ইসলামে তাহাজ্জুদ নামাজ একটি বিশেষ নফল নামাজ, যা রাতের নির্জন সময়ে আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলার এক অনন্য সুযোগ এনে দেয়। এটি ছিল আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ ﷺ-এর অভ্যাস, যিনি নিয়মিতভাবে এই নামাজ আদায় করতেন এবং তাঁর উম্মতদেরও তা করার উৎসাহ দিয়েছেন। এই ব্লগপোস্টে আমরা জানবো – তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম – সময়, নিয়ত, কত রাকাত, কিভাবে পড়তে হয়, এবং এ নামাজের ফজিলত ও উপকারিতা—সবকিছু স্টেপ বাই স্টেপ।
তাহাজ্জুদ নামাজে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি, দোয়া ও আত্মসমর্পণ যেমন থাকে, তেমনি এতে আত্মশুদ্ধির এক অসাধারণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যাদের হৃদয় আল্লাহর ভালোবাসায় সিক্ত, তাহাদের জন্য এই নামাজ এক পরম প্রিয় সাধনা।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম (Step by Step Guide)
🕰️ ১. তাহাজ্জুদের সময়
তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার সময় হলো রাতের শেষ তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ রাতের মাঝামাঝি থেকে ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত। তবে উত্তম সময় হলো রাতের শেষ ভাগে, যখন মানুষ গভীর ঘুমে থাকে আর চারদিক নীরবতায় ডুবে থাকে।
📌 টিপস: ঘুমানোর আগে দুই রাকাত তাহাজ্জুদের নিয়তে ঘুমানো যেতে পারে, পরে ঘুম ভাঙলে তা আদায় করা সহজ হয়।
🧼 ২. পবিত্রতা ও প্রস্তুতি
- ওযু করে নিন (পবিত্র থাকা আবশ্যক)
- সম্ভব হলে মিসওয়াক করুন
- নেক পোশাক পরুন এবং একান্তে নির্জন স্থানে নামাজ পড়ুন

🕋 ৩. নিয়ত (Intention)
তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য আলাদা কোনো মুখের নিয়ত নেই, অন্তরে শুধু এই ধারণা থাকলেই যথেষ্ট:
“আমি আল্লাহর জন্য তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করছি”
🙌 ৪. নামাজ শুরু করা (তাকবিরে তাহরিমা)
- তাকবির বলে (আল্লাহু আকবার) নামাজ শুরু করুন
- কিয়ামের অবস্থায় নাভির উপরে হাত বাঁধুন
- সানা পড়ুন, তারপর সূরা ফাতিহা ও কুরআনের আরেকটি সূরা তিলাওয়াত করুন
🔁 ৫. রাকাত সংখ্যা
🙇 ৬. রুকু, সিজদা ও বৈঠক
একটি রাকাতের নিয়ম ঠিক ফরজ নামাজের মতো:
- রুকু (নত হওয়া)
- সিজদা (সেজদা করা)
- বৈঠক (তাশাহহুদে বসা)

🌙 ৭. বিতর নামাজ
তাহাজ্জুদের পর বিতর নামাজ পড়া সুন্নত। আপনি চাইলে তাহাজ্জুদের শেষে ১, ৩, বা ৫ রাকাত বিতর নামাজ আদায় করতে পারেন।
🤲 ৮. দোয়া ও কান্নাকাটি
তাহাজ্জুদের পর দোয়া কবুলের সম্ভাবনা অনেক বেশি। দোয়ার সময় আপনার যা প্রয়োজন আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে চাইতে পারেন।
“হে আল্লাহ! তুমি আমার গুনাহ মাফ করে দাও, আমার রিজিক বৃদ্ধি করো এবং আমাকে হেদায়াত দাও।”
✨ তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত
📖 কুরআন ও হাদিসে তাহাজ্জুদের অনেক ফজিলতের কথা বলা হয়েছে। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য ফজিলত দেওয়া হলো:
- আল্লাহ বললেন:
“রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ো; এটা তোমার জন্য নফল। যাতে তোমার রব তোমাকে প্রশংসনীয় অবস্থানে তুলে নেন।” (সূরা বনি ইসরাইল: ৭৯)
- রাসূল ﷺ বলেন:
“তোমরা রাতে নামাজ পড়ো, কেননা রাতের নামাজ নেক লোকদের অভ্যাস, যা তোমাদের রবের নৈকট্য, পাপ মোচন, গোনাহের প্রায়শ্চিত্ত এবং দেহকে রোগ থেকে মুক্ত করে।” (তিরমিজি, হাদিস ৩৫৪৯)
✅ সংক্ষেপে তাহাজ্জুদ নামাজের ধাপসমূহ (ইংরেজিতে)
- Make Wudu (Ablution)
