ওযুর মাকরুহ বিষয়সমূহ । ২ টি প্রকার । দলিলসহ বিস্তারিত আলোচনা

পোস্টটি শেয়ার করুন

ওযু যদিও একটি পবিত্র ইবাদতের অংশ, তবে এমন কিছু আচরণ রয়েছে, যেগুলো এ ইবাদতের মর্যাদা ও আদবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ কারণেই ফিকহবিদগণ ওযুর কিছু কাজকে “মাকরুহ” তথা অপছন্দনীয় বলে উল্লেখ করেছেন।

এসব মাকরূহ কাজ যদিও সরাসরি ওযুকে বাতিল করে না, তবে ওযুর সৌন্দর্য ও উদ্দেশ্য ব্যাহত করে। কখনো তা হয় বাড়াবাড়ির মাধ্যমে, আবার কখনো হয় অবহেলার কারণে। তাই একজন মুমিনের উচিত—ওযু করার সময় শরীয়তের নির্দেশিত সীমা ও আদব মেনে চলা, এবং যেসব কাজ ওযুর মধ্যে অনুচিত গণ্য হয়েছে, তা থেকে দূরে থাকা।

এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব—ওযুর সেইসব মাকরূহ বিষয়সমূহ, যেগুলো এড়িয়ে চলা উত্তম, যেন ওযু শুধুই শারীরিক পরিশুদ্ধতা না হয়ে, আত্মিক পরিশুদ্ধতারও মাধ্যম হয়ে ওঠে।

ওযুর মাকরুহ কী? ও কয় প্রকার

ওযুর মাকরুহ: বলতে বোঝায়—ওযু করার সময় এমন কিছু কাজ করা, যেগুলো শরীয়তের দৃষ্টিতে অপছন্দনীয়, অনুচিত বা আদববিরুদ্ধ। এসব কাজ করলে ওযু ভঙ্গ হয় না, কিন্তু ওযুর পূর্ণতা ও ফজিলত নষ্ট হয়ে যায়। ফিকহবিদগণ মাকরূহকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করেছেন:

১. مكروه تحريماً (মাকরুহ তাহরিমি): এটি হারামের কাছাকাছি। এটি পরিহার করা ওয়াজিব। হানাফিদের বর্ণনায় যখন শুধু ‘مكروه’ বলা হয়, তখন সাধারণত এটি-ই বোঝানো হয়।

২. مكروه تنزيهاً (মাকরুহ তানযিহী): এটি এমন কাজ যা না করাই উত্তম, তবে করলে গোনাহ হয় না—এটি ‘খিলাফে উলা’ বা উত্তমতার বিরুদ্ধ বলে গণ্য। হানাফিরাও কখনো কখনো এই অর্থে مكروه শব্দ ব্যবহার করেন।

তাই কেউ কোনো কাজকে مكروه বললে, তার প্রমাণ দেখে বুঝতে হবে সেটা কোন ধরনের মাকরুহ:

  • যদি প্রমাণটি ظني (ধারণামূলক নিষেধাজ্ঞা) হয়, তাহলে এটি ‘তাহরিমী مكروه’ হবে—যদি না কোনো প্রমাণ তা ‘مندوب’ বা অনুপ্রেরণীয় দিকে নিয়ে যায়।
  • আর যদি কোনো স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা না থাকে, বরং ‘না করার পরামর্শ’ দেওয়া হয়, তাহলে সেটি ‘তানযিহী مكروه’ হবে।

১. পানি ঢালায় বাড়াবাড়ি করা (إسراف):

যথাযথ পরিমাণের চেয়ে বেশি পানি ব্যবহার করা। যদি পানি ব্যক্তিগত বা হালাল হয়, তাহলে অতিরিক্ত ব্যবহার مكروه। তবে যদি পানি মসজিদে ওজুর জন্য নির্ধারিত হয়, তাহলে অতিরিক্ত ব্যবহার হারাম।

প্রমাণ: ইবন মাজাহ ও অন্যান্যরা আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আমর (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ ﷺ একবার সাঈদ (রা.)-কে ওজু করতে দেখে বললেন:

“এত অপচয় কেন?” তিনি বললেন: “ওজুতে কি অপচয় হয়?” তিনি ﷺ বললেন: “হ্যাঁ, যদিও তুমি প্রবাহিত নদীর ধারে থাকো”।

আরও একটি হাদীস:

«…جاء فيه: فمن زاد على هذا أو نقص فقد أساء وتعدى وظلم»

(তিনবারের বেশি গায়ে ধোয়া বা একবারের বেশি মাসেহ করা অপচয় ও বাড়াবাড়ি)।

হানাফি মতে: এটি তানযিহী مكروه যদি কেউ তিনবারের বেশি ধুতে থাকে। তবে কেউ যদি মনে করে এটি ওজুর অংশ, তাহলে তাহরিমী মাকরুহ হবে।

ইবন আবেদীন বলেন: যদি কেউ পরিচ্ছন্নতা বা প্রশান্তির জন্য বাড়িয়ে নেয়, তাহলে আর مكروه নয়।

২. পানির ছিটা মেরে মুখে বা শরীরে মারা:

মাকরুহ তানযিহী : কারণ এতে ব্যবহারকৃত পানি কাপড়ে লাগার সম্ভাবনা থাকে। এটি গাম্ভীর্য ও শালীনতার বিরুদ্ধে।

৩. মানুষের কথা বলা (সাধারণ কথা):

মাকরুহ তানযিহী কারণ এটি ওজুর দোয়াসমূহে মনোযোগে বাধা দেয়। شافعي মতে: এটি খিলাফে উলা।

