মানুষ জন্মগতভাবেই পথের সন্ধানী। জীবনের প্রতিটি মোড়ে, প্রতিটি সিদ্ধান্তে, প্রতিটি ঘোর অন্ধকারে আমরা চাই সঠিক দিকনির্দেশনা—একটা আলো, যা আমাদের নিয়ে যাবে নিরাপদ ও সফল পরিণতির দিকে। এই চাওয়ার গভীরতম রূপই হলো হিদায়াতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা। আর এই চাওয়াকে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত, গভীর ও পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করে যে দোয়া, তা হলো – আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল হুদা :
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْهُدَى
“হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট হিদায়াত প্রার্থনা করছি।”
এই একটি বাক্যে যেন লুকিয়ে আছে জীবনের আসল চাহিদা। হিদায়াত মানে শুধু ধর্মীয় জ্ঞান নয়, বরং জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে, প্রতিটি সম্পর্ক ও করণীয়তে সঠিক পথ বেছে নেওয়ার সেই ক্ষমতা—যা একমাত্র আল্লাহই দিতে পারেন।
এই ব্লগপোস্টে আমরা আলোচনা করবো এই দোয়ার গভীরতা, এর অর্থ, প্রেক্ষাপট, হাদীস ও সাহাবিদের জীবন থেকে এর গুরুত্ব, এবং কীভাবে আমরা এটি আমাদের জীবনের প্রতিদিনের চাওয়ার অন্তর্ভুক্ত করতে পারি।
আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল হুদা । হিদায়াতের প্রার্থনা
এই দোয়ার উৎস ও পরিপূর্ণ রূপ
এই দোয়া একাধিক হাদীসে এসেছে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
রাসূলুল্লাহ ﷺ প্রতিদিন সকালে এই দোয়াটি করতেন:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْهُدَى وَالتُّقَى وَالْعَفَافَ وَالْغِنَى
“হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট হিদায়াত, পরহেযগারিতা, পবিত্রতা ও অমুখাপেক্ষিতা প্রার্থনা করছি।”
📚 [সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২৭২১]

‘হিদায়াত’ মানে কী?
আরবি ‘হুদা’ শব্দটি এসেছে ‘ه-د-ي’ মূলধাতু থেকে, যার অর্থ পথ প্রদর্শন করা।
কিন্তু কুরআনে ‘হিদায়াত’ কেবল একটা দিকনির্দেশনা নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনপথ:
- সঠিক বিশ্বাস
- সৎকর্মের প্রতি আগ্রহ
- গুনাহ থেকে বিরত থাকার প্রেরণা
- ফিতনা-ফ্যাসাদ থেকে বাঁচার অন্তর্দৃষ্টি
- এবং জাহান্নাম থেকে জান্নাতের পথ
কেন হিদায়াত চাওয়াটা এত গুরুত্বপূর্ণ?
- কারণ পথ হারিয়ে ফেলা খুব সহজ: দুনিয়ার প্রলোভন, শয়তানের ধোঁকা, নিজের প্রবৃত্তির খেয়াল—সব মিলিয়ে মানুষ খুব সহজেই সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হতে পারে।
- হিদায়াত ছাড়া আমল গ্রহণযোগ্য হয় না: ঈমান এবং সঠিক পথের দিশা ছাড়া আমল অর্থহীন।
- নবী করিম ﷺ-ও প্রতিনিয়ত হিদায়াত চাইতেন: অথচ তিনি তো সর্বোত্তম হিদায়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন! এটা আমাদের জন্য বড় শিক্ষা—আমরা কখনোই আত্মতুষ্টিতে ভুগতে পারি না।
সাহাবিরা কীভাবে হিদায়াতকে দেখতেন?
🔹 উমর ইবন খাত্তাব (রাঃ) বলতেন: “যদি আমার এক পা জান্নাতে থাকে, আরেক পা বাইরে—তাও আমি নিশ্চিত হব না যতক্ষণ না আমি সম্পূর্ণ প্রবেশ করি।”
(উৎস: ইবন আবি শাইবা)
🔹 আলী (রাঃ) বলতেন: _”হিদায়াত হলো এমন আলোক, যা আল্লাহ যার অন্তরে চান—তাতে প্রবেশ করিয়ে দেন।”
আমাদের জীবনে হিদায়াতের প্রয়োগ
- যখন চাকরি বদলাতে চাই
- যখন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিই
- সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হই
- গুনাহের দ্বিধায় পড়ি
- দ্বীন নিয়ে দ্বিধা জাগে
প্রতিটি সংকটে, প্রতিটি মোড়ে — এই দোয়াটি হোক আমাদের হৃদয়ের নিরব চাওয়া:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْهُدَى
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল হুদা ।
অর্থ : “হে আল্লাহ, আমাকে সঠিক পথ দেখান।”
🌿 শব্দ বিশ্লেষণ: اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْهُدَى
🔸 اللَّهُمَّ
মূল শব্দ: الله (আল্লাহ) اللَّهُمَّ: এটি “يا الله” এর বিশেষ রূপ, যার অর্থ “হে আল্লাহ!”
