ইসলাম এমন এক পরিপূর্ণ জীবনবিধান, যেখানে একজন মুমিনের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি দিক নিয়েই রয়েছে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা। খাওয়া, ঘুম, চলাফেরা এমনকি প্রাকৃতিক প্রয়োজনের সময়ও একজন মুসলমান কীভাবে নিজেকে শুদ্ধ ও নিরাপদ রাখবে—সেসব বিষয়েও নবী করিম ﷺ আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। এ কারণেই মুসলমানের জীবন শুধু নামাজ ও রোজায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রতিটি ছোট কাজেও ইবাদতের সুবাস লুকিয়ে থাকে। তারই একটি অনন্য উদাহরণ হলো— বাথরুমে প্রবেশ করার দোয়া :
এটি যেমন আমাদের আত্মিকভাবে শয়তানের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে, তেমনি দৈনন্দিন জীবনে আল্লাহর স্মরণে থাকাও নিশ্চিত করে। এই ব্লগপোস্টে আমরা জানবো, বাথরুমে প্রবেশের আগে ও পরে কোন দোয়া পড়া উচিত, তার অর্থ ও তাৎপর্য কী, এবং এর পেছনের ইসলামী শিক্ষাটি কীভাবে আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে।
🚪 বাথরুমে প্রবেশ করার দোয়া
📜 আরবি:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْخُبُثِ وَالْخَبَائِثِ
📢 বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আ‘উযু বিকা মিনাল-খুবসি ওয়াল-খবায়িছ।
🌾 অর্থ: “হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই পুরুষ ও নারী শয়তানদের অনিষ্ট থেকে।”
📚 হাদিসের প্রমাণ
✅ এই দোয়া সম্পর্কে হাদিস এসেছে:
عَنْ أَنَسٍ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إِذَا دَخَلَ الْخَلَاءَ، قَالَ: اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْخُبُثِ وَالْخَبَائِثِ
‘‘আনাস (রাযি.) বলেন, নবী ﷺ যখন বাথরুমে প্রবেশ করতেন, তখন তিনি বলতেন: ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযু বিকা মিনাল-খুবসি ওয়াল-খবায়িছ।’” 📖 সহীহ বুখারী: ১৪২, সহীহ মুসলিম: ৩৭৫
দোয়ার তাৎপর্য ও উপকারিতা
- শয়তানের আক্রমণ থেকে রক্ষা: বাথরুম এমন স্থান, যেখানে জ্বিন-শয়তান অবস্থান করে। এই দোয়ার মাধ্যমে একজন মুমিন আত্মিক নিরাপত্তা চায়।
- স্মরণ ও তাকওয়া: দোয়া পাঠ করে বাথরুমে প্রবেশের মাধ্যমে সে মুহূর্তেও আল্লাহর স্মরণ হয়।
- ইসলামী সভ্যতার প্রতিচ্ছবি: দুনিয়ার কোনো সভ্যতায় এমন সূক্ষ্ম ও গভীর নিরাপত্তাবোধ নেই, যা ইসলাম আমাদের শেখায়।
❗ কীভাবে পড়বেন?
- বাথরুমে প্রবেশের আগে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এই দোয়া পড়বেন।
- তারপর বাম পা আগে দিয়ে প্রবেশ করবেন।
- বাথরুমে আল্লাহর নাম না নেয়ার জন্য এই দোয়া বাইরে পড়তে হয়।
🧼 অতিরিক্ত সুন্নাত যা মনে রাখা ভালো
- বাথরুমে ঢোকার সময় বাম পা দিয়ে প্রবেশ করা সুন্নাত।
- বাথরুম থেকে বের হওয়ার সময় ডান পা দিয়ে বের হওয়া সুন্নাত।
- বের হয়ে বলা সুন্নাত দোয়া: غُفْرَانَكَ
- উচ্চারণ: গুফরানাকা। অর্থ: “আমি তোমার ক্ষমা চাই।
🌟 বাথরুমে প্রবেশের দোয়ার ফজিলত
✅ ১. জ্বিন ও শয়তানের অনিষ্ট থেকে রক্ষা
নবী (ﷺ) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি বাথরুমে প্রবেশের সময় এই দোয়া পড়বে—
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْخُبُثِ وَالْخَبَائِثِ
—সে শয়তান ও তার অনুচরদের অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকবে।” 📚 সূত্র: আবূ দাউদ, হাদীস: ৬, তিরমিযী, হাদীস: ৬
✅ ২. সতর্কতা ও ইবাদতের অনুভব বৃদ্ধি পায়
এই দোয়া পড়ার অভ্যাস একজন মুমিনকে সবক্ষেত্রে আল্লাহর স্মরণে রাখে। এমনকি অশুদ্ধ স্থানেও আল্লাহর আশ্রয় চাওয়ার মাধ্যমে আত্মা সতেজ থাকে।
✅ ৩. নবীজির সুন্নাহ পালনের ফজিলত লাভ হয়
এই দোয়া পড়া হল সুন্নাত। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে ভালোবাসলো, সে আমাকেই ভালোবাসলো।” 📚 সূত্র: তিরমিযী, হাদীস: ২৬৭৮
✅ ৪. হেফাজতের অনুভব ও অভ্যাস গড়ে ওঠে
ছোট ছোট এই সুন্নাহ গুলোর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি বড় বড় গুনাহ থেকেও বেঁচে থাকতে পারেন। কারণ প্রতিটি সুন্নাহ আল্লাহর দিকে ফেরার একটা সুযোগ।
🔚 সংক্ষেপে
এই ছোট্ট দোয়াটির মাধ্যমে আমরা এক দিকে যেমন শয়তানের অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকি, অন্য দিকে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন গড়ার এক প্রশিক্ষণও পেয়ে থাকি।
🧒 শিশুদের শেখানোর কৌশল : বাথরুমে প্রবেশের দোয়া
১. 🎶 ছন্দ বা গান ব্যবহার করো
শিশুরা ছন্দ ও সুরে সহজেই শিখে। নিচের মতো করে ছন্দে রূপ দিয়ে পড়ালে তারা আনন্দের সঙ্গে মুখস্থ করবে:
- বাথরুমে ঢুকতে গেলে,
- আল্লাহকে আগে স্মরণ করি,
- দোয়া পড়ে বাম পা ফেলে,
- শয়তানের ক্ষতি করি জারি।
এরপর বাথরুমে প্রবেশ করার দোয়া একসাথে পড়ে: আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযু বিকা মিনাল-খুবসি ওয়াল-খবায়িছ।
২. 📖 রঙিন চার্ট বা ফ্ল্যাশকার্ড
– সুন্দরভাবে আরবি দোয়া, বাংলা উচ্চারণ ও অর্থসহ একটি রঙিন চার্ট তৈরি করে দেয়ালে টাঙিয়ে দাও।
– শিশুর উচ্চতার সমান হলে প্রতিবার বাথরুমে যাওয়ার আগে চোখে পড়বে।

৩. 🎭 অভিনয় বা রোল প্লে
– বাবা-মা মিলে “আমি এখন বাথরুমে যাচ্ছি!” বলে নাটক করো, তারপর দোয়া পড়ো।
– শিশুকে “তুমি এখন বাবা-মা” বানিয়ে দাও – সে তোমার দোয়া রিভিশন নেবে। এতে খেলার ছলে শেখে।
৪. 📱 কার্টুন ভিডিও তৈরি/দেখানো
– ইউটিউবে ইসলামিক কার্টুন যেখানে শিশুরা বাথরুমে প্রবেশের দোয়া পড়ে, সেগুলো নিয়মিত দেখাও।
– তোমার নিজের ওয়েবসাইট/চ্যানেলে এমন একটি ছোট অ্যানিমেটেড ভিডিও বানিয়ে দিতে পারি চাইলে।
৫. ✅ দৈনন্দিন চর্চার মাধ্যমে অভ্যাস
– প্রতিবার বাথরুমে যাওয়ার আগে বলে দাও:
“বাবা/মা, দোয়াটা বলো তো?”
– প্রথমে একসাথে বলো, পরে ধীরে ধীরে সে নিজেই মুখস্থ বলবে।
৬. 🎁 পুরস্কার ভিত্তিক শেখানো
– “যে পাঁচদিন দোয়া মনে রেখে বলবে, তাকে ছোট উপহার/স্টিকার!”
– শিশুদের কাছে প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার খুবই কার্যকর।
👩 নারীদের জন্য বাথরুমে প্রবেশের দোয়ার বিশেষ টিপস
১. 🛑 ব্যস্ত জীবনেও সচেতনতা বজায় রাখুন
অনেক সময় নারীরা রান্না, সন্তান, অতিথি বা ঘরের কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে দোয়া পড়ার কথা মনে থাকে না। এজন্য:
- বাথরুমের দরজায় সুন্দরভাবে দোয়ার পোস্টার লাগিয়ে দিন
- ওয়াশরুমের গেটের পাশে ছোট স্টিকার লাগিয়ে দিন: “দোয়া পড়েছেন তো?”
২. 👶 সন্তানদের শেখাতে শেখাতে নিজে আমল করুন
মা যখন নিজে দোয়া পড়ে ঢুকেন, তখন সন্তানরা দেখে শেখে। এভাবে আপনি শিক্ষক এবং আমলদার—দুটোই হবেন ইনশাআল্লাহ।
৩. 🧕 হায়েজ-নেফাসের সময়ও দোয়া পড়া জায়েয
এই সময়ে কুরআন তিলাওয়াত না করলেও হাদিসের দোয়া পড়া জায়েয। কাজেই এ সময়েও আপনি এই দোয়া আমল করতে পারেন—গোনাহের ভয় ছাড়াই।
৪. 🕰️ দোয়া ভুলে যাওয়া ঠেকাতে রুটিন বানান
– প্রতিদিন সকালে ১ মিনিট করে “দৈনন্দিন দোয়া” রিভিশন করুন
– চাইলে মোবাইলে রিমাইন্ডার দিয়ে রাখুন: “বাথরুমে ঢোকার দোয়া পড়ুন”
৫. 💼 বাইরে গেলে কী করবেন?
যদি আপনি বাজারে, হসপিটালে, অতিথির বাসায় বা অফিসে থাকেন:
- মনে মনে দোয়া বলুন (চুপচাপ)
- মোবাইলে সেভ করা দোয়াটা দেখে নিন
৬. 🎧 অডিওতে শোনার অভ্যাস করুন
আপনি কাজ করতে করতে বা রাঁধতে রাঁধতে মোবাইলে দোয়াগুলোর অডিও শুনতে পারেন। এতে মুখস্তও হবে, আমলও সহজ হবে।
৭. 🧕 “দোয়া কার্ড” বানিয়ে হ্যান্ডব্যাগে রাখুন
ছোট আকারের একটি দোয়া কার্ডে দৈনন্দিন দোয়ার মধ্যে বাথরুমের দোয়াও রেখে দিন। সময়মতো ব্যাগ থেকে বের করে দেখে নিতে পারবেন।
৮. 📱 মায়ের দোয়া শেখার এপস
আপনি চাইলে দোয়া শেখার অ্যাপ বা ইউটিউব চ্যানেল বেছে নিতে পারেন (যেমন: “Taleemul Quran for Women”, “Islamic Kids App” ইত্যাদি) যেগুলো নারীদের জন্য ফ্রেন্ডলি এবং আকর্ষণীয়।
আরো পড়ুন:
- আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল হুদা
- আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা হুব্বাকা ওয়া হুব্বা মান ইউহিব্বুক
- আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল হাম্মি
❓ জিজ্ঞাসা ও উত্তর
১. বাথরুমে ঢোকার সময় দোয়া পড়া কেন জরুরি?
✅ উত্তর: বাথরুম হচ্ছে অশুভ ও অপবিত্র জায়গা, যেখানে জ্বিন-শয়তানের উপস্থিতি থাকতে পারে। দোয়া পড়লে আল্লাহ আমাদের শয়তানের ক্ষতি থেকে রক্ষা করেন। এটি নবীজি (ﷺ) এর শিক্ষা।
২. দোয়াটি কী?
✅ উত্তর:
আরবি:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْخُبُثِ وَالْخَبَائِثِ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নী আউযু বিকা মিনাল-খুবসি ওয়াল-খবায়িছ
অর্থ: হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট আশ্রয় চাই পুরুষ ও মহিলা শয়তানদের থেকে।
৩. দোয়া না পড়ে যদি ভুলে বাথরুমে ঢুকে পড়ি, তাহলে কী করব?
✅ উত্তর: ভুলে গেলে গোনাহ হবে না। তবে স্মরণ হওয়ার পর তাওবা করা উচিত এবং ভবিষ্যতে সতর্ক থাকা উচিত। চাইলে মনে মনে বলেও নিতে পারেন।
৪. দোয়াটি কবে পড়তে হয়? বাথরুমে ঢোকার আগে, না ভেতরে গিয়ে?
✅ উত্তর: দোয়াটি পড়তে হয় বাথরুমে প্রবেশের ঠিক আগে, দরজার বাইরে, বাম পা ফেলার আগে।
৫. কি করে দোয়া শিশুকে শেখানো যায়?
✅ উত্তর:
– ছন্দে বা গানে শিখিয়ে দিন
– রঙিন পোস্টার টানিয়ে দিন
– অভিনয়ের মাধ্যমে শেখান
– প্রতিদিন অভ্যাস করান
(বিস্তারিত শিশুশিক্ষা সেকশনে দেখুন)
৬. কি দোয়া বাথরুম থেকে বের হওয়ার সময় পড়তে হয়?
✅ উত্তর:
আরবি:
غُفْرَانَكَ
উচ্চারণ: গুফরানাকা
অর্থ: আমি আপনার ক্ষমা প্রার্থনা করি।
৭. এই দোয়া কি মহিলারা পিরিয়ডের সময়েও পড়তে পারবেন?
✅ উত্তর: হ্যাঁ, বাথরুমে প্রবেশের দোয়া কুরআন নয়, বরং হাদিসে বর্ণিত দোয়া। তাই পিরিয়ডের সময় মহিলারা এই দোয়া পড়তে পারেন।
৮. এই দোয়া কি মুখে না বলে মনে মনে পড়া যাবে?
✅ উত্তর:
হ্যাঁ, দরকার হলে মনে মনে (চুপচাপ) পড়া যাবে। বিশেষত কেউ পাশে থাকলে বা মুখে বলা সম্ভব না হলে।
৯. মোবাইলে লেখা দোয়া দেখে পড়া যাবে কি?
✅ উত্তর: হ্যাঁ, দরকার হলে মোবাইল বা কাগজ দেখে পড়া যাবে। তবে মনে রাখা উত্তম।
১০. যদি কেউ বাংলায় দোয়া পড়ে, আরবি মুখস্থ না থাকে?
✅ উত্তর: প্রথমে বাংলা পড়া যেতে পারে বোঝার জন্য, তবে আস্তে আস্তে আরবি মুখস্থ করাই উত্তম ও পূর্ণফলপ্রাপ্তির পথ।
🔚 উপসংহার
একটি ছোট দোয়া—কিন্তু এর মাঝে লুকিয়ে আছে শয়তানের অনিষ্ট থেকে আত্মরক্ষা, ইবাদতের মনোভাব এবং জীবনের প্রতিটি দিককে আল্লাহর স্মরণে পূর্ণ রাখার চর্চা। আমাদের উচিত, এসব ছোট ছোট সুন্নত আমলগুলোকেও গুরুত্ব দিয়ে পালন করা, কারণ এগুলোই একজন মুসলমানকে আল্লাহর প্রিয় বানিয়ে তোলে।