মানবজীবনে অনেক সময় এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, যখন সব পথ বন্ধ মনে হয়, সব দরজা যেন তালাবদ্ধ। নিজের চেষ্টা, বুদ্ধি, শক্তি—সবই যেন ব্যর্থ হয়ে পড়ে। ঠিক তখনই একমাত্র আশ্রয় হয় আল্লাহর করুণা, যার হাতে রয়েছে সকল শক্তি ও সম্ভাবনার চাবিকাঠি। এই দুনিয়াতে মানুষ যা ‘অসম্ভব’ ভাবে, তা আল্লাহর কাছে মুহূর্তেই ‘সম্ভব’ হয়ে যেতে পারে। অসম্ভব কিছু সম্ভব করার দোয়া নামে যদিও কোনো কিছু নেই। তবে আল্লাহ চাইলে সবকিছু সম্ভব হবে।
কুরআন ও হাদীসে এমন বহু দোয়া ও ঘটনা রয়েছে, যেখানে মানুষ চরম দুর্দশা ও অসহায় অবস্থায় আল্লাহর কাছে চেয়েছে — আর আল্লাহ তাদের সেই ‘অসম্ভব’ চাওয়া পূরণ করে দিয়েছেন। তাই জীবনের যেকোনো জটিলতা, ব্যর্থতা, অসাধ্য কাজ বা অসম্ভব স্বপ্ন পূরণের জন্য আমাদের প্রথম করণীয় হলো আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া এবং অন্তরের গভীর থেকে তাঁর সাহায্য কামনা করা। এই ব্লগপোস্টে আমরা এমন কিছু কার্যকর ও প্রমাণিত দোয়ার সাথে পরিচিত হবো, যেগুলোর মাধ্যমে আপনি নিজের অসম্ভব কাজগুলোকেও আল্লাহর রহমতে সম্ভব করে তুলতে পারেন, ইন শা আল্লাহ।
অসম্ভব কিছু সম্ভব করার দোয়া
দুনিয়ার কোনো কাজই আসলে আল্লাহর জন্য কঠিন নয়। যে আল্লাহ পানিকে কঠিন বরফে রূপান্তর করেন, আবার সেই বরফকেই বাষ্প বানিয়ে আকাশে উড়িয়ে দেন — তাঁর জন্য কোনো কাজেই ‘অসম্ভব’ বলে কিছু নেই। নিচে কিছু দোয়া, কুরআনিক আয়াত ও বাস্তবিক আমল উল্লেখ করা হলো, যেগুলো নিয়মিত পাঠ ও আমলের মাধ্যমে একজন মুমিন তাঁর ‘অসম্ভব’ সমস্যারও সমাধান পেতে পারেন, ইন শা আল্লাহ।
🌿 ১. ইউনুস (আ.) এর দোয়া — দুঃসময়ে মুক্তির জন্য
আরবি:
لَا إِلَـٰهَ إِلَّا أَنتَ سُبْحَـٰنَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ ٱلظَّـٰلِمِينَ
উচ্চারণ: Lā ilāha illā anta subḥānaka innī kuntu minaẓ-ẓālimīn
অর্থ: “আপনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই; আপনি পবিত্র; নিশ্চয়ই আমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম।” 📖 সূরা আল-আম্বিয়া: ৮৭
✅ ফজিলত: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
“তোমরা তোমাদের দুঃখ-কষ্টে ইউনুস (আ.) এর দোয়া পাঠ করো।” 📚 তিরমিযি: ৩৫০৫

🌿 ২. هَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ – কঠিন পরিস্থিতিতে নির্ভরতার দোয়া
আরবি:
حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ
উচ্চারণ: Hasbunallāhu wa ni‘mal-wakīl
অর্থ: “আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট, এবং তিনি কতই না উত্তম কাজের দায়িত্ব গ্রহণকারী।” 📖 সূরা আলে ইমরান: ১৭৩
✅ ফজিলত: এই দোয়া সাহাবায়ে কেরাম যুদ্ধের ভয়াবহ মুহূর্তেও পড়েছেন এবং বিজয় অর্জন করেছেন।
🌿 ৩. سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ – প্রশংসা ও রহমতের চাবিকাঠি
আরবি:
سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ، سُبْحَانَ اللَّهِ الْعَظِيمِ
উচ্চারণ: Subḥānallāhi wa biḥamdi, subḥānallāhil-‘aẓīm
অর্থ: “আল্লাহ পবিত্র এবং তাঁর জন্যই সব প্রশংসা, তিনি মহামহান।”
✅ ফজিলত: রাসূল (সা.) বলেন,
“এই দুই বাক্য আল্লাহর কাছে প্রিয়, এবং এগুলোর দ্বারা গুনাহ মাফ হয়।” 📚 বুখারী: ৬৪০৬
🔹 এই দোয়াটি একাধারে গুনাহ মাফ, দুঃখ মোচন এবং জীবনের জটিল সমস্যার সমাধানে বিশেষ কার্যকর।
🌿 ৪. استخارة বা ইস্তিখারা – দিকনির্দেশনা ও সিদ্ধান্তের দোয়া
যখন আপনি এমন এক সমস্যায় পড়েন যার কোন সমাধানই দেখছেন না, তখন সালাতুল ইস্তিখারা করে আল্লাহর কাছে দিকনির্দেশনা চাইতে পারেন।
ইস্তিখারার দোয়া পড়ার মাধ্যমে আল্লাহ আপনাকে সবচেয়ে ভালো ও কল্যাণকর পথ দেখাবেন।
✅ বিস্তারিত পড়ুন: [ইস্তিখারা বিষয়ক পোস্ট] (আপনার ব্লগে আলাদা পোস্ট লিংক থাকলে সংযুক্ত করতে পারেন)
🌿 ৫. “يا حي يا قيوم” – জীবন ও শক্তির দাতা আল্লাহর নামে আহ্বান
আরবি:
يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ، بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيثُ، أَصْلِحْ لِي شَأْنِيَ كُلَّهُ، وَلَا تَكِلْنِي إِلَى نَفْسِي طَرْفَةَ عَيْنٍ
উচ্চারণ: Yā ḥayyu yā qayyūmu, biraḥmatika astaghīth, aṣliḥ lī sha’ni kullah, wa lā takilnī ilā nafsī ṭarfata ‘aynin
অর্থ: “হে চিরঞ্জীব, হে সবকিছুর রক্ষণাবেক্ষণকারী! আপনার রহমতের মাধ্যমে আমি আপনার সাহায্য প্রার্থনা করছি। আমার সব বিষয় আপনি ঠিক করে দিন। এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে আমার নিজের উপর ছেড়ে দেবেন না।” 📚 হাকিম, মিশকাত: ২৪৫৮
✅ ফজিলত: দৈনিক এই দোয়া পড়লে আল্লাহ আপনার জীবনের প্রতিটি কঠিন দিক সহজ করে দেবেন।
🔐 অতিরিক্ত কিছু করণীয় (ব্যবহারিক দিক থেকে):
- নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ুন। এই সময় আল্লাহ নিজেই জিজ্ঞেস করেন কে সাহায্য চায়।
- সদকা বা দান করুন — দোয়ার কবুলে এটি খুবই উপকারী।
- নিজের দোয়ায় তাওবাহ ও নাম ধরে আল্লাহর গুণবাচক নাম ব্যবহার করুন, যেমন:
- ইয়া রাহিম (হে পরম দয়ালু)
- ইয়া ফাত্তাহ (হে সব দ্বার খুলে দেয়ার মালিক)
- ইয়া মুজীব (হে দোয়া কবুলকারী)
🕋 (১) প্রাসঙ্গিক কুরআন আয়াত ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ
🔹 আয়াত ১: “আমার রব যথেষ্ট; তিনিই উত্তম কর্মবিধানকারী।”
قُلْ حَسْبِيَ ٱللَّهُ ۖ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ ۖ وَهُوَ رَبُّ ٱلْعَرْشِ ٱلْعَظِيمِ
📖 সূরা আত-তাওবা: ১২৯
বাংলা অনুবাদ: “বলুন, আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট; আমি তাঁরই উপর ভরসা করি, আর তিনি মহান আরশের অধিপতি।”
🔍 ব্যাখ্যা: যখন মানুষ অসহায়, এবং দুনিয়ার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় — তখন এই আয়াত একজন মুমিনের আত্মবিশ্বাস ও ভরসার উৎস হয়ে দাঁড়ায়। এতে শেখানো হচ্ছে যে, আল্লাহর উপর ভরসা করলে মানুষ কখনো হতাশ হয় না।
🔹 আয়াত ২: “তিনি কোনো কিছুর ইচ্ছা করলে বলেন, ‘হয়ে যাও’, আর তা হয়ে যায়।”
إِنَّمَآ أَمْرُهُۥٓ إِذَآ أَرَادَ شَيْـًٔا أَن يَقُولَ لَهُۥ كُن فَيَكُونُ
📖 সূরা ইয়াসিন: ৮২
বাংলা অনুবাদ: “তিনি যখন কিছু চান, তখন কেবল বলেন, ‘হও’, আর তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়।”
🔍 ব্যাখ্যা: এটি আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার সর্বোচ্চ ঘোষণা। আপনি যতই বড় সমস্যায় থাকুন না কেন, আল্লাহর “كن” (হও) বললেই তা বাস্তবে রূপ নেয়। আমাদের কাজ হলো সেই ‘كن’ পাওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করা।
🔹 আয়াত ৩: “আল্লাহ যার জন্য চান রিজিক দেন, কোনো হিসাব ছাড়াই।”
وَيَرْزُقُهُۥ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ ۚ وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى ٱللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ
📖 সূরা আত-তালাক: ৩
বাংলা অনুবাদ: “আল্লাহ তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না। আর যে আল্লাহর উপর ভরসা রাখে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট।”
🔍 ব্যাখ্যা: জীবনের অনেক সময় এমন কিছু ঘটে যায় যা আমরা চিন্তাও করিনি। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে “বিয়ন্ড এক্সপেকটেশন” সাহায্যের নমুনা। অসম্ভব রকমের দরজা তিনি খুলে দিতে পারেন।
📖 (২) বাস্তব কাহিনি ও হাদীসভিত্তিক ঘটনা
✅ কাহিনি ১: মুসা (আ.) এর সামনে সাগর, পেছনে ফেরাউন!
📖 সূরা আশ-শু’আরা: ৬১-৬৩
যখন ফেরাউনের সেনাবাহিনী পেছনে, আর সামনে বিশাল সাগর — তখন বনি ইসরাইল বলে ফেলেছিল:
“আমরা তো এখন ধরা পড়েই গেছি!”
মুসা (আ.) তখন বললেন:
كَلَّا إِنَّ مَعِيَ رَبِّي سَيَهْدِينِ
“না, আমার সঙ্গে আমার রব আছেন, তিনি আমাকে পথ দেখাবেন।”
🎯 ফলাফল: আল্লাহ সাগরকে দুই ভাগ করে দিলেন — অসম্ভব একটি ঘটনা বাস্তবে সম্ভব হয়ে গেলো!
✅ কাহিনি ২: মারইয়াম (আ.) এর খেজুর গাছ ঝাঁকানো
📖 সূরা মারইয়াম: ২৩-২৬
গর্ভবতী মারইয়াম (আ.) যখন সন্তান প্রসবের সময় দুঃখে কাতর, তখন আল্লাহ বললেন:
“তোমার পায়ের নিচে ঝর্ণা, আর খেজুর গাছ নাড়িয়ে দাও — তা থেকে পাকা খেজুর পড়বে।”
🎯 শিক্ষা: একজন নারী যখন অসহায় ও নির্জনে ছিলেন, তখন আল্লাহই তাঁর জন্য পানীয়, খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলেন। শর্ত ছিল — চেষ্টা করো (গাছ নাড়াও), বাকি ব্যবস্থা আমি নেবো। এটাই তাওয়াক্কুল।
✅ হাদীস: রাসূল (সা.) এর দোয়া – তায়েফের দুঃখে কাঁদা মুহূর্তে
তায়েফে যখন নবীজি (সা.) কে পাথর মেরে রক্তাক্ত করা হয়, তিনি একটি হৃদয়বিদারক দোয়া করেন:
“হে আল্লাহ! আমি আমার দুর্বলতা, মানুষের কাছে আমার অবমূল্যায়ন, এবং আমার অসহায়ত্ব তোমার কাছে ফরিয়াদ করছি…” 📚 ইবন হিশাম
🎯 ফলাফল: জিবরাঈল (আ.) এসে বললেন, “চাইলে এই জাতিকে ধ্বংস করে দেবো।”
নবীজি বললেন, “না, আমি চাই তারা একদিন মুসলিম হয়ে যাক।”
🔸 কিছু বছর পর, তায়েফের লোকরাই মুসলিম হয়ে আসে।
✅ উপসংহার
অসম্ভব কিছু সম্ভব করার দোয়া: মানুষের চোখে অনেক কিছু অসম্ভব হলেও, আল্লাহর ইচ্ছায় তা মুহূর্তেই বাস্তবে রূপ নেয়। আমাদের করণীয় হলো – ধৈর্য, ইখলাস ও বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করা। তাঁর কাছে চাওয়া মানেই সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাওয়া। সুতরাং আপনার জীবনে যত ‘অসম্ভব’ কাজই থাকুক না কেন, আল্লাহর কাছে মাথা নত করে কিছু দিন কান্না করে চেয়ে দেখুন — নিশ্চয়ই আপনি চমকে যাবেন তাঁর কুদরতের নিদর্শন দেখে।