এই শব্দটি অনেকের কাছেই পরিচিত। কারো ঘরে সুরক্ষার জন্য, কেউ প্রেমে সাফল্যের আশায়, আবার কেউ ব্যবসায় লাভবান হওয়ার জন্য তাবিজ ব্যবহার করে থাকেন। তবে এসব তাবিজের মধ্যে এক ধরনের তাবিজ রয়েছে, যার নাম শুনলেই মানুষের মনে কৌতূহল ও রহস্য জাগে— রাজমোহনী তাবিজ।
রাজমোহনী তাবিজ কী?
রাজমোহনী তাবিজ মূলত এমন একটি তাবিজ, যা supposedly (কথিতভাবে) ব্যবহার করলে—
- যেকোনো ব্যক্তিকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করা যায়
- মন জয় করা সম্ভব হয়
- প্রেমে সফলতা আসে
- এমনকি রাজা-বাদশাহ, বস, ক্লায়েন্টকেও বশে আনা যায়
এই তাবিজকে অনেক সময় “প্রেমজয়ী তাবিজ”, “বশীকরণ তাবিজ” ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। এটি সাধারণত কালো কাপড় বা ধাতব পাত্রে পবিত্র কিছু বাক্য বা চিহ্ন লিখে গলায়, হাতে বা কোমরে বাঁধা হয়।
এর প্রচলন কোথা থেকে?
রাজমোহনী তাবিজের ধারণা এসেছে মূলত হিন্দু তন্ত্রমন্ত্র ও লোকজ যাদুবিদ্যার সংস্কৃতি থেকে। পরবর্তীতে এটি কিছু ছদ্মবেশী পীর, ফকির ও কবিরাজদের মাধ্যমে মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। তারা কুরআনের আয়াত, নাম, বা আরবিতে কিছু লিখে এই তাবিজকে ইসলামী রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আদতে এর পেছনে থাকে মানুষকে প্রভাবিত করার মানসিক খেলা বা ধোঁকাবাজি।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে রাজমোহনী তাবিজ
ইসলাম স্পষ্টভাবে তাবিজ, বশীকরণ ও যাদু বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
১. শিরক ও কুফরির আশঙ্কা
রাসূল ﷺ বলেন:
“যে ব্যক্তি তাবিজ ঝুলালো, সে শিরক করলো।” (আহমদ: ৩৬০৪)
২. মনোবশীকরণ ইসলামে নিষিদ্ধ
যেকোনো ধরনের বশীকরণ, হোক তা ভালোবাসার জন্য বা চাকরি পাওয়ার জন্য—যদি তা দোয়া-দরূদ বা বৈধ উপায়ে না হয়, বরং যাদু, তাবিজ, মন্ত্র বা অজ্ঞাত চিহ্ন দিয়ে হয়, তাহলে তা হারাম।
৩. যাদু শিখা ও শেখানো কবিরা গুনাহ
কুরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে—
“তারা মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে। অথচ তারা কারো ক্ষতি করতে পারে না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া।” — (সূরা আল-বাকারা: ১০২)
প্রতারণার এক মরণফাঁদ
রাজমোহনী তাবিজ আসলে একটি দোষপূর্ণ ব্যবসা। মানুষ যখন প্রেমে ব্যর্থ হয়, চাকরিতে ব্যর্থ হয়, দাম্পত্য জীবন সংকটে পড়ে—তখন তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে কিছু অসাধু লোক আবেগকে পুঁজি করে হাজার হাজার টাকা নেয় ‘রাজমোহনী তাবিজ’ বানানোর নাম করে। ফলাফল? না মন জয় হয়, না সফলতা আসে, বরং মানুষ আরও হতাশ হয়।
সমাধান কী?
