প্রবাদ বাক্য—ছোট হলেও এর প্রভাব বিশাল। প্রতিদিনের কথোপকথনে, গল্পে কিংবা পরামর্শে আমরা প্রায়ই এমন কিছু বাক্য ব্যবহার করি, যেগুলো হয়তো শুনতে মজার, কিন্তু গভীরে লুকিয়ে থাকে বাস্তব জীবনের তিক্ত মিষ্টি অভিজ্ঞতা। “বিনা মেঘে বজ্রপাত”, “চোরের মার বড় গলা”, কিংবা “আপনি বাঁচলে বাপের নাম”—এইসব বাক্য আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির এক অনন্য রসিক প্রকাশ। মজার এসব প্রবাদ বাক্য শুধু হাসির খোরাকই নয়, বরং এগুলো জীবন নিয়ে ভাবার এক চমৎকার উপায়ও বটে।
এই ব্লগপোস্টে আমরা এমন কিছু জনপ্রিয় ও মজার প্রবাদ বাক্য তুলে ধরব, যেগুলোতে একদিকে যেমন হাসি লুকিয়ে আছে, অন্যদিকে তেমনি আছে গভীর জীবনবোধ। চলুন, হালকা হাসির ফাঁকে ফাঁকে চিন্তার খোরাকও একটু নিয়ে নেওয়া যাক!
১ ০টি ভিন্ন বিষয় মোট ১০০টি মজার প্রবাদ বাক্য
১. আত্মপ্রতারণা ও অজুহাত
জীবনে কিছু মানুষ থাকে, যারা নিজের ভুলও এমনভাবে সাজায় যেন অন্যরাই দোষী! এরা নিজের ঠকেও বুদ্ধিমান সেজে থাকে। বাংলার প্রবাদে এসব লোকজনদের জন্য কিছু গা-চুলকানো কথাবার্তা বেশ ভালোভাবেই ঢুকেছে।
- নিজের চোখে রঙ মেখে অন্যের দোষ খোঁজা।
- মুখে রাম রাম, বগলে ছুরি।
- চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।
- নিজের পায়ে কুড়াল মারা।
- খাই খাই, আবার রোগও চাই।
- কাককে স্নান করিয়ে গয়না পরালে কাকই থাকে।
- বাঘে ধরলে ছেড়ে দেয়, শেয়ালে ধরলে ছাড়ে না।
- নিজের পিঠে নিজেই হাত বোলানো।
- গাধাকে ঘোড়া সাজালেও ল্যাজ থাকে।
- পেটে লাথি, মুখে মুচকি হাসি।

২. অলসতা ও টালবাহানা
“আজ না, কাল করব”—এই দলটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। কাজের সময় পায় না, আর গল্পে গলা শুকায় না। বাংলার প্রবাদে অলসদের নিয়ে আছে অসাধারণ সব খোঁচা!
- কাল করবি আজ কর, আজ করবি এখন।
- পড়ে না পিত্তি, দৌড় দেয় পেঁটে।
- কাজে না বার, কথা বারবার।
- ঘরে বসে বাঘ মারা।
- গাছের তলায় বসে ফলের আশায়।
- মুখে বড়, কাজে ছোট।
- অলসের দশ পা, পরিশ্রমীর এক পা।
- শুয়ে শুয়ে বাঘের স্বপ্ন।
- ছায়ায় বসে রোদে ভাজা খাবার চাওয়া।
- কাজের নাম গন্ধ নেই, ভাব এমন যেন মহাযজ্ঞ!
৩. অহংকার ও গর্ব
একটু কিছু শিখলেই ভাব নেয়, যেন পৃথিবী উনি বানিয়েছেন। অহংকারীদের নিয়ে বাংলার প্রবাদের ঝুলিতে মজার সব ব্যঙ্গ বিদ্যমান। ছোট মানুষ বড় ভাব ধরলেই প্রবাদ বেঁধে বসে।
- মাটির হাঁড়ি, সোনার ঢাকনা।
- ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।
- নিজের গুণে না, অন্যের গুণে গর্ব।
- নিজের চুলা না জ্বলে, অন্যের ভাত পোড়ায়।
- কাঁকড়া নিজের হাঁটুর কথা বোঝে না।
- পুঁটি মাছ, রাজা সাজা।
- অনেক ধ্বনি, কিন্তু কাজের কিছু নেই।
- হাঁসের মত হাঁটা শিখে নিজেকে রাজহাঁস ভাবা।
- কাঁচা পাকা দাঁত, কিন্তু ভাষণ মহাবিশ্বে!
- পুঁটি মাছের গায়ে সোনার আঁশ।
৪. ধূর্ততা ও ছলনা
চালাকির মোড়কে অনেকেই মানুষের অনুভূতি নিয়ে খেলে। কেউ শিয়াল, কেউ কুমির! কিন্তু বাংলার প্রবাদ ঠিকই ধরে ফেলেছে—কে ধূর্ত, কে শুধুই নাটক!
- শিয়াল পণ্ডিত হলেও মুরগি খায়।
- তেল দিলে গাধাও নাচে।
- এক বাঘে বন যায়, এক শিয়ালে ফসল।
- সামনে মিষ্টি, পেছনে বিষ।
- চালাক শিয়ালের সাত গর্ত।
- সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।
- কাঁঠালের আমসত্ত্ব!
- ছাগল তাড়াতে বাঘ ডাকা।
- ঝোপ বুঝে কোপ মারা।
- ঘুঘু দেখেছো, ঘুঘুর ফাঁদ দেখো নাই!

৫. দারিদ্র্য ও কপাল
“কপালে না থাকলে আমও টক লাগে”—এই কথাটা শুধু প্রবাদ না, একটা বাস্তবতা! জীবনের দুঃখ, কপালের পোড়া, আর ভাগ্যের খেলা—সব কিছুই উঠে এসেছে আমাদের প্রবাদের ছাঁচে।
- গরীবের ধানেও শকুনের নজর।
- কপালে না থাকলে ঘি খেলে ডায়রিয়া।
- ভাগ্যে থাকলে বৃষ্টি দিনেও রোদ পাবে।
- নুন আনতে পান্তা ফুরায়।
- কপালে যদি না থাকে, পাকা আমও গাছে পচে।
- কাঁথা নেই, পায়ে দড়ি বাঁধি।
- চালে কানা, ডালে কানা, সবই কপালের দোষ।
- সোনার হাঁসও গরীবের পুকুরে ডিম দেয় না।
- কপাল পোড়া গরুর পেছনেও সিং নেই।
- হাতে গোনা টাকা, তবু বিয়ে পাকা!
৬. ভান ও লোক দেখানো আচরণ
লোক দেখানো ভদ্রতা আর ভেতরের পচন—এমন ভণ্ডামি সমাজে অহরহ দেখা যায়। এই দ্বিচারী চরিত্রদের নিয়ে বাংলা প্রবাদ মজার ছলে একেবারে খোলস উল্টে দিয়েছে।
- কলসী যত বেশি ভর্তি, তত কম বাজে।
- বাইরে ঝকঝকে, ভেতরে তকতকে নয়।
- মুখে সরষে, মনে বিষ।
- চাঁদ মুখো, চরিত্র পঁচা।
- বাঁশের ভিতর কুত্তা!
- পাকা বাঁশে কচি লতা।
- অন্ধের হাতিতে হাত বোলানো।
- ঝিনুক দেখেই মুক্তা ভাবা।
- গুড়ের মিছরি, ভিতরে বিষ।
- সোনা দানা নয়, মাটির কানা!
৭. সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব
বন্ধু ও শত্রুর মাঝখানে আজকাল খুব পাতলা একটা দেয়াল! কার মুখে হাসি, আর কে পেছনে ছুরি মারবে—তা বোঝা ভার। এ নিয়ে বাংলার প্রবাদগুলো কখনো সরস, কখনো তিক্ত, আবার কখনো নিখাদ সত্য।
- শত্রু মারতে গাছে বন্ধুর ঘর জ্বালানো।
- বন্ধুর মুখে চুনকালি।
- খেলার ছলে কিল মার।
- আপন গরজে বন্ধু চেনা যায়।
- চোর চোর মাসতুতো ভাই।
- সামনে মধু, পেছনে ছুরি।
- এক হাড়ির ভাত খেলে সম্পর্ক পাকা।
- সাপ ও ব্যাঙ এক ঘাটে জল খায় না।
- কুমিরের চোখের জল!
- শত্রু পেছনে হাসে, বন্ধু সামনেই খোঁটা দেয়।
৮. দাম্পত্য ও প্রেম
ভালোবাসা আর দাম্পত্য—যেখানে মিষ্টি ও ঝাল দুটোই থাকে। প্রেমের আবেগে যেমন হাসি, তেমনি বিয়ের পর আসে বাস্তবতা। এসব নিয়েও বাংলা প্রবাদ কিন্তু কম যায় না!
- বউ কথা কও না, চাল নিই।
- বউ পেটা স্বামীর ভাগ্য ভালো!
- ঝগড়া নয় প্রেমের আলামত।
- বউ রান্না করে না, তবু প্রশংসা করে জামাই।
- প্রেম করিলে গরীব, বিয়ে করিলে ফকির।
- প্রেমে পড়লে মানুষ চাঁদে যায়।
- হাসি মুখে বিষ ঢালা।
- রোমিও Juliet না খেয়ে মরে নাই।
- প্রেমের বেলুন, হাওয়া গেলে শূন্য।
- একে প্রেম, তার উপর শ্বাশুড়ির আদর!
৯. অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা
জীবনে কেউ ভুল না করলে শেখে না—এটাই সত্য। যন্ত্রণার আগুনেই অভিজ্ঞতার ছাই জমে। বাংলার প্রবাদ সেই অভিজ্ঞতাগুলোকেই হাস্যরসে জড়িয়ে সামনে এনেছে।
- আগুনে পুড়লে পানি চিনে।
- একবার ঠকে, বারবার শেখে।
- পাকা ধানে মই চলবে না।
- যার জ্বলে, সে বোঝে।
- ছাই চাপা আগুন।
- গাছতলায় পড়ে তবেই শেখে মানুষ।
- অভিজ্ঞতা শিক্ষক, ফি লাগে না।
- মাছ ধরা শিখে কাঁটা বেছে খায়।
- নাক কেটে যশ বাঁচানো।
- আগুন খেললে হাত পুড়ে।
১০. অবিশ্বাস্য ঘটনা বা কৌতুকপূর্ণ বাস্তবতা
কখনো এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা বিশ্বাস করাও কঠিন—তবে বাস্তব! কেউ হাঁসে, কেউ ভাবে মজা! এসব অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক ব্যাপারগুলোর জন্য বাংলার প্রবাদ নিজেই যেন এক বিশেষ হাসির রঙে রঙিন।
- হাঁসও আজকাল ডিম চুরি করে।
- কাক জল খায় না, গলা ভিজে।
- গরু উড়লো তো?
- পিঁপড়ে বাঘ খায়, স্বপ্নে!
- বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
- সিঁড়ি না পেয়ে বাঁশ বেয়ে ওঠা।
- হাঁপানির রোগী দৌড় প্রতিযোগিতায়!
- ঘরের বিড়াল সিংহ সাজা।
- কলার খোসায় পড়ে যাওয়া বুদ্ধিমান।
- বোকার বিয়ে, হরিণের সাথে!
🪔 উপসংহার
বাংলা ভাষা যেমন মধুর, তেমনি এর প্রবাদ বাক্যগুলোও তীক্ষ্ণ ও মজার। কখনো ঠাট্টায়, কখনো গম্ভীর বার্তায়, আবার কখনো খোঁচায়—এই প্রবাদের জগতে যেন জীবনের প্রতিটি দিকের প্রতিচ্ছবি লুকিয়ে আছে। এদের অনেকগুলো শুনলে প্রথমে হাসি পেলেও, ভেবে দেখলে দেখা যায়, সবকটাই জীবনের একেকটা চমৎকার পাঠ।
এগুলো শুধু মুখে মুখে প্রচলিত বচন নয়, বরং শতাব্দীর অভিজ্ঞতা, লোকজ বুদ্ধি আর সামাজিক পর্যবেক্ষণের এক অনবদ্য সংকলন।
তাই এবার থেকে কেউ যদি বলে—”প্রবাদে কিছু নেই”, তাহলে সরাসরি বলে দিও—
“না খেয়ে মরলেও, মুখে প্রবাদ থাকে!” 😄
❓আপনার প্রিয় প্রবাদ বাক্য কোনটি?
কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না।
আর ভালো লাগলে শেয়ার করে আপনার বন্ধুকেও একটু হাসান!
আপনার ভালো লাগতে পারে এমন কিছু উক্তি