- Pray 2 Rak’ahs (at least)
- Recite Surah Al-Fatiha and another Surah
- Ruku, Sujud, and Tashahhud
- Repeat 2 Rak’ahs as you can
- End with Witr Prayer
- Make Du’a with sincerity
🕌 তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত
✅ নিয়তের প্রকৃতি
নিয়ত মূলত অন্তরের ইচ্ছা ও সংকল্পের নাম। মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা ফরজ বা ওয়াজিব নয়। বরং কেউ যদি অন্তরে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার সংকল্প করে—তবে সেটিই যথেষ্ট।
📌 নবী ﷺ কিংবা সাহাবায়ে কেরাম থেকে মুখে নিয়ত পাঠ করার কোনো দলিল নেই। এটি পরবর্তীতে প্রচলিত হয়েছে, কিন্তু আবশ্যক নয়। বরং কিছু আলেম মুখে উচ্চারণ করাকে বিদআত হিসেবে দেখেছেন।
🟢 তবুও শেখার সুবিধার্থে অনেকে নিচেরভাবে শেখেন:
আরবি নিয়ত (শিক্ষামূলক):
نَوَيْتُ أَنْ أُصَلِّيَ لِلَّهِ تَعَالَى رَكْعَتَيْنِ صَلَاةَ التَّهَجُّدِ سُنَّةً لِلَّهِ تَعَالَى
বাংলা উচ্চারণ: নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা রাকআতাইনি সালাতাত-তাহাজ্জুদি সুন্নাতাল্লিল্লাহি তা’আলা
বাংলা অর্থ: “আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাহাজ্জুদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করার নিয়ত করলাম।”
⚠️ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা:
- মুখে নিয়ত বলা জরুরি নয়, বরং হৃদয়ে তাহাজ্জুদের ইচ্ছা করলেই নামাজ সহীহ হয়।
- যারা নতুন শিখছেন, তারা মুখে পড়তে পারেন শিক্ষার জন্য, কিন্তু এটাকে বাধ্যতামূলক মনে করা যাবে না।
- নিয়ত আসলে এমন এক জিনিস যা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ইবাদতের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে।
🧠 সংক্ষেপে মনে রাখুন:
“নিয়ত হৃদয়ের বিষয়, মুখের নয়।”
🤲 তাহাজ্জুদ নামাজের পর দোয়া
তাহাজ্জুদের পর ইচ্ছেমতো দোয়া করা যায়। রাতের এই নিঃশব্দ মুহূর্তে আল্লাহ দোয়া কবুল করেন বলে বহু হাদিসে উল্লেখ আছে।
✅ সহজ কিছু দোয়া (আরবি, বাংলা উচ্চারণ ও অর্থসহ):
১. গুনাহ মাফের দোয়া
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي ذُنُوبِي كُلَّهَا
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাগফির লি যুনূবি কুল্লাহা
অর্থ: হে আল্লাহ! আমার সব গুনাহ ক্ষমা করে দিন।
২. হেদায়াত ও স্থিতির দোয়া
اللَّهُمَّ يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইয়া মুকাল্লিবাল কুলূবি সাব্বিত ক্বালবি আলা দীনিক
অর্থ: হে অন্তর পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনে স্থির রাখুন।
৩. রিজিক ও কল্যাণের জন্য দোয়া
اللَّهُمَّ اكْفِنِي بِحَلَالِكَ عَنْ حَرَامِكَ وَأَغْنِنِي بِفَضْلِكَ عَمَّنْ سِوَاكَ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাকফিনী বিহালালিকা ‘আন হারামিকা, ওয়া আগনিনী বিফাদলিকা ‘আম্মান সিওয়াক
অর্থ: হে আল্লাহ! আমাকে হালাল দ্বারা হারাম থেকে বাঁচান, এবং নিজের অনুগ্রহে আমাকে তোমার ছাড়া অন্যের মুখাপেক্ষী না করো।
৪. সাহাবিদের দোয়া (উমর রা. থেকে)
اللَّهُمَّ اجْعَلْ أَعْمَالِي كُلَّهَا صَالِحًا وَلِوَجْهِكَ خَالِصًا، وَلَا تَجْعَلْ فِيهِ شَيْئًا لِغَيْرِكَ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাজআল আ’মালি কুল্লুহা সালিহা, ওয়া লিওয়াজহিকা খালিসা, ওয়ালা তাজআল ফিহি শাইআলিগাইরিকা
অর্থ: হে আল্লাহ! আমার সব আমলকে নেক করো, শুধু তোমার জন্য খালেস করো, এবং তাতে যেন কারো জন্য কিছু না থাকে।

🌙 গল্প ১: রাতের তাহাজ্জুদ, সকালের চাকরি!
