আল্লাহুম্মা জাম্মিলহু । সুন্দর হওয়ার দোয়া ও এর মাহাত্ম্য

Share this post

সৌন্দর্য চাওয়া মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। বাহ্যিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যও গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম আমাদের উভয় প্রকার সৌন্দর্যের দিকেই যত্নবান হতে নির্দেশ দিয়েছে। আর সেই সৌন্দর্য অর্জনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করাও অন্যতম মাধ্যম। এই প্রবন্ধে “আল্লাহুম্মা জাম্মিলহু” তথা সুন্দর হওয়ার দোয়া সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।

আল্লাহুম্মা জাম্মিলহু । দোয়ার অর্থ ও উচ্চারণ

দোয়া:

اللهم جملّه

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা জাম্মিলহু

অর্থ: “হে আল্লাহ! তাকে সুন্দর করে দাও।”

এই দোয়াটি সাধারণত অন্যের জন্য বলা হয়। তবে নিজের জন্য বলতে চাইলে বলা যায়:

اللهم جملني

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা জাম্মিলনি

অর্থ: “হে আল্লাহ! আমাকে সুন্দর করে দাও।”

সুন্দর হওয়ার প্রকৃত অর্থ কী?

অনেকেই সৌন্দর্য বলতে কেবল বাহ্যিক রূপ ও শারীরিক সৌন্দর্যকেই বোঝেন। কিন্তু প্রকৃত সৌন্দর্য এর চেয়েও বিস্তৃত ও গভীর। এটি শুধু চেহারার সৌন্দর্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং অন্তরের পবিত্রতা, চরিত্রের মহত্ব এবং আমলের পরিশুদ্ধতাও সৌন্দর্যের অংশ।

বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের সংজ্ঞা

বাহ্যিক সৌন্দর্য: বাহ্যিক সৌন্দর্য বলতে চেহারা, শারীরিক গঠন ও পরিপাটিতাকে বোঝানো হয়। ইসলাম আমাদের পরিচ্ছন্নতা, সুন্নতি রূপচর্চা ও শালীন পোশাক পরিধানের মাধ্যমে বাহ্যিক সৌন্দর্য ধরে রাখতে উৎসাহিত করেছে। যেমন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:

❝ আল্লাহ তায়ালা সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন। ❞ (মুসলিম, ৯১)

অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য: প্রকৃত সৌন্দর্য আসলে অন্তরের পবিত্রতায় নিহিত। বিনয়, তাকওয়া, উত্তম চরিত্র, ধৈর্য, দয়া ও ক্ষমাশীলতা হলো অন্তরের সৌন্দর্যের মূল ভিত্তি। এমন মানুষই প্রকৃত সুন্দর যিনি মানুষের সঙ্গে ভালো আচরণ করেন এবং আল্লাহর কাছে প্রিয় হন।

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

❝ আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও ধন-সম্পদের দিকে তাকান না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে তাকান। ❞ (মুসলিম, ২৫৬৪)

ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃত সৌন্দর্য

ইসলামে সৌন্দর্য বলতে বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো চরিত্রের সৌন্দর্য। এক ব্যক্তি যদি বাহ্যিকভাবে আকর্ষণীয় হয় কিন্তু তার আচরণ যদি খারাপ হয়, তাহলে সে প্রকৃতপক্ষে সুন্দর নয়। আল্লাহর কাছে প্রকৃত সুন্দর সেই ব্যক্তি, যার অন্তর ঈমান ও তাকওয়ায় পূর্ণ।

🔹 কুরআনের বর্ণনা

❝ যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতের চিরস্থায়ী বসতি। সেখানে তারা থাকবে অনন্তকাল। ❞ (সূরা কাহফ: ১০৭-১০৮)

🔹 রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর চরিত্র ছিল সৌন্দর্যের অনন্য উদাহরণ, আল্লাহ তায়ালা বলেন:

❝ নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের অধিকারী। ❞ (সূরা আল-কালাম: ৪)

হৃদয়ের সৌন্দর্য: চরিত্র গঠনের দোয়া ও আমল

ইসলামে হৃদয়ের সৌন্দর্যকে বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়েছে। উত্তম চরিত্র, বিনয়, ধৈর্য, ক্ষমাশীলতা, দয়া ও তাকওয়া—এসব গুণ একজন মানুষের অন্তরের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

❝ তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সে, যার চরিত্র সর্বোত্তম। ❞ (বুখারি: ৬০৩৫, মুসলিম: ২১৩৭)

যে ব্যক্তি নিজেকে আখিরাতের জন্য প্রস্তুত করতে চায়, তার উচিত বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি হৃদয়ের পবিত্রতা অর্জনের জন্য আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করা। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দোয়া ও আমল উল্লেখ করা হলো—

আত্মশুদ্ধির দোয়া

১. অন্তর পরিশুদ্ধ করার দোয়া

اللَّهُمَّ آتِ نَفْسِي تَقْوَاهَا، وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا، أَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلَاهَا

🔹 উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আতি নাফসি তাকওয়াহা, ওয়াযাক্কিহা, আনতা খাইরু মান যাক্কাহা, আনতা ওলীয়্যুহা ওয়ামাওলাহা।

🔹 অর্থ: “হে আল্লাহ! আমার অন্তরকে তাকওয়ার সঙ্গে পূর্ণ করে দাও, আর তুমি একে পরিশুদ্ধ করে দাও। তুমিই সর্বোত্তম পরিশোধক, তুমিই এর অভিভাবক ও পরিচালক।” (সহিহ মুসলিম: ২৭২২)

২. উত্তম চরিত্রের জন্য দোয়া

اللَّهُمَّ كَمَا أَحْسَنْتَ خَلْقِي فَأَحْسِنْ خُلُقِي

🔹 উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা কামা আহসানতা খালকি, ফা আহসিন খুলুকি।

🔹 অর্থ: “হে আল্লাহ! যেমন তুমি আমার সৃষ্টি সুন্দর করেছ, তেমনই আমার চরিত্রও সুন্দর করে দাও।”
(আল-আদাবুল মুফরাদ: ১২৩৯, আহমদ: ২৪৪৬৫)

৩. অহংকার ও খারাপ স্বভাব থেকে বাঁচার দোয়া

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ مُنْكَرَاتِ الْأَخْلَاقِ وَالْأَعْمَالِ وَالْأَهْوَاءِ

🔹 উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযু বিকা মিন মুনকারাতিল আখলাকি ওয়াল আআমালি ওয়াল আহওয়াই।

🔹 অর্থ: “হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই খারাপ চরিত্র, খারাপ আমল ও খারাপ প্রবৃত্তি থেকে।” (তিরমিজি: ৩৫৯১, সহিহ জামে: ১২৮৯)

আরো পড়ুন:

উত্তম চরিত্র অর্জনের আমল

১. সবসময় সত্য বলা ও গিবত থেকে বেঁচে থাকা

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

❝ একজন মুমিন মিথ্যাবাদী হতে পারে না। ❞ (মুসনাদে আহমদ: ১১২৫৮)

২. রাগ সংবরণ করা

❝ শক্তিশালী সে নয়, যে কুস্তিতে জয়ী হয়; বরং প্রকৃত শক্তিশালী সে, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ❞ (বুখারি: ৬১১৪, মুসলিম: ২৬০৯)

৩. ক্ষমাশীল ও সহনশীল হওয়া

❝ যে ক্ষমা করে, আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেন। ❞ (মুসলিম: ২৫৮৮)

৪. অহংকার ও আত্মপ্রশংসা থেকে দূরে থাকা

❝ যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। ❞ (মুসলিম: ৯১)

৫. মানুষের প্রতি দয়া ও দানশীল হওয়া

❝ যে দয়া করে না, সে দয়া পাবে না। ❞(বুখারি: ৬০১৩, মুসলিম: ২৩১৯)

৬. আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করা (যিকর করা)

❝ নিশ্চয়ই, অন্তর আল্লাহর যিকর দ্বারা প্রশান্ত হয়। ❞ (সূরা রাদ: ২৮)

কেন এই দোয়া পড়া গুরুত্বপূর্ণ?