🔹 মিম (مّ) যুক্ত করে এই শব্দকে দোয়ার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ব্যবহৃত করা হয়।
🔹 এটি আবেগপূর্ণ আহ্বানের বহিঃপ্রকাশ — যেন কারো হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে কেবল একটাই নাম উচ্চারণে: আল্লাহ!
📌 ব্যাকরণিক দিক থেকে: “اللَّهُمَّ” শব্দে ‘يا’ (নিদান/সম্বোধন) লুকায়িত রয়েছে। তাই এটি “يا الله” এরই বিকল্প।
🔸 إِنِّي
মূল: إِنَّ (নিশ্চয়ই) + ي (আমি)
👉 অর্থ: “নিশ্চয়ই আমি”
🔹 ইহা একটি তাওকীদ (জোর দেওয়া) বাক্যরূপ।
🔹 এতে বিনয় প্রকাশ পায় – “আমি আপনার কাছ থেকে কিছু চাইছি, এটা হঠকারিতা নয়, বরং চিন্তিতভাবে, বিনয়ের সাথে…”
🔸 أَسْأَلُكَ
মূল ধাতু: س-أ-ل (প্রশ্ন করা / চাওয়া)
👉 أَسْأَلُكَ = আমি চাই আপনার নিকট থেকে
🔹 أَسْأَلُ: আমি চাই / জিজ্ঞেস করি
🔹 كَ: আপনার (second person masculine singular)
📌 এটি একটি ** فعل مضارع (বর্তমানকালীন ক্রিয়া)**, যা এখানে দোয়ার রূপে ব্যবহৃত হয়েছে – “আমি চাইছি / চেয়ে যাচ্ছি”।
🔹 শব্দটি একান্ত চাওয়া, আশা ও নির্ভরতার প্রকাশ।
🔸 الْهُدَى
মূল ধাতু: هـ-د-ي (পথ দেখানো)
👉 الْهُدَى = সঠিক পথ / হিদায়াত
🔹 এটি একটি مصدر (verbal noun) — যার অর্থ:
“সত্যের দিকে পরিচালনা, সোজা পথ দেখানো, অন্তরের সুস্থতা ও ঈমানের দৃঢ়তা।”
🔹 কুরআনে বহুবার এসেছে:
ذَٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ ۛ فِيهِ ۛ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ
“এই কিতাব সন্দেহহীন, এটি মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াত।” 📖 (সূরা বাকারা: ২)
✨ সারাংশ অনুবাদ ও হৃদয়াবেগ
اللَّهُمَّ – হে আমার রব, হে চির-স্নেহময়!
إِنِّي – আমি, আপনার সেই একান্ত বান্দা,
أَسْأَلُكَ – চাইছি শুধু আপনার নিকট থেকে,
الْهُدَى – সেই পথ যা আপনার দিকে নিয়ে যায়, যা সত্য, যা জান্নাতের পথ…
🎁 একটি ছোট সংমিশ্রণ: ব্যাকরণ + হৃদয়
আরবি | অনুবাদ | ব্যাখ্যা |
---|---|---|
اللَّهُمَّ | হে আল্লাহ! | আহ্বান + আবেগপূর্ণ সম্বোধন |
إِنِّي | আমি তো | নিজেকে বিনয়ের সাথে তুলে ধরা |
أَسْأَلُكَ | আমি আপনার কাছে চাই | বিনয়ী অনুরোধ |
الْهُدَى | হিদায়াত | সত্য পথ, ঈমান, আমল, জান্নাতের দিশা |
আরো পড়ুন:
- আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা হুব্বাকা ওয়া হুব্বা মান ইউহিব্বুক
- আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল হাম্মি।
🌿 হিদায়াতের স্তরভেদ – চারটি প্রধান স্তর
✅ ১. হিদায়াতুল বায়ান (الهداية البيان)
অর্থ: সঠিক পথের জ্ঞান ও ব্যাখ্যা দেওয়া
🔸 এটি সেই স্তর, যেখানে একজন মানুষকে কুরআন, হাদীস, দাওয়াত, উপদেশ, জ্ঞান ইত্যাদির মাধ্যমে সত্যের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
🔸 উদাহরণস্বরূপ, একজন অমুসলিমকে ইসলাম সম্পর্কে জানানো, বা একজন মুসলিমকে হারাম-হালালের জ্ঞান দেওয়া।
📖 আয়াত:
وَأَمَّا ثَمُودُ فَهَدَيْنَاهُمْ فَاسْتَحَبُّوا الْعَمَى عَلَى الْهُدَى
“আর সামূদ জাতিকে আমরা হিদায়াত দিয়েছিলাম, কিন্তু তারা হিদায়াতের পরিবর্তে অন্ধত্বকেই পছন্দ করল।” 📚 সূরা ফুসসিলাত: ১৭