আসিফ আহমেদ, ২৭ বছর, ঢাকা
“আমি প্রায় ৮ মাস ধরে চাকরি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। এক বন্ধু বলল, ‘তুই রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ শুরু কর।’ শুরুতে একটু কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু ২ রাকাত তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর কাছে কেঁদে দোয়া করতাম। বিশ্বাস করুন, ১৫ দিনের মাথায় এমন একটা চাকরি পেয়ে গেলাম, যা আমার কল্পনাতেও ছিল না। এখন আমি প্রতিদিন অন্তত ২ রাকাত তাহাজ্জুদ পড়ি—শুধু চাই আল্লাহ যেন আমাকে ভুলে না যান।”
🌙 গল্প ২: একাকীত্বের মধ্যে শান্তির খোঁজ
মেহজাবিন ইসলাম, ৩৫ বছর, রাজশাহী
“আমার সংসার ভেঙে গিয়েছিল। সন্তান নেই, পরিবার থেকেও দূরে। রাতে ঘুম আসতো না, কাঁদতাম। একদিন ইউটিউবে তাহাজ্জুদের কথা শুনে রাতে উঠে নামাজ পড়া শুরু করলাম। প্রথমদিন দোয়া করতে গিয়ে শুধু কেঁদেছি। কিন্তু এক সপ্তাহের মাথায় একটা অদ্ভুত শান্তি অনুভব করলাম—কোনো ঔষধ বা কাউন্সেলিং-এ যা পাইনি। এখনো তাহাজ্জুদই আমার একমাত্র মানসিক থেরাপি।”
🌙 গল্প ৩: তাহাজ্জুদের মাধ্যমে বদলে গেল পরিবারের রিজিক
মোঃ ফারুক হোসেন, ৪০, চট্টগ্রাম
“আমাদের পরিবারে প্রচণ্ড অর্থকষ্ট ছিল। স্ত্রী বললো—‘চলো আমরা একসাথে তাহাজ্জুদ শুরু করি।’ আমি ও আমার স্ত্রী ২ রাকাত করে তাহাজ্জুদ শুরু করলাম। প্রতিদিন আল্লাহর কাছে শুধু বলতাম—‘হে আল্লাহ, রিজিকের দরজা খুলে দাও।’ ৩ মাসের মধ্যে আমাদের ছোট বিজনেসটা আশ্চর্যজনকভাবে চলতে শুরু করলো। এখন আমি বিশ্বাস করি—রাতের কান্না কখনো বৃথা যায় না।”
📌 ব্যবহারের পরামর্শ:
❓ প্রাসঙ্গিক প্রশ্নোত্তর
🔸 ১. তাহাজ্জুদের জন্য ঘুম থেকে উঠা কি জরুরি?
✅ হ্যাঁ, তাহাজ্জুদ মূলত সেই নামাজ যা ঘুম থেকে উঠে পড়া হয়। তাই কেউ ঘুম না গেলে তা কিয়ামুল লাইল হিসেবে গণ্য হয়, তাহাজ্জুদ নয়।
🔸 ২. কত রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া উচিত?
🔹 কমপক্ষে ২ রাকাত, ইচ্ছামতো বেশি পড়া যায়। হাদিসে নবী ﷺ ৮ বা ১০ রাকাত পর্যন্ত আদায় করেছেন।
🔸 ৩. ঘুম থেকে উঠা কঠিন হলে কী করব?
✅ ঘুমানোর আগে তাহাজ্জুদের নিয়তে ঘুমানো
✅ মোবাইল এলার্ম, পরিবারকে অনুরোধ
✅ প্রথমে ২ রাকাত নিয়েই অভ্যাস গড়ুন
🔸 ৪. তাহাজ্জুদের পর বিতর পড়তে হবে কি?
✅ হ্যাঁ, নবী ﷺ তাহাজ্জুদের শেষে বিতর আদায় করতেন। বিতর এক, তিন বা পাঁচ রাকাত হতে পারে।
🔸 ৫. ফরজ নামাজ কাযা থাকলে তাহাজ্জুদ পড়া যাবে?
✅ হ্যাঁ, তাহাজ্জুদ নফল নামাজ হলেও কেউ চাইলে ফরজ কাযা নামাজ আগে আদায় করে পরে তাহাজ্জুদ পড়তে পারেন। তবে কাযা নামাজ আগে পড়া উত্তম।
🔸 ৬. নারীদের জন্য তাহাজ্জুদের নিয়ম কী আলাদা?
🔹 না, নিয়ম একই। নারী গৃহেই তা আদায় করবেন। পোশাক-পবিত্রতা বজায় রেখে যে কোনো স্থানে তাহাজ্জুদ পড়তে পারবেন।
📌 উপসংহার:
তাহাজ্জুদ নামাজ হলো মুমিনের একান্ত ইবাদতের সময়। এটি আত্মার প্রশান্তি এনে দেয়, দোয়া কবুলের দরজা খুলে দেয় এবং অন্তরকে নরম করে। যারা রাতের আঁধারে উঠে আল্লাহর সামনে দাঁড়ায়, তারা দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হয়। আসুন, আমরা সবাই অন্তত দুটি রাকাত তাহাজ্জুদ শুরু করি আজ রাত থেকেই।