ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। কুরআন ও হাদিস মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি দিককে সুশৃঙ্খল ও কল্যাণকরভাবে পরিচালনা করে। ইবাদত-বন্দেগির ক্ষেত্রেও নির্দেশনা অত্যন্ত স্পষ্ট। ওযু হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ওযু হলো নামাজসহ অন্যান্য ইবাদতের পূর্বশর্ত। তবে ওযু ভঙ্গের কারণগুলো নিয়ে অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে। রয়েছে অনেক প্রশ্ন। এ রকম একটি প্রশ্ন হলো: “গালি দিলে কি ওযু ভেঙে যায়?” এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের কুরআন, হাদিস, এবং ফিকহের কিতাবগুলো থেকে বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে।
গালি দিলে কি ওযু ভেঙে যায়?
না, গালি দিলে ওযু ভেঙে যায় না। তবে গালি দেওয়া ইসলামে একটি গুরুতর নৈতিক অপরাধ এবং এটি আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ হতে পারে। তবে, কুরআন, হাদিস এবং ফিকহের কিতাবগুলোতে গালি দেওয়ার কারণে ওযু ভঙ্গ হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। সুতরাং, গালি দিলে ওযু ভঙ্গ হয় না। তবে, গালি দেওয়া থেকে বিরত থাকা একজন মুমিনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এ ধরনের আচরণের জন্য আল্লাহর কাছে তাওবা করা উচিত।
ইমামদের অভিমত
বিভিন্ন মাযহাবে ওযু ভঙ্গের কারণগুলো সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। তবে গালি দেওয়া ওযু ভঙ্গের অন্তর্ভুক্ত কিনা, এ বিষয়ে ইমামদের অভিমত জানা থাকা ভালো। নিচে গুরুত্বপূর্ণ চার মাজহাবের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হলো:
১. হানাফি মাজহাব
হানাফি মাজহাবে, ওযু ভঙ্গের কারণগুলো শারীরিক বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। উদাহরণস্বরূপ, পেশাব, পায়খানা, বমি, বা রক্তপাত। গালি দেওয়া একটি মৌখিক ও নৈতিক অপরাধ, যা ওযু ভঙ্গের কারণ নয়। তবে এটি একটি বড় গুনাহ এবং এর জন্য আল্লাহর কাছে তাওবা করা আবশ্যক।
২. শাফেঈ মাজহাব
শাফেঈ মাজহাবে, ওযু ভঙ্গের কারণ হিসেবে শারীরিক নিষ্কাশনের ওপর জোর দেওয়া হয়। গালি দেওয়ার কারণে ওযু ভাঙে না। তবে এটি ব্যক্তির ঈমান এবং চরিত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
৩. মালিকি মাজহাব
মালিকি মাজহাবে, ওযু ভঙ্গের বিষয়টি বেশিরভাগ শারীরিক বিষয়ের সাথে যুক্ত। গালি দেওয়ার কারণে ওযু ভাঙার কোনো দলিল নেই। তবে এটি একটি গুরুতর নৈতিক অপরাধ।
৪. হাম্বলি মাজহাব
হাম্বলি মাজহাবে, শারীরিক নিষ্কাশন ব্যতীত কোনো মৌখিক কাজ, যেমন গালি দেওয়া, ওযু ভঙ্গের অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে এটি ইসলামের শিষ্টাচার লঙ্ঘনের একটি উদাহরণ।
কুরআন যা বলে
কুরআনে গালি দেওয়া এবং অন্যকে কষ্ট দেওয়ার বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা রয়েছে। যদিও ওযু ভঙ্গের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। গালি দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা উল্লেখিত হয়েছে:
“আর যারা মুমিনদের মধ্যে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়, তারা গুরুতর গুনাহের বোঝা বহন করছে।” – (সূরা আহযাব: ৫৮)
“তোমরা সৎকাজের আদেশ দাও এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করো।” – (সূরা তাওবা: ৭১)
এছাড়াও গালি দেওয়া শয়তানের কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে গালি দেওয়া একটি বড় পাপ। এটি আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ হতে পারে।
হাদিস যা বলে
হাদিসে গালি দেওয়ার কুফল এবং এটি থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা পাওয়া যায়।