  • আত্মিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি: বাহ্যিক সৌন্দর্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো আত্মিক সৌন্দর্য। দোয়ার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কাছে অনুগ্রহ চাইতে পারি যেন তিনি আমাদের হৃদয়কে সুন্দর করে দেন।
  • শারীরিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি: অনেকেই সুন্দর হওয়ার জন্য নানা প্রসাধনী ব্যবহার করেন, তবে আল্লাহর কাছে দোয়া করলে প্রকৃত ও চিরস্থায়ী সৌন্দর্য লাভ করা সম্ভব।
  • ভালো চরিত্র গঠনে সহায়ক: একজন মানুষের চরিত্র যদি সুন্দর হয়, তবে তা তার বাহ্যিক সৌন্দর্যকেও আরও বৃদ্ধি করে। এই দোয়া দ্বারা চরিত্রের উন্নতি সম্ভব।

দোয়াটি কখন পড়বেন?

১. প্রতিদিন সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পড়া যেতে পারে।

২. কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে পড়লে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়।

৩. অন্য কারও জন্য দোয়া করলে তার প্রতি আন্তরিকতা প্রকাশ পায়।

অন্যান্য দোয়া যা সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সহায়ক

১. বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যের জন্য

اللهم حسِّن خلقي كما حسَّنت خلقي

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা হাসসিন খুলুকি কামা হাসসানতা খালকি

অর্থ: “হে আল্লাহ! যেমন তুমি আমার আকৃতি সুন্দর করেছ, তেমনি আমার চরিত্রকেও সুন্দর করো।” (আহমদ, তিরমিজি)

২. মুখের ঔজ্জ্বল্য ও সৌন্দর্যের জন্য:

اللهم نوِّر وجهي بنورك

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা নাওইর ওয়াজহি বিনুরিকা

অর্থ: “হে আল্লাহ! তুমি তোমার নূরের মাধ্যমে আমার চেহারা উজ্জ্বল করো।”

প্রশ্ন ও উত্তর

প্রশ্ন ১: শুধু দোয়া পড়লেই কি সুন্দর হওয়া যাবে?

উত্তর: দোয়া গুরুত্বপূর্ণ, তবে এর পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং সুন্দর চরিত্র গঠন করাও জরুরি।

প্রশ্ন ২: দোয়াটি কি শুধুমাত্র শারীরিক সৌন্দর্যের জন্য?

উত্তর: না, এটি বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় সৌন্দর্যের জন্য প্রযোজ্য।

প্রশ্ন ৩: মহিলারা কি এই দোয়া পড়তে পারেন?

উত্তর: হ্যাঁ, নারীরাও এই দোয়া পড়তে পারেন এবং এটি তাদের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

প্রশ্ন ৪: দোয়াটি দিনে কতবার পড়া উচিত?

উত্তর: নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা নেই, তবে নিয়মিত পড়লে উপকারিতা বেশি পাওয়া যাবে।

উপসংহার

সৌন্দর্য কেবল বাহ্যিক বিষয় নয়, বরং আত্মিক ও চারিত্রিক গুণাবলীও এর অন্তর্ভুক্ত। “আল্লাহুম্মা জাম্মিলহু” দোয়াটি আমাদের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর নিকট দোয়া করলে এবং সুন্নাহ মোতাবেক জীবনযাপন করলে প্রকৃত সৌন্দর্য অর্জন করা সম্ভব। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য দান করুন, আমিন।


Share this post
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x