- তাওহীদের শিক্ষা গ্রহণ করুন
- কুরআন ও সহীহ দোয়ায় ভরসা রাখুন
- হালাল উপায়ে চেষ্টা করুন
- সবর ও তাওয়াক্কুল করুন আল্লাহর উপর
একটি সহীহ দোয়া মন জয় করার জন্য
اللَّهُمَّ اجْعَلْ لِي نُورًا فِي قَلْبِهِ
অর্থ: হে আল্লাহ! তার অন্তরে আমার জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করে দাও।
এ দোয়া ব্যক্তিগত সম্পর্কের উন্নতির জন্য দুআ হিসেবে বলা যেতে পারে, তবে সেটিও হালাল উদ্দেশ্য ও বৈধ সম্পর্কের জন্যই প্রযোজ্য।
বাস্তব অভিজ্ঞতা । তাবিজ নয়, তাওহীদই মুক্তি দিল
রাজশাহীর আশরাফুল ইসলাম, একজন তরুণ ব্যবসায়ী। কলেজ জীবনেই প্রেমে পড়েছিলেন এক সহপাঠিনীর। মেয়েটি তাকে পাত্তা না দেওয়ায় তিনি মনস্তাপে ভুগছিলেন। এক বন্ধুর পরামর্শে তিনি এক “পীর সাহেব”-এর কাছে যান। পীর তাকে একটি “রাজমোহনী তাবিজ” দেন, যা নাকি গলায় ঝুলালেই মেয়েটি নিজেই প্রেমে পড়ে যাবে।
তাবিজের বিনিময়ে তাকে দিতে হয় ৫০০০ টাকা এবং কিছু “কড়কড়ে শর্ত”—সাত দিন গোসল না করা, কারো সঙ্গে কথা না বলা ইত্যাদি। আশরাফুল মেনে নেয়। দিন যায়, কিন্তু মেয়েটির মনোভাবের বদল তো দূরে থাক, সে আশরাফুলকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলতে থাকে। এতে হতাশ হয়ে সে আবার পীরের কাছে যায়, কিন্তু এবার তাকে আরও শক্তিশালী তাবিজের জন্য ১০,০০০ টাকা চাওয়া হয়।
এই পর্যায়ে এসে আশরাফুল কিছু দ্বীনি বন্ধুদের কাছে বিষয়টি খুলে বলেন। তারা তাকে আল্লাহর উপর ভরসা করার কথা বলেন এবং তাওহীদের ব্যাখ্যা দেন। কিছু ইসলামিক লেকচার ও সহীহ হাদিস শুনে সে বুঝে যায়, সে একটি শয়তানী ফাঁদে পা দিয়েছিল। পরে সে তওবা করে এবং তাবিজগুলো পুড়িয়ে ফেলে। এখন সে নিজেই মানুষকে তাবিজের কুফল সম্পর্কে সচেতন করে।
তার কথায়—
“আমি বুঝে গেছি, মানুষের মন জয় হয় চরিত্র ও দোয়ার মাধ্যমে—তাবিজ দিয়ে নয়। তাওহীদই আমার সবচেয়ে বড় রাজমোহন।”
তাবিজের বিভিন্ন ধরণ ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
বর্তমানে বাজারে, সোশ্যাল মিডিয়ায় এমনকি ইউটিউব ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তাবিজের প্রচার ও বিক্রি ভয়াবহভাবে বেড়েছে। নিচে কিছু প্রচলিত তাবিজের নাম ও দাবিকৃত কাজ তুলে ধরা হলো:
📌 ১. রাজমোহনী তাবিজ
কথিতভাবে এটি মানুষকে নিজের প্রেমে পড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। অনেকে এটিকে “প্রেমবশীকরণ তাবিজ”ও বলে। কিছু পেজ ও বিজ্ঞাপন দেখে মনে হবে, যেন এটা প্রেমিকাকে বশে আনার নিশ্চিত চাবিকাঠি!
📌 ২. বশীকরণ তাবিজ
স্বামী-স্ত্রী, বস, শ্বশুরবাড়ি, শত্রু বা যে কাউকে বশে আনতে ব্যবহৃত হয় বলে দাবি করা হয়। এটি প্রায়ই কালো কাপড় বা ধাতব কেসে দেওয়া হয়, যেখানে “গুপ্ত অক্ষর”, “সীলমোহর” বা “তন্ত্রমন্ত্র” লেখা থাকে।
📌 ৩. ব্যবসা উন্নতির তাবিজ
ব্যবসা জমে না, আয় কম হচ্ছে—এই অভিযোগ শুনলেই অনেক কবিরাজ/পীররা বলেন, “তোমার ওপর নজর লেগেছে, জিনের বাধা আছে, দোকানে তাবিজ ঝুলাও।” তারা বলে, এটা দিলে ক্রেতা আকৃষ্ট হবে!
📌 ৪. জ্বিন ছাড়ানোর তাবিজ
অনেক সময় পাগলামী, ভয়ভীতি বা মানসিক সমস্যাকে জ্বিনের সমস্যা বলে ধরে নিয়ে তাবিজ দেওয়া হয়। অথচ প্রকৃত কারণ হতে পারে মানসিক রোগ বা সামাজিক অবহেলা।
🌐 বর্তমান প্রেক্ষাপট: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তাবিজের রাজত্ব
আজকাল রাজমোহনী বা বশীকরণ তাবিজের ব্যবসা শুধু কবিরাজদের ঘরে সীমাবদ্ধ নেই। বরং এখন তারা—
- ফেসবুক পেজ চালায়: “তাবিজ হুজুর”, “আস্তাগফিরুল্লাহ তাবিজ ঘর”, “নূরানী পীর সাহেব” ইত্যাদি নামে অসংখ্য পেজ ও গ্রুপ তৈরি করে প্রতিদিন হাজারো মানুষকে টার্গেট করে।
- ইনবক্সে হুমকি দেয় বা লোভ দেখায়: “এটা না নিলে তুমি আজীবন কষ্টে থাকবে” —এই ধরনের কথাও বলে তারা।
- অ্যাড দিচ্ছে ইসলামিক পোস্টের মাঝখানে: কোনো ইসলামিক আয়াত বা হাদিসের
উপসংহার
রাজমোহনী তাবিজ শুধু একটি শয়তানী ফাঁদ নয়, বরং একটি ভয়ানক আকিদাগত বিপদ। মুসলিম হিসেবে আমাদের উচিত—শিরক, তাবিজ ও যাদুবিদ্যার সব ধরণের রূপ থেকে নিজেকে রক্ষা করা। মানুষকে পরিবর্তন করতে চাইলে, নিজের চরিত্র ও আখলাক পরিবর্তন করো—কোনো তাবিজ নয়।