প্রতিটি ভালো দোয়া মুসলিম জীবনের ভ্যালু যোগ করে। “আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবা ওয়া শাবান” একটি বহুল প্রচলিত দোয়া। বাংলাদেশে রমজানের প্রস্তুতি ও প্রাপ্তির জন্য এই দোয়াটি বেশ পরিচিত। তারচেয়ে বড় কথা হলো এটাকে হাদিস হিসাবে প্রচার করা হয়। কিন্তু আসেলেই কি এটা হাদিস? হাদিস হলে সেটার অবস্থান কেমন? সহিহ না জঈফ? আর দোয়া হিসাবে এটা করার বৈধতা রয়েছে কি না তা নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করছি।
আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবা ওয়া শাবান । উচ্চারণ ও অর্থ
দোয়াটির আরবি উচ্চারণ:
“اللهم بارك لنا في رجب وشعبان وبلغنا رمضان”
বাংলা অর্থ হলো: “হে আল্লাহ, আমাদের জন্য রজব এবং শাবান মাসে বরকত দিন এবং আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছার তাওফিক দিন।”
এটি একটি সহজ অথচ অর্থবহ দোয়া, যা মুসলমানদেরকে রমজানের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করে।
রজব ও শাবান: ইসলামে এ মাসগুলোর গুরুত্ব
রজব এবং শাবান মাস “আশহুরুল হুরুম” বা সম্মানিত মাসের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেছেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট মাসের সংখ্যা বারোটি, তার মধ্যে চারটি সম্মানিত।” (সূরা আত-তাওবা: ৩৬)। রজব মাস সেই সম্মানিত মাসগুলোর একটি।
অন্যদিকে শাবান মাস নবী করিম (ﷺ)-এর নিকট বিশেষ গুরুত্ব পেত। নবী করিম (ﷺ) শাবান মাস সম্পর্কে বলেছেন:
عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ، قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، لَمْ أَرَكَ تَصُومُ مِنْ شَهْرٍ مِنَ الشُّهُورِ مَا تَصُومُ مِنْ شَعْبَانَ؟ قَالَ: ذَلِكَ شَهْرٌ يَغْفُلُ النَّاسُ عَنْهُ بَيْنَ رَجَبٍ وَرَمَضَانَ، وَهُوَ شَهْرٌ تُرْفَعُ فِيهِ الْأَعْمَالُ إِلَى رَبِّ الْعَالَمِينَ، فَأُحِبُّ أَنْ يُرْفَعَ عَمَلِي وَأَنَا صَائِمٌ.
অনুবাদ: উসামা ইবনে যায়েদ (رَضِيَ اللهُ عَنْهُ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি বললাম, “হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনাকে কোনো মাসে এত বেশি রোজা রাখতে দেখিনি, যতটা আপনি শাবান মাসে রাখেন।”
তিনি (ﷺ) বললেন, “এটি এমন একটি মাস, যা রজব ও রমজানের মধ্যে পড়ে এবং মানুষ এটি সম্পর্কে গাফিল থাকে। এটি এমন একটি মাস, যাতে আমলসমূহ বিশ্বজগতের প্রতিপালকের কাছে উপস্থাপিত হয়, আর আমি চাই, আমার আমল যেন উপস্থাপিত হয়, যখন আমি রোজাদার অবস্থায় থাকি।” (সুনান আন-নাসাঈ: ২৩৫৭)
হাদিসের ভিত্তি: দোয়াটি কি সহীহ?
“আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রাজাবা ওয়া শাবান” দোয়াটি বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে, যেমন:
- ইমাম আহমদ (رحمه الله) এর “যাওয়াইদুল মুসনাদ”
- তবারানি (رحمه الله) এর “আল-মু’আজামুল আওসাত”
- আল-বাইহাকি (رحمه الله) এর “শুআবুল ঈমান”।
তবে মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদিসটির সনদ দুর্বল। ইমাম নববী (رحمه الله) বলেছেন, “এই দোয়াটি সহীহ নয়।” (আল-আযকার, পৃষ্ঠা ১৮৯) শায়খ আলবানী (رحمه الله) বলেন, “দোয়াটি দুর্বল।” (দাইফুল জামে: ৪৩৯৫)
ইসলামে দুর্বল হাদিসের বিধান
ইসলামে দুর্বল হাদিস সীমিতভাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে, বিশেষত ফজিলতের বিষয়ে। তবে এর জন্য কিছু শর্ত মানা আবশ্যক। মুহাদ্দিসগণ একমত যে দুর্বল হাদিস তখনই গ্রহণযোগ্য, যখন তা শরিয়াহর কোনো মূলনীতি বা আকিদার বিরোধিতা না করে এবং ইবাদতের প্রতি উৎসাহ সৃষ্টি করে।
শায়খ ইবন রজব (رحمه الله) বলেছেন:
“যদি দুর্বল হাদিস মানুষের হৃদয়ে ইবাদতের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে এবং তা শরিয়াহ-বিরোধী না হয়, তবে তা গ্রহণযোগ্য।” (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ১২১)।
এই বিধান অনুযায়ী, দুর্বল হাদিস সরাসরি কোনো আইনগত বা বাধ্যতামূলক বিষয় নির্ধারণে ব্যবহৃত হতে পারে না। তবে তা নৈতিকতা, আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর ইবাদতের প্রতি অনুপ্রেরণা দিতে ব্যবহৃত হতে পারে। এটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে মুসলিম স্কলারদের সতর্কতা ও দায়িত্বশীলতার প্রয়োজন।
আরো পড়ুন।
রমজানের প্রস্তুতিতে দোয়ার ভূমিকা
রমজান মুসলমানদের জীবনে একটি বিশেষ বরকতময় সময়, যা আত্মশুদ্ধি, তাওবা এবং ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের সুযোগ এনে দেয়। এই মাসের গুরুত্ব উপলব্ধি করে এবং এর সর্বোচ্চ ফজিলত লাভের জন্য মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি গ্রহণ অপরিহার্য। দোয়া এ প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
“আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজব ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রমাদান” (হে আল্লাহ! আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন) রমজানের প্রস্তুতির একটি সুন্দর উদাহরণ। যদিও এটি হাদিস হিসাবে দুর্বল। কিন্তু হাদিস হিসাবে প্রচার না করে আপনি দোয়া হিসাবে এটি করতে পারেন।
ইবন আবু দুনইয়া (رحمه الله) উল্লেখ করেছেন যে সালাফে সালেহিন (আদি প্রজন্মের ধার্মিক মুসলিম) ছয় মাস ধরে দোয়া করতেন, যেন তারা রমজানের বরকতপূর্ণ সময় পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারেন। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ১৪৮)। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বোঝা যায়, রমজানকে সামনে রেখে দোয়া কেবল প্রস্তুতির একটি অংশ নয়, বরং এটি আত্মবিশ্বাস ও আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ নির্ভরতার প্রকাশ।
দোয়া মানুষের হৃদয়ে রমজানের ফজিলত সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করে এবং আধ্যাত্মিকভাবে আল্লাহর ইবাদতের জন্য প্রস্তুত করে তোলে। এটি রমজানের সময়কালকে সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগানোর একটি প্রেরণা।
রজব মাসের বিশেষ আমল
রজব মাসে নির্দিষ্ট কোনো ইবাদতের বিধান নেই। শায়খ ইবন উছাইমীন (رحمه الله) বলেন, “রজব মাস অন্যান্য মাসের মতোই সাধারণ। এতে নির্দিষ্ট কোনো রোজা, নামাজ বা ওমরার বিধান নেই।” (লিকাউল বাবিল মাফতূহ, ১৭৪/২৬) তবে এটি আত্মশুদ্ধি, ইস্তিগফার এবং নিয়মিত নামাজ ও কোরআন পাঠের একটি সময়।
শাবান মাসে ইবাদতের গুরুত্ব
শাবান মাসে নবী করিম (ﷺ) অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি রোজা রাখতেন। উসামা ইবন যায়েদ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি নবীজী (ﷺ)-কে জিজ্ঞাসা করেন, “শাবান মাসে আপনি কেন এত বেশি রোজা রাখেন?” নবীজী (ﷺ) উত্তর দেন, “এটি এমন একটি মাস যা রজব ও রমজানের মধ্যে পড়ে এবং মানুষ এটি উপেক্ষা করে।” (নাসাঈ: ২৩৫৭)
দোয়ার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি
দোয়া মুসলমানের জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ, যা আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ নির্ভরতার প্রতীক। “আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজব ওয়া শাবান” দোয়াটি শুধুমাত্র রমজানের প্রস্তুতির জন্য নয়; বরং এটি আল্লাহর প্রতি ভরসা এবং তাঁর কাছে কল্যাণ কামনার প্রকাশ।
ইবন আবু দুনইয়া (رحمه الله) বলেছেন:
“দোয়া হলো মুমিনের অস্ত্র, যা তাকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছায়।” (মুজামুল আহাদিস, পৃষ্ঠা ১৫)।
দোয়া মানুষকে আত্মিক শক্তি দেয় এবং দুনিয়ার পরীক্ষায় দৃঢ়তার সাথে টিকে থাকতে সহায়তা করে। এটি মুমিনকে তার দুর্বলতা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং আল্লাহর উপর নির্ভরতার শিক্ষা দেয়।
এই দোয়া মুমিনের অন্তরে আত্মবিশ্বাস তৈরি করে এবং আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে সহায়ক হয়। আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতে অগ্রসর হওয়ার জন্য এটি একটি শক্তিশালী মাধ্যম, যা রমজানের মতো বরকতময় সময়কে সর্বোত্তমভাবে কাজে লাগাতে সাহায্য করে।
কিছু প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন: দোয়াটি কি বাধ্যতামূলক?
উত্তর: না, এটি সুন্নত নয় এবং বাধ্যতামূলক নয়। এটি একটি সাধারণ দোয়া।
প্রশ্ন: এটি পড়া কি বিদআত?
উত্তর: না, এটি বিদআত নয়। বরং এটি বরকত প্রার্থনার একটি দোয়া।
প্রশ্ন: এই দোয়ার সঙ্গে বিশেষ কোনো সময় যুক্ত আছে?
উত্তর: না, এটি রজব মাসের প্রথম রাত বা অন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রযোজ্য নয়।
প্রশ্ন: দুর্বল হাদিসের ভিত্তিতে দোয়া পড়া কি বৈধ?
উত্তর: ফজিলতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদিস গ্রহণযোগ্য, যদি তা শরিয়াহ-বিরোধী না হয়।