“মুসলিম হলো সে ব্যক্তি, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে।” – (সহিহ বুখারি: ৬৪৮৪)
“গালি দেওয়া ফাসেকি এবং কারো সঙ্গে যুদ্ধ করা কুফরি।”
– (সহিহ বুখারি: ৪৮)
এই হাদিসগুলো থেকে বোঝা যায়, গালি দেওয়া ঈমানের দুর্বলতার লক্ষণ। তবে এটি ওযু ভঙ্গের কারণ নয়।
হানাফি মাযহাবে ওযু ভাঙার ৭টি কারণ
১. পায়খানা বা প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে কিছু বের হওয়া
- যেমন: বায়ু, প্রস্রাব, পায়খানা, পোকা ইত্যাদি।
- দলিল: সুরা মায়িদা, আয়াত ৬। এতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “যদি তোমরা অপবিত্র হও, তবে সারা দেহ পবিত্র করে নাও…”
২. রক্ত, পুঁজ বা পানি বের হয়ে গড়িয়ে পড়া
- যেমন, নাক থেকে রক্ত পড়া বা শরীরের অন্য কোথাও রক্ত বা পুঁজ বের হওয়া।
- দলিল: হাদিস: “আবদুল্লাহ বিন উমর (রা.)-এর যখন নাক দিয়ে রক্ত ঝড়ত, তখন তিনি ফিরে গিয়ে অজু করে নিতেন।” (মুয়াত্তা মালিক)
৩. মুখ ভরে বমি করা
- দলিল: “যে ব্যক্তির বমি হয়, তাকে ফিরে গিয়ে অজু করতে হবে।” (সুনানে ইবনে মাজাহ)
৪. থুতুর সঙ্গে রক্তের ভাগ সমান বা বেশি হওয়া
- যদি থুতুর মধ্যে রক্ত প্রবল হয়ে যায়, তাহলে ওযু ভেঙে যাবে।
- দলিল: “যে ব্যক্তি তার থুতুতে রক্ত দেখে, তবে অজু করা আবশ্যক।” (মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা)
৫. চিত বা কাত হয়ে ঘুমানো
- যখন কেউ চিত হয়ে ঘুমায়, তখন শরীর ঢিলে হয়ে যাওয়ার কারণে ওযু ভাঙে।
- দলিল: “চিত হয়ে শুয়ে পড়লে ওযু ভেঙে যায়…” (মুসনাদে আহমাদ, সুনানে আবু দাউদ)
৬. পাগল, মাতাল বা অচেতন হওয়া
- যদি কেউ পাগল, মাতাল বা অচেতন থাকে, তখন তার ওযু ভেঙে যায়।
- দলিল: “যখন পাগল ব্যক্তি সুস্থ হয়, তখন তাকে আবার অজু করতে হবে।” (মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক)
৭. নামাজে উচ্চ স্বরে হাসা
- যদি কেউ নামাজে উচ্চ স্বরে হাসে, তবে তার ওযু এবং নামাজ পুনরায় আদায় করতে হবে।
- দলিল: “যে ব্যক্তি নামাজে উচ্চ স্বরে হাসে, সে অজু ও নামাজ পুনরায় আদায় করবে।” (সুনানে দারা কুতনি)
সারাংশ
গালি দেওয়া একটি গুরুতর নৈতিক অপরাধ এবং এটি আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ হতে পারে। তবে কুরআন, হাদিস এবং ফিকহের কিতাবগুলোতে এর দ্বারা ওযু ভঙ্গ হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। মুসলমানদের উচিত গালি দেওয়া থেকে বিরত থাকা এবং নিজেদের চরিত্র উন্নত করার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা।
প্রশ্নাবলী
প্রশ্ন ১: গালি দিলে কি নামাজ নষ্ট হয়ে যায়?
উত্তর: গালি দেওয়া নামাজ নষ্ট করে না। তবে এটি গুনাহের কাজ এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।
প্রশ্ন ২: গালি দেওয়ার জন্য কি নতুন করে ওযু করতে হবে?
উত্তর: না, গালি দেওয়ার কারণে ওযু ভাঙে না। তবে এটি একটি পাপ কাজ, তাই তাওবা করা আবশ্যক।
প্রশ্ন ৩: ওযু ভঙ্গের প্রধান কারণগুলো কী কী?
উত্তর: ওযু ভঙ্গের প্রধান কারণ হলো পেশাব, পায়খানা, বমি, ঘুম, রক্তপাত, এবং অন্য কোনো শারীরিক নিষ্কাশন।
প্রশ্ন ৪: গালি দেওয়ার জন্য কী শাস্তি হতে পারে?
উত্তর: গালি দেওয়া একটি বড় গুনাহ। এটি দুনিয়াতে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করে এবং আখিরাতে আল্লাহর শাস্তির কারণ হতে পারে।
উপসংহার
ইসলামের দৃষ্টিতে গালি দেওয়া একটি গুরুতর নৈতিক অপরাধ। যদিও এটি ওযু ভঙ্গের কারণ নয়, এটি থেকে বিরত থাকা একজন মুমিনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। গালি থেকে নিজেকে বিরত রাখতে এবং চরিত্রকে সুন্দর করতে আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে শিষ্টাচার বজায় রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।