রাব্বানা ওয়া তাকাব্বাল দোয়া । আরবি । বাংলা উচ্চারণ । ফজিলত

পোস্টটি শেয়ার করুন

জীবনের প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি চাহিদা ও সংকটে মানুষ যখন অসহায় হয়ে পড়ে—তখন সে আল্লাহর দরবারে হাত তোলে। দোয়া তখন শুধু কথার পরিণাম নয়, বরং হৃদয়ের গভীর আর্তনাদ। এই দোয়ার মাধ্যমে মানুষ তার প্রভুর নিকট চায় সাহায্য, ক্ষমা, রহমত ও পথনির্দেশনা। কুরআনে বহু স্থানে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের দোয়া করতে উৎসাহ দিয়েছেন, আর দোয়া গ্রহণের ওয়াদা করেছেন। রাব্বানা ওয়া তাকাব্বাল দোয়া — এই সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর অর্থবহ দোয়াটি মূলত এক অনবদ্য নিবেদন।

এটি ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.) এর মুখনিঃসৃত সেই দোয়া, যা তাঁরা কা’বা শরীফ নির্মাণের পর আল্লাহর দরবারে পেশ করেছিলেন। এতে রয়েছে এক বিশ্বস্ত বান্দার নম্র আহ্বান, এক দরিদ্র দাসের হৃদয় নিংড়ানো চাওয়া— হে আমাদের রব! আমাদের দোয়া কবুল করুন।

এই ব্লগপোস্টে আমরা অনুধাবন করার চেষ্টা করবো এই দোয়ার প্রকৃত অর্থ, ব্যাকরণগত বিশ্লেষণ, কুরআনিক প্রেক্ষাপট, এবং এটি আমাদের জীবনে কীভাবে প্রাসঙ্গিক ও কার্যকরী হতে পারে।

✦ রাব্বানা ওয়া তাকাব্বাল দোয়া — একটি অনবদ্য নিবেদন

◉ আরবি:

رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاءِ

◉ বাংলা উচ্চারণ:

রাব্বানা ওয়া তাকাব্বাল দোয়া।

◉ বাংলা অনুবাদ:

হে আমাদের রব, আমাদের দোয়া কবুল করুন।

✦ কুরআনিক প্রেক্ষাপট

এই দোয়াটি এসেছে সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১২৭-১২৮ এর মধ্যে। এটি হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.) এর দোয়া, যখন তাঁরা কা‘বা শরীফ নির্মাণ করছিলেন।

وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَٰهِيمُ ٱلْقَوَاعِدَ مِنَ ٱلْبَيْتِ وَإِسْمَٰعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّآ ۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلسَّمِيعُ ٱلْعَلِيمُ

“আর যখন ইব্রাহিম ও ইসমাঈল কা’বার ভিত্তি উত্তোলন করছিলেন, তখন বলেছিলেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পক্ষ থেকে গ্রহণ করে নাও। নিশ্চয়ই তুমি শ্রবণকারী ও মহাজ্ঞানী।’”
📖 (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১২৭)

এর ঠিক পরেই তাঁরা আরও বলেন:

رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاءِ

📖 (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১২৮-এর অংশবিশেষ)

✦ শব্দভিত্তিক বিশ্লেষণ

  • رَبَّنَا (রাব্বানাঃ) “হে আমাদের রব!” — এটি আল্লাহকে ডাকার একটি সম্মানসূচক ও আবেগময় সম্বোধন।
  • وَ (ওয়া):আর/এবং — এটি একটি সংযোগকারী শব্দ।
  • تَقَبَّلْ (তাকাব্বাল): “কবুল করুন” — এই শব্দটি এসেছে ‘قَبِلَ’ ধাতু থেকে, যার অর্থ গ্রহণ করা বা কবুল করা। এটি একটি দোয়ার ফর্মুলা, যেখানে বান্দা বিনয়ের সাথে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যতা কামনা করছে।
  • دُعَاءِ (দুআ-ই):আমার দোয়া” — এটি একবচন শব্দ, যার মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট চাওয়া বা আবেদন বোঝানো হয়েছে।

✦ তাফসির ও শিক্ষণীয় বিষয়

১. বান্দার বিনয় প্রকাশ: এই দোয়ার মাধ্যমে বোঝা যায়, একজন নবীও যখন কোনো মহান আমল করেন (যেমন কা’বা নির্মাণ), তখনও তিনি মনে করেন—এই কাজ হয়তো যথেষ্ট হয়নি। তিনি বিনয়ের সাথে আল্লাহর কাছে দোয়া কবুলের আকুতি জানান।

২. আমলের পর দোয়া করা সুন্নাহ: ইব্রাহিম (আ.) আমাদের শিখিয়ে গেছেন, আমল যত বড়ই হোক না কেন, সেটির শেষে আল্লাহর কাছে দোয়া করে তা কবুলের প্রার্থনা করতে হবে। তাই আমাদেরও উচিত—নামাজ, রোযা, সদকা বা কুরআন তিলাওয়াতের পর এই দোয়া পাঠ করা।

৩. দোয়ার মাধ্যমে আত্মনিয়োগ: একজন মুমিনের জীবনে দোয়া শুধু চাওয়া নয়, বরং আত্মসমর্পণের প্রতীক। আল্লাহর দরবারে স্বীকৃতি—“আমার কিছুই নেই, সবকিছু তোমার উপর নির্ভরশীল।”

✦ বাস্তব জীবনে প্রয়োগ

এই দোয়া ছোট হলেও খুবই শক্তিশালী। নিচে কিছু পরিস্থিতি উল্লেখ করছি, যেখানে এই দোয়া ব্যবহার করা যেতে পারে:

  • নামাজের পরে
  • কুরআন তিলাওয়াতের পর
  • কোনো দান বা সদকা দেওয়ার পর
  • হজ বা ওমরাহ শেষে
  • দুআর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে যেকোনো সময়

✦ উপসংহার

“رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاءِ” — এই দোয়া শুধুমাত্র একটি বাক্য নয়, এটি আমাদের হৃদয়ের আকুতি, আমাদের আমলের বিনয়ী নিবেদন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর দোয়াকে আমরা আজও উচ্চারণ করি, কারণ এতে রয়েছে চিরন্তন এক শিক্ষা—আমলকে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলাই আসল সফলতা।

🤲 বাস্তব জীবনের প্রেক্ষাপটে এই দোয়ার প্রয়োগ

আমরা প্রায়ই এমন কাজ করি, যা আমাদের কাছে ছোট মনে হয়—একটি নামাজ, কিছু সদকা, একটি ভালো কথা, একটি কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত। কিন্তু আল্লাহর কাছে কোন আমল কবুল হবে, আমরা জানি না। তাই প্রতিটি আমলের পর আমরা এমনভাবে বলি:

“হে আল্লাহ, আমি জানি না আমার এই ছোট্ট নামাজ কতটা নিখুঁত হয়েছে। আমার খুশু-খুজু হয়তো কম ছিল, মনোযোগও কিছুটা ঘাটতি ছিল। তারপরও তুমি দয়াময়, তুমি ক্ষমাশীল। আমার এই ক্ষুদ্র আমলটুকু তুমি দয়া করে কবুল করে নাও —

🌿 رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاءِ

“হে আমাদের রব! আমাদের দোয়া কবুল করুন।”

এই বাক্যটুকু যেন আমাদের প্রতিটি ইবাদতের পরবর্তী গলার স্বর হয়ে যায়।

❓ কিছু প্রশ্ন ও উত্তর

🔹 ১. রাব্বানা ওয়া তাকাব্বাল দোয়া দোয়াটি কোথা থেকে নেওয়া হয়েছে?

উত্তর: এই দোয়াটি কুরআন মাজিদের সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১২৮-এর অংশ। এটি হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.) এর দোয়া, যাঁরা কা‘বা নির্মাণ করার সময় আল্লাহর দরবারে এই অনুরোধ করেছিলেন।

🔹 ২. এই দোয়ার মূল শিক্ষা কী?

উত্তর: এই দোয়া আমাদের শেখায়—আমল করার পর নিজেকে ‘পরিপূর্ণ’ ভাবা যাবে না, বরং বিনয়ের সাথে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে যেন তিনি সেই আমল কবুল করে নেন।

🔹 ৩. আমরা কোন কোন সময় এই দোয়া পড়তে পারি?

উত্তর: এই দোয়া পড়া যায়—

  • নামাজের পর
  • কোনো সদকা বা দান দেওয়ার পর
  • হজ বা ওমরাহ শেষে
  • কুরআন তিলাওয়াতের পর
  • রাতের তাহাজ্জুদের পরে
  • যখন নিজের দোয়ার কবুল হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকি

🔹 ৪. এই দোয়াটি কি কেবল নবীদের জন্য প্রযোজ্য?

উত্তর: না, কুরআনে উল্লেখিত বহু দোয়া আমাদের জন্যও প্রযোজ্য। “رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاءِ” দোয়াটি নবীদের দোয়া হলেও, এর মাধ্যমে একজন সাধারণ মুমিনও তার দোয়া ও আমলের কবুলের প্রার্থনা করতে পারে।

🔹 ৫. দোয়াটির মধ্যে ‘দুআ-ই’ কেন বলা হয়?

উত্তর: “دُعَاءِ” শব্দটি আরবিতে ইযাফা বা সংযুক্তি ফর্মে এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে ‘আমার দোয়া’। এটি এমন এক আবেগপূর্ণ নিবেদন, যেখানে বান্দা তার একান্ত চাওয়াকে আল্লাহর কাছে তুলে ধরছে।


পোস্টটি শেয়ার করুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x