সৌন্দর্য – এক চিরন্তন আকর্ষণ। বিশেষ করে মেয়েদের চেহারা সুন্দর করা যেন জীবনের এক স্বাভাবিক চাওয়া। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে সৌন্দর্য শুধু বাহ্যিক রূপে সীমাবদ্ধ নয়, বরং অন্তরের পবিত্রতা, চারিত্রিক সৌন্দর্য এবং ইবাদতের দীপ্তিতেই প্রকৃত সৌন্দর্য প্রকাশ পায়। চেহারা সুন্দর করার কিছু দোয়া রয়েছে, সেটাও করা যেতে পারে।
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ ﷺ বিভিন্ন সময় আল্লাহর কাছে সুন্দর চেহারা, ত্বক ও স্বাস্থ্য কামনা করে দোয়া করতেন। আর কুরআন ও হাদীসে কিছু দোয়া এমনভাবে এসেছে, যা অন্তরকে যেমন আলোকিত করে, তেমনি মুখমণ্ডলে শান্তি ও নূরের প্রতিফলন ঘটায়।
এই ব্লগপোস্টে আমরা আলোচনা করবো—
- মেয়েদের চেহারা সুন্দর, উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয় করার জন্য কুরআন ও হাদীসভিত্তিক দোয়া,
- চেহারায় নূর এবং প্রশান্তি বৃদ্ধির আমল,
- বাহ্যিক যত্নের সাথে সাথে আত্মিক শুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা।
আসুন, জেনে নিই এমন কিছু সুন্দর দোয়া, যা প্রতিদিনের জীবনে অভ্যাস করলে আল্লাহর রহমতে আমাদের চেহারাতেও আসতে পারে প্রশান্তিময় সৌন্দর্যের দীপ্তি।
🌟 মেয়েদের চেহারা সুন্দর ও নূরানী করার জন্য কিছু দোয়া
🕌 ১. চেহারায় নূর বৃদ্ধির দোয়া
আরবি:
اللَّهُمَّ بَيِّضْ وَجْهِي يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা বাই্যিদ ওয়াজহি ইয়াওমা তাবইয়াদ্দু উজূহু ওয়া তাসওয়াদ্দু উজুহ।
অর্থ: হে আল্লাহ, সেই দিন আমার চেহারা উজ্জ্বল করে দাও, যেদিন কিছু চেহারা উজ্জ্বল হবে আর কিছু চেহারা কালো হবে।
সূত্র: ইবনু কাসীর, তাফসীরুল কুরআনিল আজীম, সূরা আলে ইমরান: ১০৬
✨ ২. চেহারায় আলো ও প্রাণবন্ততা চাওয়ার দোয়া
আরবি:
اللَّهُمَّ اجعل في قلبي نورًا، وفي لساني نورًا، وفي سمعي نورًا، وفي بصري نورًا، واجعل من خلفي نورًا، ومن أمامي نورًا، ومن فوقي نورًا، ومن تحتي نورًا، اللهم أعطني نورًا.
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাজ’আল ফি কালবি নূরান, ওয়া ফি লিসানি নূরান, ওয়া ফি সামি’ই নূরান, ওয়া ফি বাসারি নূরান, ওয়াজ’আল মিন খলফি নূরান, ওয়া মিন আমামি নূরান, ওয়া মিন ফাওকি নূরান, ওয়া মিন তাহতি নূরান, আল্লাহুম্মা আ‘তিনি নূরান।
অর্থ: হে আল্লাহ, আমার হৃদয়ে নূর দান করুন, আমার জিহ্বায় নূর দিন, আমার শ্রবণে নূর দিন, আমার দৃষ্টিতে নূর দিন, আমার পেছনে নূর দিন, সামনে নূর দিন, ওপরে নূর দিন, নিচেও নূর দিন। হে আল্লাহ! আমাকে নূর দিন।
সূত্র: সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৭৬৩
💧 ৩. পানির সময় মুখ ধোয়ার দোয়া (চেহারায় নূর বাড়ানোর জন্য)
নবী ﷺ ওযু করার সময় মুখ ধোয়ার সময় বলতেন:
আরবি:
اللَّهُمَّ بَيِّضْ وَجْهِي يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهُ أَوْلِيَائِكَ، وَلَا تُسَوِّدْ وَجْهِي يَوْمَ تَسْوَدُّ وُجُوهُ أَعْدَائِكَ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা বাই্যিদ ওয়াজহি ইয়াওমা তাবইয়াদ্দু উজুহু আওলিয়ায়িকা, ওলা তুসাওইয়িদ ওয়াজহি ইয়াওমা তাসওয়াদ্দু উজুহু আ’দায়িকা।
অর্থ: হে আল্লাহ, সেই দিন আমার মুখ উজ্জ্বল করে দাও যেদিন তোমার বন্ধুদের মুখ উজ্জ্বল হবে, আর আমার মুখ কালো করো না যেদিন তোমার শত্রুদের মুখ কালো হবে।
সূত্র: আবু নুয়াইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া, ২/২৩৫
আরো পড়ুন:
🌿 সুন্দর চেহারার জন্য আমল ও পরামর্শ
✅ ১. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত নিয়মিত আদায় করুন
ইবাদতের নূর সবচেয়ে বেশি প্রতিফলিত হয় চেহারায়।
✅ ২. রাতে তাহাজ্জুদে উঠুন
রাতে উঠে আল্লাহর সামনে কান্নাকাটি করলে আল্লাহ বান্দাকে ভালোবাসেন, এবং তাঁর চেহারায় প্রশান্তি দেন।
✅ ৩. নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করুন
আল্লাহর কালামের আলো অন্তরে যেমন নূর আনয়ন করে, তেমনি তা চেহারায়ও দীপ্তি ছড়ায়।
✅ ৪. হালাল খাবার গ্রহণ করুন ও গীবত থেকে বিরত থাকুন:
হারাম খাবার ও গোনাহের কারণে চেহারার সৌন্দর্য নষ্ট হয়।
✅ ৫. হাসিমুখে থাকা ও সদাচরণ করুন
রাসূল ﷺ বলেন:
“তোমার ভাইয়ের প্রতি তোমার হাসিমুখই একটি সদকা।” – (তিরমিজি, হাদিস: ১৯৫৬)
🌿 চেহারার সৌন্দর্য সম্পর্কে ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলামে সৌন্দর্য একটি স্বীকৃত ও প্রশংসনীয় বিষয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা নিজেই সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন। তবে এই সৌন্দর্যের সংজ্ঞা শুধু বাহ্যিক রূপে সীমাবদ্ধ নয়। বরং ইসলাম সৌন্দর্যকে বিবেচনা করে অন্তরের পবিত্রতা, চরিত্রের উৎকর্ষতা ও আল্লাহভীতির আলোকে।
🕊️ সৌন্দর্য নিয়ে কুরআনের নির্দেশনা
আল্লাহ বলেন:
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও ধন-সম্পদের দিকে নজর দেন না; বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে নজর দেন।” 🕌 — সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২৫৬৪
এই হাদীস স্পষ্ট করে দেয়, ইসলাম বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে আত্মিক সৌন্দর্যকে বেশি গুরুত্ব দেয়। কারণ একমাত্র তাকওয়াই (আল্লাহভীতি) হলো আল্লাহর কাছে মর্যাদার মানদণ্ড:
“তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সে-ই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক পরহেযগার।” 📖 — সূরা হুজুরাত: ১৩
🌸 সৌন্দর্য বনাম আত্মম্ভরিতা
ইসলামে নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, সুন্দর পোশাক পরা – এগুলো প্রশংসনীয়। কিন্তু এগুলোর মাঝে অহংকার, গর্ব বা প্রদর্শনের মনোভাব থাকলে তা সম্পূর্ণরূপে হারাম হয়ে যায়।
রাসূল ﷺ বলেন:
“যে ব্যক্তি তার অন্তরে এক তিল পরিমাণ অহংকারও ধারণ করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” 🕌 — সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৯১
এক সাহাবি তখন বললেন, “আমি চাই যে, আমার পোশাক ও জুতা সুন্দর হোক।”
রাসূল ﷺ উত্তরে বললেন:
“আল্লাহ সুন্দর; তিনি সৌন্দর্য ভালোবাসেন। অহংকার হলো—সত্যকে অস্বীকার করা ও মানুষকে তুচ্ছ ভাবা।” 🕌 — সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৯১
🌼 আত্মিক সৌন্দর্যই আসল সৌন্দর্য
একজন নারী যতই সাজগোজ করুক, যদি তার অন্তরে ঈমান না থাকে, চরিত্রে পবিত্রতা না থাকে—তবে তা ক্ষণিক সৌন্দর্য মাত্র।
আর একজন আল্লাহভীরু নারী—even সাধারণ চেহারার হলেও—তার চেহারায় এক প্রশান্তিময় দীপ্তি থাকে, যা কেবল তাকওয়ার ফল।
ইবনে কাইয়্যিম (রহ.) বলেন:
“হৃদয়ের আলো চেহারায় প্রকাশ পায়, আর তাকওয়ার দীপ্তি গালকে আলোকিত করে।”
🍃 প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর ত্বক বজায় রাখার ইসলামিক টিপস
ইসলাম আমাদের সৌন্দর্যের যত্ন নিতে উৎসাহ দেয়—শর্ত হলো তা যেন হালাল পথে হয়, অহংকার বা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজে ছিলেন পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্যের আদর্শ উদাহরণ। নিচে এমন কিছু সুন্নতি ও হালাল টিপস তুলে ধরা হলো, যেগুলো নিয়মিত চর্চা করলে ইনশাআল্লাহ ত্বক থাকবে দীপ্তিময় ও প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর।
🌿 ১. নিয়মিত গোসল ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা
রাসূল ﷺ সপ্তাহে অন্তত একবার জুমার দিনে গোসল করার উপর জোর দিতেন।
“প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্কের উপর জুমার দিন গোসল করা ওয়াজিব।” 🕌 — সহীহ বুখারি, হাদীস: ৮৭৭
পরিচ্ছন্নতা শুধু বাহ্যিক রূপই বাড়ায় না, বরং ত্বককে ফ্রেশ ও স্বাস্থ্যকর রাখে।
🪥 ২. মিসওয়াক ব্যবহার
মিসওয়াক দাঁতের জন্য সুন্নত হলেও এতে মুখের চারপাশ পরিষ্কার ও সতেজ থাকে। মিসওয়াকে আছে প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপটিক উপাদান, যা ব্রণ ও ফুসকুড়ি কমাতেও সহায়ক।
💧 ৩. অজু ও তাহারাত
প্রতিদিন ৫ বার অজু করার মাধ্যমে মুখ ধোয়া হয়, যা ত্বকের রক্তসঞ্চালন বাড়ায় ও ক্লিনজিং ইফেক্ট রাখে।
“আমার উম্মতের কিয়ামতের দিন আলোকিত মুখ থাকবে, কারণ তারা অজু করত।” 🕌 — সহীহ বুখারি, হাদীস: ১৩৬
🛢️ ৪. প্রাকৃতিক তেল ব্যবহার
হালাল এবং প্রাকৃতিক কিছু তেল রয়েছে যেগুলো সাহাবিরাও ব্যবহার করতেন:
- জয়তুন তেল (Olive Oil): “তোমরা জয়তুন তেল খাও ও তা লাগাও; কেননা তা বরকতময় বৃক্ষ থেকে এসেছে।” 🕌 — তিরমিযি: ১৮৫১
- কালোজিরা তেল: দেহের ভিতর-বাইরের রোগ প্রতিরোধে উপকারী, ত্বকেও এটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল হিসেবে কাজ করে।
🍯 ৫. মধু (Honey) ব্যবহার
মধু প্রাকৃতিক ক্লিনজার ও হিউমেকটেন্ট হিসেবে কাজ করে। ত্বকে সরাসরি লাগানো যেতে পারে ব্রণ ও রুক্ষতা কমাতে।
“মধুতে রয়েছে মানুষের জন্য শিফা।” 📖 — সূরা নাহল: ৬৯
🧴 ৬. হালাল কসমেটিক্স ব্যবহারে সতর্কতা
বাজারে অনেক প্রসাধনীতে অ্যালকোহল বা হারাম উপাদান থাকে। হালাল ও ভেষজ উপাদানযুক্ত প্রসাধনী বেছে নেওয়া উচিত।
🕊️ ৭. দোয়া ও ইবাদতের আলো
অন্তরের নূর চেহারায় প্রকাশ পায়—এটি শুধু আধ্যাত্মিক বিশ্বাস নয়, বরং বাস্তব অভিজ্ঞতাও।
ইমাম শাফিয়ী (রহ.) বলতেন: “আমি যখন গুনাহ কমাতাম, তখন আমার চেহারায় দীপ্তি আসত। আর যখন গুনাহ বাড়ত, তখন মুখ মলিন হয়ে যেত।”
💠 উপসংহার
সৌন্দর্য চাওয়া অপরাধ নয়; বরং তা ফিতরাতজাত স্বাভাবিক চাওয়া। তবে একজন মুসলিম নারীর সৌন্দর্য হবে পর্দার মধ্যে, ইখলাসের আলোতে ভরা, এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গীকৃত। বাহ্যিক রূপচর্চার পাশাপাশি আত্মিক রূপচর্চাই চেহারায় আসল আলো ও প্রশান্তি এনে দেয়।
আসুন, আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি—তিনি যেন আমাদের চেহারা শুধু এই দুনিয়াতেই নয়, বরং কিয়ামতের দিনও উজ্জ্বল রাখেন।