হাততালি দেওয়া একটি সাংস্কৃতিক প্রথা। এটি মূলত আনন্দ, প্রশংসা বা বিস্ময় প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ইসলামী শরিয়তে এর অবস্থান কী? কোনো মাহফিল, সেমিনার বা সভা-সমাবেশে হাত তালি দেওয়া কি জায়েজ? এ নিয়ে বহু মুসলিমের মনে প্রশ্ন জাগে। এখানে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
হাত তালি দেওয়া কি জায়েজ?
হাত তালি দেওয়া সার্বিকভাবে জায়েজ নয় না বলে অনুত্তম বলা বাঞ্চণীয়। সভা বা সেমিনারে হাততালি দেওয়া একটি অনুত্তম বা অপছন্দনীয় (মাকরুহ) কাজ। সালাফ থেকে হাফলা বা মজলিসে আনন্দ আবেগ ইত্যাদি প্রকাশের জন্য এককভাবে তাসবিহ হামদ পড়ার কথা প্রমাণিত থাকলেও তাঁরা কখনো হাততালি দিয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাই এরকম স্থানে তাসবিহ বা হামদ পড়াই উত্তম।
তবে কেউ যদি সওয়াবের নিয়ত ছাড়া নিছক আনন্দ বা বিস্ময় প্রকাশের জন্য সভা-সেমিনারে হাততালি দেয়, তাহলে তার কাজটি অনুত্তম হলেও হারাম হবে না। কেননা হারাম হওয়ার জন্য বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত ও অর্থ প্রকাশে সুস্পষ্ট দলিলের প্রয়োজন হয়।
হাত তালি বিষয়ে কুরআন ও হাদিস যা বলে
কুরআন থেকে নির্দেশনা
সুরা আনফাল’এর ৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা’আলা মুশরিকদের ইবাদত পদ্ধতির নিন্দা করে বলেন:
“وَمَا كَانَ صَلَاتُهُمْ عِندَ الْبَيْتِ إِلَّا مُكَاءً وَتَصْدِيَةً فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ”
“আর বায়তুল্লাহর কাছে শিস ও হাততালি দেওয়াই তাদের সালাত ছিল। সুতরাং তোমাদের কুফুরির প্রতিফল হিসেবে শাস্তিভোগ করো।”
কিন্তু এই আয়াতটি হাততালি হারাম হওয়ার পক্ষে দলিল হবে না। কেননা এখানে আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদের এ কাজকে নিছক হাততালি হওয়ার কারণে নিন্দা করেননি। বরং হাততালির সাথে মন্দ আরেকটি বিষয় যুক্ত হওয়ার কারণে নিন্দা করা হয়েছে। সেই মন্দ বিষয়টি সম্পর্কে বিখ্যাত মুফাস্সির মুজাহিদ বলেন:
”ق وإنما كانوا يصنعون ذلك ليخلطوا بذلك على النبي صلى الله عليه وسلم صلاته. وقال الزهري: يستهزئون بالمؤمنين. وعن سعيد بن جُبَيْر وعبد الرحمن بن زيد : { وَتَصْدِيَة } قال : صدُّهم الناس عن سبيل الله، عز وجل “
অনুবাদ: ‘মুশরিকরা এটা এ জন্য করতো, যাতে তার সাথে রাসুলুল্লাহ Ñসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সালাত মিশ্রিত হয়ে যায়। যুহরি বলেন, তারা এর মাধ্যমে মুমিনদের নিয়ে উপহাস করতো। আর সাঈদ ইবনে যুবাইর ও আব্দুর রাহমান ইবনে জায়দ থেকে বর্ণিত, তাঁরা বলেছেন ‘তাসদিয়া’ হলো মানুষকে আল্লাহ তা’য়ালার রাস্তা থেকে বিরত রাখা।’
হাদিস থেকে হাততালির বিধান
আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন:
“التسبيح للرجال والتصفيق للنساء”
“পুরুষদের জন্য তাসবিহ এবং নারীদের জন্য হাততালি।”
এই হাদিস থেকে কেউ কেউ ধারণা করেন পুরুষরা হাততালি দেওয়ার মধ্যে মহিলাদের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যায়। তাই স্বার্বিকভাবে হাততালি নিষেধ। কিন্তু বাস্তবতা হলো হাদিসটিতে কেবল সালাতের অবস্থায় কাউকে সতর্ক করার মাধ্যম জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সালাতের বাহিরের অবস্থার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এ জন্যই মহিলাদের জন্য সালাতের বাহিরে হাততালি বৈধ হওয়ার পক্ষে এই হাদিসকে কেউই দলিল হিসাবে গ্রহণ করেননি।
ফুকাহায়ে কেরামের অভিমত
মাহফিল বা সেমিনারে হাততালি দেওয়ার হুকুম সম্পর্কে ফুকাহায়ে কেরামের থেকে দুটি মতামত রয়েছে।
- অনুত্তম বা মাকরুহ: ফুকাহায়ে কেরামের একটি দল মনে করেন, হাততালি দেওয়া অনর্থক কাজ এবং এটি মাকরুহ। এর পেছনে যুক্তি হলো, এটি জাহিলিয়াতের ইবাদত পদ্ধতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তবে যদি এটি নিছক আনন্দ বা বিস্ময় প্রকাশের জন্য না হয়। বরং অন্য কোনো ধর্মের ইবাদতের উদ্দেশ্য যুক্ত থাকে, তাহলে এটি হারাম হিসেবে গণ্য হবে।
- হারাম: কিছু ফকিহ বলেছেন, হাততালি দেওয়া হারাম বলেছেন। এর পেছনে তাদের যুক্তি হলো – প্রয়োজন ছাড়া হাততালি দেওয়া একটি অনর্থক কাজ।
ফিকাহ গ্রন্থ থেকে রেফারেন্স
আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাতিল কুয়িতিয়্যাতে ফুকাহায়ে কেরামের মতামত উল্লেখ করে বলা হয়:
”التصفيق في غير الصلاة والخطبة جائز إذا كان لحاجة معتبرة كالاستئذان والتنبيه، أو تحسين صناعة الإنشاد، أو ملاعبة النساء لأطفالهن. أما إذا كان لغير حاجة، فقد صرح بعض الفقهاء بحرمته، وبعضهم بكراهته. وقالوا : إنه من اللهو الباطل، أو من التشبه بعبادة أهل الجاهلية “
অনুবাদ: ‘সালাত ও খুতবার বাহিরে হাততালি দেওয়া জায়েয রয়েছে যদি তা কোনো প্রয়োজনে হয়। যেমন কাউকে অনুমতি দেওয়া বা সতর্ক করা বা সংগীতের সৃজন-শ্রী বৃদ্ধি করার বা মায়েরা তাদের বাচ্ছাদের নিয়ে খেলা করার সময়।
কিন্তু যখন তা কোনো প্রয়োজন ছাড়া হয় তাহলে এটাকে কিছু ফুকাহায়ে কেরাম হারাম বলেছেন আর কিছু বলেছেন মাকরুহ। তারা বলেন, এটা অনর্থক অমূলক কাজ। অথবা এটা জাহিলিয়্যাতের ইবাদতের সাথে সাদৃশ্য রাখে।’
এখানে জেনে রাখা দরকার সকল অনর্থক কাজ যদিও সওয়াবহীন কিন্তু সকল অনর্থক কাজ হারাম বা গুনাহের কারণ হয় না। তাই ইবাদত মনে করা ছাড়া কেউ যদি হাততালি দেয় তাহলে তার কাজটি অনর্থক অনুত্তম ও অপছন্দনীয় হবে ঠিক কিন্তু হারাম বা গুনাহের কারণ হবে না।
আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাতিল কুয়িতিয়্যাতে পূর্বের বক্তব্যটি উদ্ধৃত করার পর ঠিকা টেনে বলা হয়:
