ফিকহবিদের মতে, এটি অধিক উত্তম।
শুধু পানি দিয়ে ইস্তিঞ্জা কি গ্রহণযোগ্য?
হ্যাঁ, একমাত্র পানি দিয়ে ইস্তিঞ্জা সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য, যদি:
- নাপাক বস্তু (নাজাসাত) সম্পূর্ণরূপে ধুয়ে ফেলা হয়;
- মল-মূত্রের কোন চিহ্ন বা গন্ধ না থাকে;
- পানি ব্যবহার যথাযথভাবে হয় (ঢালাও না হয়ে, প্রয়োজনমাফিক)।
হাদীস দ্বারা প্রমাণ: রাসূলুল্লাহ ﷺ শুধুমাত্র পানি ব্যবহার করেছেন এবং স্ত্রীদেরকেও তাতে উৎসাহ দিয়েছেন। হাদীসে এসেছে:
عَنْ عَائِشَةَ رضي الله عنها قَالَتْ: مُرْنَ أَزْوَاجَكُنَّ أَنْ يَسْتَطِيبُوا بِالْمَاءِ، فَإِنِّي أَسْتَحْيِيْهِنَّ، فَإِنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ كَانَ يَفْعَلُهُ
“আয়িশা (রা.) বলেন, তোমাদের স্বামীদের বলো যেন তারা পানি দিয়ে ইস্তিঞ্জা করে। আমি তাদের থেকে লজ্জা পাই, কিন্তু রাসূল ﷺ তা করতেন।”
ঢিলা কুলুখ ব্যবহার না করলে কি নামাজ হবে না?
হ্যা, ঢিলা কুলুখ ব্যবহার না করলেও নামাজ হবে। যদি কেউ কেবল পানি দিয়ে ভালোভাবে ইস্তিঞ্জা করে, এবং মল বা মূত্রের কোন প্রকার চিহ্ন, গন্ধ বা আর্দ্রতা শরীরে অবশিষ্ট না থাকে—তাহলে নামাজ সহিহ হবে, ইনশাআল্লাহ।
তাহলে ঢিলা বা কুলুখ কেন ব্যবহার করা হয়?
ঢিলা ব্যবহারের উদ্দেশ্য হলো—প্রথমে আকারে মলকে কমিয়ে আনা, যেন পানি ব্যবহারে তা সহজে ধুয়ে যায়। এটি বিশেষত তখন গুরুত্বপূর্ণ যখন মল ছড়িয়ে পড়ে বা পানি সীমিত থাকে। তবে শরিয়ত শুধু ঢিলাকে বাধ্যতামূলক করেনি; বরং পানি দিয়েই ইস্তিঞ্জা করলে তা যথেষ্ট হয়।
ঢিলা ছাড়া নামাজ । শুদ্ধতার প্রশ্ন
ইস্তিঞ্জার উদ্দেশ্য হলো—মল-মূত্রের প্রকৃত নাপাকি (নাজাসাত) দূর করে শরীর ও কাপড়কে পবিত্র রাখা। এটাই নামাজের শর্ত। তাই ঢিলা বা কুলুখ ব্যবহার নিজে কোনো ফরজ নয়, বরং ফরজ হলো—নাপাকি দূর করা। এখন যদি কেউ ঢিলা না ব্যবহার করে শুধু পানি দিয়ে ভালোভাবে মল বা মূত্রের চিহ্ন সম্পূর্ণ দূর করে দেয়—তাহলে তার ইস্তিঞ্জা সহিহ, এবং নামাজও সহিহ।
তবে সমস্যা হয় কোথায়?