৪. অপ্রয়োজনে অন্যের সাহায্য নেওয়া:

রাসূল ﷺ ওজুতে কাউকে দায়িত্ব দিতেন না। সহিহ হাদিস থেকে ওজুতে সহযোগিতা প্রমাণিত হলেও, এটি অসুস্থতা বা অজুহাতের ক্ষেত্রে অনুমোদিত।

৫. অপবিত্র স্থানে ওজু করা:

যাতে কাপড় বা শরীর নাপাক না হয়। হানাফিরা আরও বলেন: নারীর ব্যবহৃত পানি দিয়ে (যদি সে একা ব্যবহার করেছে) কিংবা মসজিদে সরাসরি ওজু করা مكروه, যদি ইনামের বা মেঝের ক্ষতি হয়।

হাম্বালি মতে: ওজুর পানি মসজিদে বা যেখানে মানুষ হাঁটে সেখানে ফেলা مكروه, কারণ ওজুর পানির মর্যাদা আছে। তবে কেউ কষ্ট না পেলে মসজিদে ওজু করা জায়েয।

৬. গলায় মাসেহ করা:

হানাফি ছাড়া বাকি মাযহাব মতে: এটি গোঁড়ামি ও কঠোরতা, কোনো প্রমাণ নেই, তাই بدعة مكروهة
ইমাম নববী বলেন: এটি বিদআত।

৭. রোজাদারের জন্য অতিরিক্ত কুলি বা নাকে পানি টানা:

যাতে পানি গলায় না পৌঁছে এবং রোজা ভেঙে না যায়।

৮. ওজুর সুন্নত ছেড়ে দেওয়া

যেমন নাক পরিষ্কার করা, ডান হাতে জিনিস নেওয়া ইত্যাদি বাম হাতে না করলে مكروه।

৯. নারীর ব্যবহৃত ওজুর পানি দিয়ে পুরুষের ওজু করা (যদি সে একা ব্যবহার করে):

حنابيلة মতে: مكروه। কারণ হাদীসে নিষেধ এসেছে। তবে অধিকাংশ আলেম বলেন: জায়েয।

প্রমাণ:

কেননা ইমাম মুসলিম ( রাহি.) তাঁর সহীহ মুসলিম শরিফে এবং আহমদ (রাহি.) ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন—তিনি বলেন:

 كان النبي صلّى الله عليه وسلم يغتسل بفضل وضوء ميمونة

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাইমূনার (রাঃ) ওযু করার বাকি পানি দিয়ে গোসল করেছেন।”

আর মাইমূনা (রাঃ) বলেন:

 اغتسلت من جفنة، ففضلت فيها فضلة، فجاء النبي صلّى الله عليه وسلم يغتسل، فقلت: إني قد اغتسلت منه، فقال: الماء ليس عليه جنابة

“আমি একটি পাত্র থেকে গোসল করলাম, তাতে কিছু পানি অবশিষ্ট রইল। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসে তা দিয়ে গোসল করলেন। আমি বললাম: আমি তো এটি দিয়ে গোসল করেছি। তিনি বললেন: ‘পানির ওপর কোনো অপবিত্রতা (জানাবাত) আসে না।’ ( আহমদ, আবু দাউদ, নাসাঈ ও তিরিমিযি)

আর যেহেতু এটি পবিত্র পানি—যা দিয়ে একজন মহিলা ওযু করতে পারে, সেহেতু একজন পুরুষও তা দিয়ে ওযু করতে পারবে, ঠিক যেমন পুরুষের বাকি পানি দিয়ে অন্যজন ওযু করতে পারে।

এটাই সবচেয়ে বিশুদ্ধ মত। আর এই হাদিসগুলোর ভিত্তিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিষেধকে তানযিহী মাকরূহ (সাধারণভাবে অপছন্দনীয়) অর্থে গ্রহণ করা হবে।

১০. খুব গরম বা খুব ঠান্ডা পানি, বা রৌদ্রে গরম পানিতে ওজু করা

شافعية মতে: مكروه؛ কারণ এতে শারীরিক ক্ষতি হতে পারে, যেমন সাদা দাগ (برص)। তবে হারাম নয়, কারণ এর ক্ষতি নিশ্চিত নয়।

উপসংহার

ওযু শুধু শারীরিক পরিচ্ছন্নতার মাধ্যম নয়, বরং এটি আত্মিক প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ—যার মাধ্যমে মানুষ নামাযের মতো মহৎ ইবাদতের দিকে অগ্রসর হয়। তাই ওযুর প্রতিটি কাজেই থাকা উচিত সৌন্দর্য, সংযম ও সুন্নাতের অনুসরণ।

ওযুর মাকরূহ বিষয়গুলো এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ইবাদত শুধু ফরজ ও সুন্নাত পালনে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এমন কিছু আচরণ থেকেও বিরত থাকা জরুরি, যেগুলো ইবাদতের আদব ও খুশু-খুজু নষ্ট করে দিতে পারে।

একজন সচেতন মুমিনের দায়িত্ব— ওযুর মাকরুহ বিষয়সমূহ চিনে রাখা, সেগুলো থেকে দূরে থাকা এবং নিজের ওযুকে আরও পরিশুদ্ধ, পরিপূর্ণ ও নববী আদর্শ অনুযায়ী গড়ে তোলা। কেননা ইখলাস ও আদব মিলেই একটি আমলকে কবুলযোগ্য করে তোলে।


পোস্টটি শেয়ার করুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x