” لا يخفى ما في هذه الاستدلالات من المآخذ، لأن كونه من اللهو الباطل معناه أنه لا ثواب له (تحفة الأحوذي ৫ / ২৬৬) وليس كل ما خلا من الثواب حراما، ولأن التشبه بعبادة أهل الجاهلية لم يبق له وجود. وذم التصفيق في الآية إنما هو لكونه عند البيت “
‘দালিলগুলো যেভাবে গ্রহণ করা হয়েছে তার মধ্যে যা রয়েছে তা স্পষ্ট। কেননা অনর্থক অমূলক হওয়ার অর্থ হলো তার সওয়াব নেই। আর যা কিছুই সওয়াব থেকে খালি হবে তা হারাম নয়। এভাবে জাহিলিয়্যাতের ইবাদতের সাথে সাদৃশ্য হওয়ার বাস্তবতা এখন আর বাকি নেই। আর আয়াতে হাততালি দেওয়াকে বাইতুল্লাহর কাছে হওয়ার কারণে নিন্দা করা হয়েছে।’
হাততালি দেওয়ার কিছু শর্ত
যদি হাততালি দেওয়া হয়, তবে তা অবশ্যই নিম্নলিখিত শর্তের ভিত্তিতে হতে হবে:
- ইবাদতের উদ্দেশ্যে নয়: হাততালি ইবাদতের বিকল্প বা অংশ হিসেবে ব্যবহার করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
- প্রয়োজনবোধে সীমাবদ্ধ: যেমন কারও মনোযোগ আকর্ষণ করা বা শিশুদের আনন্দ দেওয়ার জন্য।
- সাংস্কৃতিক প্রথার অংশ: এটি একটি সাংস্কৃতিক বা সামাজিক প্রথা হিসেবে করা এবং এতে কোনো হারাম উপাদান না থাকা।
হাততালি দেওয়ার বিকল্প
ইসলামী সংস্কৃতিতে হাততালির পরিবর্তে তাসবিহ, হামদ বা তাকবির পড়া বেশি উপযুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, কোনো বক্তার কথা ভালো লাগলে “মাশা’আল্লাহ” বা “আল্লাহু আকবার” বলা যেতে পারে। এটি শ্রোতার প্রশংসা ও অনুভূতির প্রকাশ ঘটায় এবং একইসঙ্গে ইসলামের রীতি অনুসরণ করে।
প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১: মাহফিলে বক্তার বক্তব্যে মুগ্ধ হয়ে হাততালি দেওয়া কি বৈধ?
উত্তর: যদি এটি নিছক আনন্দ বা প্রশংসা প্রকাশের জন্য হয় এবং এতে কোনো ইবাদতের উদ্দেশ্য না থাকে, তবে এটি হারাম নয়, তবে অনুত্তম।
প্রশ্ন ২: শিশুরা খেলা করার সময় হাততালি দিলে তা কি জায়েয?
উত্তর: শিশুদের ক্ষেত্রে এটি বৈধ। এটি তাদের মনোরঞ্জনের একটি স্বাভাবিক পদ্ধতি।
প্রশ্ন ৩: সালাতের বাইরে হাততালি দেওয়া কি পুরুষদের জন্য নারীদের সাথে সাদৃশ্য তৈরি করে?
উত্তর: না, এটি সালাতের প্রেক্ষাপটে প্রযোজ্য নয়। সালাতের বাইরে হাততালি দেওয়া সাংস্কৃতিক প্রথার অংশ হিসেবে বৈধ।
প্রশ্ন ৪: মাহফিলে হাততালির পরিবর্তে কী করা উচিত?
উত্তর: বক্তার প্রশংসা বা অনুভূতি প্রকাশ করতে তাকবির (“আল্লাহু আকবার”), তাসবিহ (“সুবহানাল্লাহ”), বা হামদ (“আলহামদুলিল্লাহ”) বলা উত্তম।
উপসংহার
মাহফিল বা সেমিনারে হাততালি দেওয়া নিছক সাংস্কৃতিক প্রথা, যা ইসলামী শরিয়তে হারাম নয়। তবে এটি অনুত্তম এবং ইসলামি ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই এর পরিবর্তে তাসবিহ, হামদ বা তাকবির পড়া উত্তম। তবে কোনো প্রয়োজন বা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে হাততালি দেওয়া গেলে তা বৈধ হবে, তবে ইবাদত হিসেবে কখনোই নয়।