🟠 এই হিদায়াত গ্রহণ করার পরও কেউ যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে পরবর্তী স্তরে পৌঁছায় না।
✅ ২. হিদায়াতুত তাওফীক (الهداية التوفيق)
অর্থ: হিদায়াত অনুযায়ী আচরণ করার তাওফীক দেওয়া
🔹 এটি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। কেউ জ্ঞান পেতে পারে, কিন্তু তাতে আমল করতে পারে না—এজন্য এই তাওফীক জরুরি।
📖 আয়াত:
إِنَّكَ لَا تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَـٰكِنَّ اللَّهَ يَهْدِي مَن يَشَاءُ
“আপনি যাকে ভালোবাসেন, তাকে হিদায়াত দিতে পারবেন না। বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা, তাকে হিদায়াত দেন।” 📚 সূরা কাসাস: ৫৬
🟢 এখানে বুঝা যায়, রাসুল (ﷺ) সত্য দেখিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু কারো অন্তরে সেই সত্যের গ্রহণযোগ্যতা দিতে পারেন না – সেটা একমাত্র আল্লাহর হাতে।
✅ ৩. হিদায়াতুস সাবিল (الهداية السبيل)
অর্থ: পথের বিভিন্ন শাখা ও বিকল্পগুলো চিনিয়ে দেওয়া
🔹 কখনো মানুষ সত্যের পথে আসে, কিন্তু সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়। তখন আল্লাহ তার জন্য সঠিক বিকল্প খোলেন।
📖 আয়াত:
إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا
“আমি তাকে পথ দেখিয়েছি — হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, না হয় অকৃতজ্ঞ।” 📚 সূরা ইনসান: ৩
🟡 এটি মানুষের চয়েসের পরীক্ষা – হিদায়াত দেখানো হয়, কিন্তু সে গ্রহণ করবে কিনা, সেটাই মূল ফয়সালা।
✅ ৪. হিদায়াতুল ইসবাদ (الهداية الإثبات)
অর্থ: হিদায়াতের উপর স্থির রাখা
🔹 অনেকে সঠিক পথে আসে, কিন্তু তাতে স্থির থাকে না। তাই রাসুল (ﷺ) প্রায়ই দোয়া করতেন:
اللَّهُمَّ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ
“হে আল্লাহ! আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের উপর স্থির রাখুন।”
🔹 এই স্তর আল্লাহর এক বিরাট নিয়ামত। বিশেষ করে ফিতনার যুগে।
🟢 সুরা ফাতিহায় যখন আমরা বলি:
اهدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ
তখন আমরা কেবল পথ জানতে নয়, বরং এই পথ ধরে স্থির থাকতে চাই।
✨ সংক্ষেপে চার স্তরের তুলনা টেবিল
স্তর | নাম | অর্থ | উদাহরণ |
---|---|---|---|
১ | হিদায়াতুল বায়ান | সত্য চিনিয়ে দেওয়া | দাওয়াত, জ্ঞান |
২ | হিদায়াতুত তাওফীক | আমলের তাওফীক | নামাজ, তাওবা |
৩ | হিদায়াতুস সাবিল | বিকল্পগুলো চেনানো | হালাল-হারাম বেছে চলা |
৪ | হিদায়াতুল ইসবাদ | স্থিরতা দেওয়া | দ্বীনে টিকে থাকা |
উপসংহার: পথ যদি হিদায়াতের হয়, গন্তব্য জান্নাতই হয়
দুনিয়ায় কেউ যদি হিদায়াত পায়, তবে সে নিঃসন্দেহে সফল। কারণ এই পথই জান্নাতের দিকে যায়। এই পথই আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের পথ। তাই আসুন, প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত এই ছোট্ট অথচ গভীর দোয়াটি হৃদয়ে ধারণ করি, জিহ্বায় জাগিয়ে রাখি, এবং আল্লাহর দিকে একান্ত চাহনিতে বলি:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْهُدَى