“সত্য এসেছে, আর মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে—নিশ্চয়ই মিথ্যা চিরস্থায়ী হয় না” (সূরা ইসরা, আয়াত ৮১)।
এই আয়াত শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘোষণা নয়, এটি একটি চিরন্তন বাস্তবতা। মানব ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব চলমান—কখনো প্রকাশ্য, কখনো ছলনাময়। কখনো সত্য নিপীড়িত হয়েছে, আবার কখনো তা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে মিথ্যার বুক চিরে। কিন্তু শেষপর্যন্ত আল্লাহর এই ঘোষণা অক্ষয়: সত্য আসলে মিথ্যা টেকে না। আজকের সমাজেও আমরা যখন তথ্য ও বিভ্রান্তির সাগরে ভাসছি, তখন এই আয়াত আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করাই মু’মিনের কাজ, কারণ তা নিজ শক্তিতেই মিথ্যাকে ধ্বংস করতে যথেষ্ট।
এই ব্লগপোস্টে আমরা অন্বেষণ করব এই আয়াতের গভীরতা, এর তাৎপর্য, এবং বাস্তব জীবনে এর প্রভাব। কীভাবে এই আয়াত আমাদের চিন্তা, জীবনযাপন ও সমাজ গঠনে দিকনির্দেশনা দিতে পারে—সেই আলোচনাই হবে আমাদের কেন্দ্রবিন্দু।
সত্য এসেছে, মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে
وَقُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ ۚ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا
“বল: ‘সত্য এসেছে, আর মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে।’ নিশ্চয়ই মিথ্যা তো বিলুপ্ত হবারই।” (সূরা আল-ইসরা: ৮১)
ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে, সভ্যতার প্রতিটি যুগে এক অনিবার্য দ্বন্দ্ব বিরাজমান—সত্য বনাম মিথ্যা। মানুষের বিবেক, সমাজ ও ধর্ম সবসময় এই দ্বন্দ্বের সাক্ষী। আল্লাহ তাআলা কুরআনে এমন এক ঘোষণা দিয়েছেন, যা সময় ও প্রেক্ষাপটকে ছাড়িয়ে চিরন্তন এক নীতি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে: “সত্য এসেছে, মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে।” এই আয়াত শুধু রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সময় নয়, বরং কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির পথনির্দেশ।
আয়াতের প্রেক্ষাপট ও তাফসির
এই আয়াতটি নাজিল হয়েছিল মক্কায়, যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ আল্লাহর আদেশে সত্যের দাওয়াত দিতে থাকেন এবং কাফেরদের মূর্তি পূজাবাদ ধ্বংসের মুখে পড়ে। ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন, এটি এমন একটি ঘোষণা, যা জানিয়ে দেয়—যেখানে সত্যের আলো পৌঁছে, সেখান থেকে মিথ্যার অন্ধকার বিদায় নিতে বাধ্য।
🔹 الْحَقُّ (সত্য) — মানে আল্লাহর বিধান, কুরআনের নির্দেশনা, রাসূলের ﷺ হিদায়াত।
🔹 الْبَاطِلُ (মিথ্যা) — অর্থাৎ শিরক, কুফর, মূর্তিপূজা, ভ্রান্ত দর্শন, বা যেকোনো ভুল চিন্তা ও অন্যায় প্রক্রিয়া।
🔹 زَهَقَ (বিলুপ্ত হওয়া) — অর্থাৎ ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে অন্তত শেষ পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে আয়াতটির আবেদন
এই আয়াতের আবেদন আজও অটুট, বরং আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করার সময় এখন। আজ আমরা তথাকথিত “তথ্যযুগে” বাস করছি, অথচ মিথ্যার বিকৃতি, মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা, মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ, এবং সত্যকে চেপে রাখার বিশ্বব্যাপী চক্রান্ত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।
- সত্য হলো, মানুষকে তার স্রষ্টার দিকে ডাক দেওয়া।
- মিথ্যা হলো, মানুষকে দুনিয়ার মোহ, ভোগবিলাস ও নিজেকে খোদা বানিয়ে নেওয়ার পথে চালিত করা।
- সত্য হলো—তাওহিদ, ইনসাফ, ন্যায় ও হিকমাহ।
- মিথ্যা হলো—শিরক, জুলুম, অন্যায় ও অপপ্রচার।
যখন কেউ কুরআনের আলোয় আলোকিত হয়, তার অন্তরে সত্যের জন্ম হয়, তখন মিথ্যার সব ফাঁদ তার সামনে ধ্বংস হয়ে যায়। একেকটি পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র যখন এই সত্যকে গ্রহণ করে, তখন সেখান থেকে জুলুম, বিভ্রান্তি ও দুর্নীতি নিজেই মুছে যেতে থাকে।
বাস্তব জীবনের কিছু উদাহরণ
- ফিলিস্তিনে প্রতিরোধ আন্দোলন: অস্ত্রের যুদ্ধের পাশাপাশি এটি সত্য-মিথ্যার লড়াই। দুনিয়ার বড় বড় শক্তি মিথ্যার পক্ষে থাকলেও, সত্যের পক্ষে থাকা নিরস্ত্র মানুষের মুখেই বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হয়।
- ব্যক্তি জীবনে হিদায়াত পাওয়া: একজন মানুষ যখন কুরআন পড়ে, দ্বীনের পথে আসে—তার জীবনে অসত্য, পাপ, সঙ্গদোষ, সব একে একে দূর হয়ে যায়।
- ডিজিটাল মিথ্যার যুগে সত্যের প্রচার: যখন কেউ সঠিক ইসলামিক জ্ঞান, কুরআনের ভাষ্য, হাদীসের শিক্ষা ছড়িয়ে দেয়—তখন ভ্রান্ত আকীদা, বিকৃত ইতিহাস ও মনগড়া ধর্মীয় ব্যাখ্যা মানুষ চিনে ফেলতে শুরু করে।
আরো পড়ুন:
সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব: কুরআনিক দৃষ্টিতে একটি চিরন্তন বাস্তবতা
মানব ইতিহাসে সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। হজরত মূসা (আ.) বনাম ফিরআউন, হজরত ইব্রাহিম (আ.) বনাম নমরুদ, রাসূলুল্লাহ ﷺ বনাম কুরাইশ নেতৃবৃন্দ—সবখানেই এই দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু প্রতিবারই সত্যই জয়ী হয়েছে, মিথ্যা ধ্বংস হয়েছে। এই ধারাবাহিকতা শেষ হবে না যতদিন না পৃথিবীর পর্দা নামানো হয়।
মুমিনের দায়িত্ব: সত্যের পতাকা তুলে ধরা
এই আয়াত কেবল ইতিহাস বা দর্শনের আলোচনা নয়—এটি একেকজন মুমিনের কাঁধে দায়িত্ব তুলে দেয়। একজন মুমিন তার চিন্তায়, আচরণে, কথায় এবং সমাজে সত্যের প্রতিনিধিত্ব করবে। সে মিথ্যার সাথে আপস করবে না, বরং সবর, হিকমাহ ও আন্তরিকতার সাথে সত্য প্রচারে জীবন উৎসর্গ করবে।
সত্য প্রতিষ্ঠার পথ সহজ নয়, কিন্তু প্রতিদান অমূল্য
সত্য কখনোই অলসতার মাঝে প্রতিষ্ঠা পায় না। মিথ্যার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানেই পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়া—চরিত্রহনন, নিপীড়ন, নিঃসঙ্গতা এমনকি জীবনহানির আশঙ্কাও থাকে। তবে আল্লাহ তাআলা কুরআনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—যারা তাঁর পথে ধৈর্য ধরে, তাদের সাহায্য তিনি করবেন।
“তোমরা যদি ধৈর্য ধরো এবং তাকওয়া অবলম্বন করো, তবে তাদের চক্রান্ত তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না।” (সূরা আলে ইমরান: ১২০)
এই আয়াত আমাদের শেখায়—সত্য প্রতিষ্ঠার পথে কষ্ট থাকলেও, এর ফলাফল চিরস্থায়ী ও সম্মানজনক।
মিডিয়া ও তথ্যযুদ্ধে সত্যের ভূমিকাঃ মুসলিমদের করণীয়
আজকের পৃথিবীতে “মিথ্যা” প্রচার হয় সুশোভিতভাবে—ফিল্ম, মিডিয়া, সোশ্যাল ন্যারেটিভ, এমনকি শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমেও। এর বিপরীতে “সত্য” অনেক সময় দুর্বল বা প্রান্তিকভাবে উপস্থাপিত হয়।
এমন প্রেক্ষাপটে মুসলিমদের দায়িত্ব হলো—কুরআনের ভাষায়, রাসূলের আদর্শে, এবং যুক্তিসঙ্গত পন্থায় সত্যকে প্রচার করা। সত্যের শক্তিকে প্রমাণ করতে শুধু তর্ক নয়, চরিত্র, প্রজ্ঞা ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। অনলাইনে, বাস্তব জীবনে ও সামাজিক উদ্যোগে মুসলিমদের হওয়া উচিত সত্যের সৈনিক।
উপসংহার
এই আয়াত আমাদের এক সাহসী দৃষ্টিভঙ্গি শেখায়—সত্য প্রচার করো, মিথ্যা নিজে নিজেই বিলুপ্ত হবে। কারণ, মিথ্যার কোনো টেকসই ভিত্তি নেই। তাওহিদের দাওয়াত, ইসলামী জীবনপদ্ধতি ও ন্যায়ের আহ্বান—এসবই সত্যের প্রতীক। তাই কোনো চাপ, ভয় কিংবা সংখ্যার হিসাবের পিছনে না পড়ে আমাদের করণীয় হলো: সত্যকে জানো, নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠা করো, এবং সাহসের সাথে তা প্রচার করো। কারণ আল্লাহ নিজেই আশ্বাস দিয়েছেন:
“নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হবারই।”