প্রচলিত ভুল ধারণায় অনেকে কেবল পানি ঢেলে দিলেই মনে করেন ইস্তিঞ্জা হয়ে গেছে—কিন্তু প্রকৃত নাপাকি থেকে যায়। যেমন:
- পানি ঠিকভাবে ব্যবহার না করা
- মল বা মূত্রের আংশিক চিহ্ন থাকা
- কাপড়ে বা শরীরে গন্ধ বা আর্দ্রতা থেকে যাওয়া
এসব ক্ষেত্রে ইস্তিঞ্জা পরিপূর্ণ হয় না। তখন নামাজ সহিহ হবে না।
সুতরাং:
✅ ঢিলা না থাকলেও যদি পানি দিয়ে পরিষ্কারভাবে ইস্তিঞ্জা করা হয়—নামাজ শুদ্ধ।
❌ কিন্তু ঢিলা না ব্যবহার করে যদি পানি দিয়েও ভালোভাবে পরিষ্কার না হয়—তবে নামাজ শুদ্ধ হবে না।
সমাধান ও করণীয়
✅ সমাধান:
ইসলাম আমাদের জন্য একটি সহজ ও বাস্তবধর্ম। তাই নামাজের পূর্বশর্ত—পবিত্রতা অর্জন—তাতে মূল লক্ষ্য হলো নাপাকি দূরীকরণ, মাধ্যম নয়। অর্থাৎ, ঢিলা বা পানি—যেটাই ব্যবহার করি, তাতে যদি নাপাকি দূর হয়, তবে ইস্তিঞ্জা সহিহ এবং নামাজও সহিহ।
🔧 করণীয়:
১. যে মাধ্যমই ব্যবহার করুন, মূল লক্ষ্য যেন হয় পূর্ণ পরিষ্কার।
- কেবল পানি ব্যবহার করলে অবশ্যই মল বা মূত্রের কোনো চিহ্ন, গন্ধ বা আর্দ্রতা যেন না থাকে।
২. যতটা সম্ভব ঢিলা (টিস্যু, পাথর, মাটি ইত্যাদি) ও পানি উভয়ই ব্যবহার করুন।
- এটি সুন্নাহ এবং সর্বোত্তম পবিত্রতার পদ্ধতি।
- প্রথমে ঢিলা দিয়ে মুছে তারপর পানি ব্যবহার করলে নাপাকি সহজেই দূর হয়।
- ভ্রমণে বা জরুরি অবস্থায় কেবল ঢিলা দিয়েও ইস্তিঞ্জা করা বৈধ, যদি নাপাকি মুছে যায়।
- যদি কেবল পানি ব্যবহার করতে চান, তাহলে হাত দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিশ্চিত হোন যে, কোনো চিহ্ন বাকি নেই।
- কোনো সন্দেহ থাকলে—যে জায়গায় নাপাকি ছিল—তা ধুয়ে ফেলুন এবং কাপড় বা শরীরে লাগলে তাও ধুয়ে ফেলুন।
- নিজের ইস্তিঞ্জার অভ্যাস পর্যালোচনা করুন। প্রতিদিনের অভ্যাসে সামান্য পরিবর্তনে ইবাদত সহিহ ও পরিপূর্ণ হবে ইনশাআল্লাহ।
✅ সহিহ ইস্তিঞ্জার জন্য ৫টি ধাপ
নিজের হাতে নাপাকি লেগেছে কি না দেখে হাত ভালোভাবে সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলো
– পরিষ্কার হাত ছাড়া অজু ও নামাজ শুরু কোরো না।
ঢিলা বা টিস্যু দিয়ে মলমূত্রের মোটা অংশ মুছে ফেলো
– অন্তত তিনবার বা যতবার দরকার, যাতে দৃশ্যমান নাপাকি দূর হয়।
পানি ব্যবহার করে জায়গাটি ভালোভাবে ধুয়ে ফেলো
– যতক্ষণ না গন্ধ, রঙ, আর্দ্রতা দূর হয়, ততক্ষণ ধুতে থাকো।
বাম হাত দিয়ে ধৌত করো, ডান হাত ব্যবহার কোরো না
– নবী ﷺ বাম হাত দিয়ে ইস্তিঞ্জা করতেন, এটি সুন্নাহ।
পানি ব্যবহারের পর শুকনো কাপড় বা টিস্যু দিয়ে জায়গাটি মুছে ফেলো
– অতিরিক্ত পানি দূর করা সুন্নত ও স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো।