মেসওয়াক অর্থ দাঁতের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, যা মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য ভালো রাখে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উপায়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেসওয়াক করার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন এবং তা নিয়মিত পালন করতেন। তিনি বলেছেন, “মেসওয়াক মুখের পবিত্রতা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের কারণ।” মেসওয়াক করার রয়েছে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন ও আদব, যেগুলো অনুসরণ করলে এর পূর্ণ ফায়দা লাভ করা সম্ভব হয়।
তাই মেসওয়াক করার নিয়মসমূহ জানা ও তা আমল করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই আলোচনায় আমরা মেসওয়াক করার সঠিক নিয়ম ও আদবসমূহ সংক্ষেপে উপস্থাপন করবো, ইনশাআল্লাহ।
মিওয়াক কী ? পরিচিতি
আরিব সিওয়াক অর্থ হলো ‘দলক’ বা মাজার। আর মিসওয়াক শব্দটির অর্থ দলক বা মাজারের মাধ্যম বা বস্তু। এটি দাঁত এবং তার আশেপাশের অংশে ব্যবহার করা হয়। যাতে দাঁতের হলুদভাব দূর হয় এবং অন্যান্য অপবিত্রতা পরিষ্কার হয়।
মিসওয়াকের বিধান
মিসওয়াক হল একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ। এটি মুখ পরিষ্কার করার একটি উপায় এবং এটি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের কারণ। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
السواك مَطْهرة للفم، مَرْضاة للرب
“সিওয়াক মুখকে পরিষ্কার করে, এবং রবের সন্তুষ্টি লাভের কারণ” (নাসাঈ, আহমদ)।
এই সুন্নাহটি কোনো নির্দিষ্ট সময় বা অবস্থার সাথে নির্ধারিত নয়। সুতরাং, এটি সর্বদা সুন্নাহ এবং যে কো সময়ই করলে এই সুন্নাহ পালন হবে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ, তবে কোন অবস্থাতেই এটি ফরজ নয়।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
لولا أن أشق على أمتي لأمرتهم بالسواك مع كل وضوء
“যদি আমি আমার উম্মতকে কষ্ট না দিতাম, তবে আমি তাদের প্রতি প্রতিটি ওযুর সময় মিসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম” ( বুখারি )
ফিকহীদের মতে এর বিধান:
হানাফি মাযহাবে, মিসওয়াক প্রতিটি ওজুর সময় সুন্নাহ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: তবে, যদি কেউ ওজুর সময় মিসওয়াক ভুলে যায়, তবে এটি নামাজের সময় সুন্নাহ হিসেবে অনুসৃত হবে।
এভাবে ঘুমানোর পর, খাওয়ার পর, দীর্ঘ সময় চুপ থাকার পর, বা অনেক কথা বলার পর মিসওয়াক করা সুন্নত। যেমনটি হুজায়ফা (রা.) বলেছেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের বেলায় উঠে মিসওয়াক দিয়ে মুখ পরিষ্কার করতেন”। ( বুখারি ও মুসলিম )
এছাড়া, কুরআন পড়ার সময়, ইসলামী বিদ্যা শিখতে, যিকিরের সময়, ঘুমানোর আগে এবং ওঠার পর, ঘরের প্রবেশে, সেহরি খাওয়ার সময়, এবং বিতিরের পরেও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মেসওয়াক করার নিয়ম
ব্যক্তি তার ডান হাতে মিসওয়াক করবে, ডান দিক থেকে শুরু করবে, দাঁতের উপর ও ভিতর দিকে (সামনে ও পিছনে) চওড়া করে (আড়াআড়ি) মিসওয়াক করবে; সামনের দাঁত থেকে পেছনের দাঁত পর্যন্ত। তারপর মাঝখানে গিয়ে, তারপর বাম দিকে যাবে। আর জিহ্বায় মিসওয়াক করবে লম্বা করে।
কেননা আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
“তিনি তাঁর জুতা পরা, চুল আঁচড়ানো, পবিত্রতা অর্জন এবং সমস্ত কাজে ডান দিককে পছন্দ করতেন।”
আর অন্য হাদীসে এসেছে:
“তোমরা যখন মিসওয়াক করবে, তখন চওড়া করে করো।”
যদিও দাঁতে লম্বা করে মিসওয়াক করলেও তা সহিহ হবে, তবে তা মাকরূহ (অপছন্দনীয়); কারণ এতে মাড়ি রক্তাক্ত হতে পারে এবং দাঁতের মাংস নষ্ট হতে পারে।
জিহ্বার ক্ষেত্রে: জিহ্বায় মিসওয়াক করা সুন্নত, এবং তা লম্বাভাবে করা উত্তম, যেমন ইবন দকীকুল ঈদ উল্লেখ করেছেন, আবু দাউদের এক হাদীসের ভিত্তিতে।
মিসওয়াকের উপকরণ
মিসওয়াক এমন কোমল ডাল দিয়ে করা উত্তম যা খেজুর গাছ বা অন্য কোনো গাছের হতে পারে, যা মুখ পরিষ্কার করে, ক্ষতি বা আঘাত করে না, আর মুখে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে না।
সবচেয়ে উত্তম হলো — আরাক গাছের মিসওয়াক, তারপর খেজুর গাছের, তারপর সুন্দর সুগন্ধিযুক্ত ডাল, এরপর পানিতে ভিজানো শুকনো ডাল, তারপর অন্য কোনো ডাল।
অন্য কারো মিসওয়াক ব্যবহার করা জায়েয, যদি সে অনুমতি দেয়; যদি অনুমতি না দেয়, তবে হারাম।
আবু দাউদ থেকে বর্ণিত: আয়িশা (রা.) বলেন:
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিসওয়াক করছিলেন, তখন তাঁর সাথে দুইজন লোক ছিল; তাদের একজন বড় ছিল। তখন ওহি নাজিল হলো: ‘মিসওয়াক বড়কে দাও।’”
মিসওয়াকের বিকল্প
হানাফি ও মালেকি মতে, যদি মিসওয়াক না থাকে, তবে আঙুল দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা যেতে পারে।
- আলী (রা.) বলেন: “তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ঘষা হলো মিসওয়াক।”
- আবার আবু দাউদ থেকে বর্ণিত: “আঙুল দিয়ে মিসওয়াক করার অনুমতি আছে।”
তবে শাফেয়ি ও হাম্বলি মতে, আঙুল দিয়ে মিসওয়াকের সুন্নত আদায় হয় না।
- একইভাবে, কাপড় বা অন্য কোনো নরম জিনিস দিয়েও মিসওয়াক আদায় হয় না।
- শাফেয়ি মতে, কোনো রুক্ষ জিনিস দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা হলে তা মিসওয়াকের বিকল্প হতে পারে।
মিসওয়াক ব্যবহারের পর: মিসওয়াক ব্যবহারের পর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা সুন্নত।
আয়িশা (রা.) বলেন:
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিসওয়াক করতেন, তারপর আমাকে দিতেন; আমি তা ধুয়ে দিতাম, আবার তাঁকে ফিরিয়ে দিতাম।”
কোন ডাল দিয়ে মিসওয়াক করা নিষেধ:
- ডালিম, বাসতানি বা সুগন্ধিযুক্ত ডাল দিয়ে মিসওয়াক করা নিষেধ; কারণ এগুলো মুখের মাংসের ক্ষতি করে, পরিষ্কার করে না, এবং শরীয়ত অনুমোদিত নয়।
- হাদীসে এসেছে: “বাসতানি ও ডালিমের ডাল দিয়ে দাঁত খোঁচানো না করো, কারণ এগুলো থেকে কুষ্ঠরোগ হতে পারে।”
মিসওয়াক করার সময় দোয়া: মিসওয়াকের সময় এ দোআ পড়া মুস্তাহাব:
اللهم طهر قلبي ومحِّص ذنوبي
অর্থ: হে আল্লাহ, আমার অন্তরকে পবিত্র করুন এবং আমার গুনাহসমূহ মুছে দিন।
সুন্নতের নিয়ত করা: কিছু শাফেয়ি আলেম বলেছেন, মিসওয়াকের সময় ‘সুন্নত আদায়ের নিয়ত’ করা উত্তম।
মসজিদে মিসওয়াক: মসজিদে মিসওয়াক করা মাকরূহ নয়; কারণ কোনো নির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা নেই।
মিসওয়াকের দৈর্ঘ্য: মিসওয়াকের দৈর্ঘ্য এক বিঘতের বেশি না হওয়া উত্তম।
- বায়হাকি থেকে বর্ণিত: জাবির (রা.) বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিসওয়াকের দৈর্ঘ্য ছিল লেখকের কানের কলমের মতো।”
মিসওয়াক করার ফজিলত
আলেমরা বলেছেন, মিসওয়াকের ফজিলত হলো:
- মুখের পবিত্রতা প্রদান করে,
- আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়,
- দাঁত সাদা করে,
- মুখের গন্ধ সুগন্ধিময় করে,
- মেরুদণ্ড সোজা রাখে,
- মাড়িকে শক্ত করে,
- বার্ধক্য দেরি করে,
- চেহারা পরিষ্কার রাখে,
- বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি করে,
- নেকি দ্বিগুণ হয়,
- মৃত্যুর সময় সহজ করে,
- মৃত্যু মুহূর্তে শাহাদাত স্মরণ করিয়ে দেয়।