ফ্রিল্যান্সিং কি হালাল? কুরআন হাদিস ও স্কলারদের মতামত

পোস্টটি শেয়ার করুন

বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং শব্দগুলি বিশ্ব বিস্তৃত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। উইকিপিডিয়া ইংলিশের তথ্য মতে বর্তমানে ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসে ১.৫৭ বিলিলয় মানুষ এই সেক্টরে কাজ করে। তাদের মধ্যথেকে প্রায় ৬ লক্ষ ৫০ হাজার বাংলাদেশী রয়েছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে প্রশ্ন আসে – ফ্রিল্যান্সিং কি হালাল বা আউটসোর্সিং সম্পর্কে ইসলাম কী বলে?

এই ব্লগে, আমরা ফ্রিল্যান্সিং হালাল কিনা তা নিয়ে বিশ্লেষণ করছি। কুরআন এবং সুন্নাহ ও স্কালারদের অভিমতের ভিত্তিতে আমরা এই বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব। ইন শা আল্লাহ।

ফ্রিল্যান্সিং কি হালাল?

হ্যাঁ, ফ্রিল্যান্সিং হালাল। ইসলামিক নিয়ম মেনে অর্থ উপার্জনের জন্য ফ্রিল্যান্স সেক্টরে অনেকগুলি উপায় এবং উপকরণ রয়েছে। যেমন গ্রাফিক ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং, ভিডিও ইডিটিং ইত্যাদি। তবে অন্য সকল বিষয়ের মতো ফ্রিল্যান্সিং তখন হারাম হবে যখন সেখানে এমন কোনো সার্ভিস প্রভাইড করা হবে যেটা ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। অথবা মিথ্যা তথ্য ও প্রতারণা ইত্যাদি করা হবে।

হালাল ফ্রিল্যান্স স্কিল

  • কন্টেন্ট : ওয়েবসাইট, ব্লগ বা সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য আকর্ষণীয় এবং তথ্যমূলক কন্টেন্ট তৈরি। তবে এমন কোনো ব্লগপোস্ট তৈরি করা যাবে না যেটা হারাম। যেমন মিথ্যা তথ্য বা যৌনতামূলক গল্প ইত্যাদি।
  • গ্রাফিক ডিজাইন: ক্লায়েন্টদের জন্য দৃষ্টি আকর্ষণীয় গ্রাফিক্স, লোগো এবং অন্যান্য ভিজ্যুয়াল কন্টেন্ট ডিজাইন করা। তবে অশ্লীল কোনো ডিজাইন করা যাবে না।
  • ওয়েব ডিজাইন: ব্যক্তি বা ব্যবসায়ের জন্য ওয়েবসাইট তৈরির কাজও করা যাবে। এটা সম্পূর্ণ হালাল। তবে এডাল্ট বা বেটিং টাইপের সাইট তৈরি করে দিয়ে ইনকাম করা যাবে না।
  • ডিজিটাল মার্কেটিং: যে কোনো হালাল পণ্যের বিজ্ঞাপন তৈরি ও প্রচারে করা যাবে। তবে হারাম পণ্য যেমন মদ বা জুয়ার বার ইত্যাদি।
  • অনুবাদ পরিষেবা: নথি, ওয়েবসাইট বা অন্যান্য সামগ্রীর জন্য অনুবাদ পরিষেবা এজেন্সিও করা যেতে পারে।
  • সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট: ক্লায়েন্টদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট পরিচালনা ও কন্টেন্ট তৈরি করা যাবে।
  • ই-কমার্স ম্যানেজমেন্ট: পণ্য তালিকা এবং গ্রাহক পরিষেবা সহ তাদের অনলাইন স্টোরগুলি পরিচালনায় ব্যবসায়ীদের সহায়তা করা যাবে।

কেবল এই স্কিলগুলো নয় বরং যে কোনো কাজ করা যাবে ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে। তবে কেবল আপনাকে মনে রাখতে হবে যে কাজটি করছেন সেটা ইসলামে হালাল কী না নেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

হালাল উপায়ে ফ্রিল্যান্সিং কীভাবে করবেন?

ফ্রিল্যান্সিং বলা হয় – একটি মক্ত পেশা। কারণ এখানে, একজন ফ্রিল্যান্সার কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থার অধীনস্থ নয়। তিনি তার ক্রেতার কাছে যে কোনও ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসে, যে কোনও সময় তার পরিষেবাগুলি বিক্রি করতে পারেন, তার ক্রেতারা জন্য কোনো দেশের সীমায় সীমাবদ্ধ নয়।

সুতরাং প্রতিদিন তার জন্য কাজ করা প্রয়োজন হয় না। তিনি সপ্তাহের যে কোনও দিন কাজ করতে পারেন। আবার, যেদিন মন কাজ বন্ধ করতে চায়। এ কারণেই একে ফ্রিল্যান্সিং বলা হয়।

আউটসোর্সিং কী: অন্য পক্ষ – অর্থাৎ যারা কাজ করিয়ে নিচ্ছেন তাদের পক্ষ থেকেই এই কাজকে আউটসোর্সিং বলে। কেননা তারা তাদের প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বা অধস্তন কর্মীদের বাইরে থেকে কাজটি করিয়ে নিচ্ছেন। সুতরাং তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই কাজটি আউটসোর্সিং বলা হয়। একই কাজকে দুটি ব্যক্তির দুটি দিক বিবেচনা করে দুটি নাম দ্বারা ডাকা হচ্ছে।

তবে এখানে আরো কিছু প্রশ্ন রয়েছে যা ফ্রিল্যান্সিং হারাম ও হালাল হওয়ার বিষয়টি বুঝার জন্য জরুরী। আমরা নীচে এটি বিস্তারিত আলোচনা করছি।

আউটসোর্সিং সেক্টরে কী হালাল কাজ পাওয়া যায়?

ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসে ক্যাটাগরি এবং সাব-ক্যাটাগরিতে বিভক্ত একটি অগণিত কাজ রয়েছে। এ থেকে ক্রেতা যে কোনও ফ্রিল্যান্সারের সাথে তার নির্দিষ্ট কাজটি করতে পারে।

ইসলাম মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ কোনো কাজ আমি এই সমস্ত ক্যাটাগরি বা সাব-ক্যাটাগরিতে দেখিনি। যেহেতু এই কাজগুলি মৌলিকভাবে হারাম নয়, তাই ইসলাম এ সকল কাজ দ্বারা আয়-উপার্জন করতে নিষেধ করে না। বিপরীতে, ইসলাম মানুষের শ্রমের মাধ্যমে আয় উপার্জনের প্রশংসা করে।

ফ্রিল্যান্স কাজ গ্রহণ এবং জমা দেওয়ার পন্থা

ফ্রিল্যান্স-মার্কেটপ্লেস হচ্ছে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ পাওয়ার এবং অফার করার প্রাথমিক মাধ্যম। এই মার্কেটপ্লেসগুলি মূলত বিক্রেতা এবং ক্রেতাদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করে এবং কাজ এবং অর্থ প্রদানের মধ্যে মধ্যস্থতা করে।

তবে মার্কেটপ্লেসের বাইরে থেকে প্রচুর কাজ পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে বিক্রেতা এবং ক্রেতা কাজ করে। সেখানে যেহেতু তারা সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাস অর্জনের পরে কাজ করে, তাই মজুরি হারানোর খুব বেশি সম্ভাবনা নেই।

মার্কেটপ্লেসগুলির নীতিমালা এবং শর্তগুলি সুস্পষ্ট, তাই বিক্রেতা বা ক্রেতা উভয়ই সহজেই কাউকে প্রতারণা করতে পারে না। আপনি যদি মার্কেটপ্লেসগুলির গোপনীয়তা নীতিগুলি বুঝতে চান তবে আপনি তাদের নীতিটি ফাইভার এবং আপওয়ার্ক থেকে দেখতে পারেন।

ইসলাম অর্থনীতিক ক্ষেত্রে এমন সমস্ত পন্থা নিষিদ্ধ করে, যেখানে ক্রেতা এবং বিক্রেতার মধ্যে বিরোধের সম্ভাবনা রয়েছে বা উভয় পক্ষের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসগুলিতে সেই সম্ভাবনা নেই। সুতরাং ইসলামিক আইন অনুসারে ফ্রিল্যান্সিং এবং আউটসোর্সিংকে বৈধ বলতে কোনো আপত্তি নেই।

ফ্রিল্যান্সিং অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা কি হালাল?

হ্যাঁ, ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেসে অর্থ প্রদানের ব্যবস্থাটি হালাল। ইসলামে অর্থনীতি আইনের আরেকটি মৌলিক দিক হ’ল পণ্য এবং এর দামের যথার্থতা। ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে, পণ্যটি একটি ফ্রিল্যান্সারের কাজ, যা আগে আলোচনা করা হয়েছিল। এবং দাম হ’ল কাজের মজুরি।

মার্কেটপ্লেসে কাজের শুরুতে, বিক্রেতা এবং ক্রেতা কাজের শর্তাদি বিশদ নিয়ে আলোচনা করেন। অতএব, এই দৃষ্টিকোণ থেকে কাজটি অবৈধ বলে বলার মতো কোনও উত্স নেই।

বাকিগুলি হ’ল অর্থ প্রদান এবং গ্রহণযোগ্যতা সিস্টেম। মার্কেটপ্লেসে প্রতিটি ক্রেতা এবং বিক্রেতার একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। আপনি সেখান থেকে সহজ উপায়ে অর্থ বিনিময় করতে পারেন। তারপরে আপনার অর্থ স্থানীয় ব্যাংকে স্থানান্তর করা সম্ভব। সুতরাং এখানে কোনও জটিলতা নেই।

ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে স্কলারদে মতামত

ইসলামিক স্কলারগণ ফ্রিল্যান্সিংকে হালাল বলে এবং তাদের মতামতকে সমর্থনকারী আয়াত ও হাদিস রেফারেন্স দিয়েছেন।

ফ্রিল্যান্সিং হালাল
ফ্রিল্যান্সিং হালাল

আল্লাহ বলেছেন,

‘হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। আর তোমরা নিজেরা নিজদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু। ’ ( সুরা নিসা – ২৯ )

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

‘নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কখনো কেউ খায় না। আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন।। ‘(সাহিহ বুখারি – ২০৭২২)

শায়খুল-ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

“وأما إن كان العوض مما يحصل من العمل: جاز أن يكون جزءا شائعا فيه كما لو قال الأمير في الغزو: من دلنا على حصن كذا فله منه كذا” انتهى من “مجموع الفتاوى” (29/105)

“কাজের ফলে যে প্রতিদান পাওয়া যাবে, তা যদি কাজের অংশ হিসেবেই নির্ধারণ করা হয়, তাহলে এটি বৈধ। যেমন আমির যুদ্ধের সময় বলেছিলেন: ‘যে আমাদের অমুক দুর্গের সন্ধান দেবে, তার জন্য ওই দুর্গের থেকে অমুক অংশ থাকবে।’ (মাজমু’ আল-ফাতাওয়া, খণ্ড ২৯, পৃষ্ঠা ১০৫)

উত্তরের সংক্ষিপ্তসার

সমস্ত দিক বিবেচনা করে – আউটসোর্সিং বা ফ্রিল্যান্সিং হালাল রয়েছে বিপরীতে, যদি ফ্রিল্যান্সিং হালালের গাইডলাইন মেনে কাজটি করা হয় তবে এটি প্রশংসনীয়ও। তবে, মনে রাখতে হবে অফলাইন কর্মক্ষেত্রে যা কিছু অবৈধ তা অনলাইন কর্মক্ষেত্রেও তা অবৈধ।

আপনি যদি ব্যবসা করতে চান বা অফলাইনে হালাল উপায়ে কাজ করতে চান তবে আপনাকে অবশ্যই হালাল হওয়ার সমস্ত শর্ত মেনে চলতে হবে যেমন একটি প্রতারণামূলক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা ইত্যাদি, এমনকি অনলাইন। যেমন নগ্ন বা অর্ধ-নগ্ন চিত্র বা ক্লিপ সহ ভিডিও তৈরি করা। তারা মহিলা শরীরকে প্রদর্শন করে ব্যানার তৈরি।

অশ্লীল ফটো সহ গ্রাফিক্স ডিজাইন। প্রাপ্তবয়স্কদের ডেটিং বা পর্ন সাইট বিকাশ। এই কাজগুলো গ্রহণ করা যাবে না, কারণ এটি ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে।

কিছু প্রশ্ন উত্তর

ইসলামে ফ্রিল্যান্সিংয়ের অনুমতি সম্পর্কে মূল কারণগুলি কী কী?

ইসলামে ফ্রিল্যান্সিংয়ের অনুমতি কাজের প্রকৃতি, চুক্তির শর্তাদি, ক্লায়েন্টের চাহিদা এবং ফলাফলের সাথে সম্পর্কিত নৈতিক প্রভাব সহ বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভর করে।

কোন ধরণের ফ্রিল্যান্সিং কাজ সাধারণত হালাল হিসাবে বিবেচিত হয়?

বেশিরভাগ ক্যাটাগরির ফ্রিল্যান্সিং কাজ যেমন গ্রাফিক ডিজাইন, লেখার, প্রোগ্রামিং, অনুবাদ, পরামর্শ এবং অন্যান্য পেশাদার পরিষেবাগুলি সাধারণত হালাল হিসাবে বিবেচিত হয়। কারণ তারা ক্লায়েন্টদের দক্ষতা এবং দক্ষতা সরবরাহ করে।

ইসলামে হারাম হিসাবে বিবেচিত হতে পারে এমন কোনও নির্দিষ্ট ফ্রিল্যান্স কাজ রয়েছে?

কিছু ফ্রিল্যান্স কাজ যা ইসলামে সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ, যেমন জুয়া, সুদ-ভিত্তিক আর্থিক পরিষেবা, হারাম পণ্য উত্পাদন বা প্রচার করা বা জালিয়াতিমূলক ক্রিয়াকলাপে জড়িত হওয়া।


পোস্টটি শেয়ার করুন