ইন্নাল্লাহা বাসিরুন বিল ইবাদ । অর্থ । ব্যাখ্যা । গুরুত্ব ও একটি গল্প

পোস্টটি শেয়ার করুন

পবিত্র গ্রন্থ কুরআনে বহুবার আল্লাহর গুণাবলী ও তাঁর সর্বজ্ঞান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে “ইন্নাল্লাহা বাসিরুন বিল ইবাদ” (নিশ্চয়ই আল্লাহ বান্দাদের প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টি রাখেন) আয়াতটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এটি মানুষের জীবনে আল্লাহর পরিচর্যা ও অভিভাবকত্বের একটি সুস্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে। এই ব্লগপোস্টে আমরা এই আয়াতের তাৎপর্য, এর বাস্তব জীবনে প্রভাব, এবং প্রাসঙ্গিক প্রশ্নোত্তর নিয়ে আলোচনা করব।

ইন্নাল্লাহা বাসিরুন বিল ইবাদ অর্থ কি?

আরবি:

(إِنَّ اللَّهَ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ)

উচ্চারণ: ইন্নাল্লাহা বাসিরুন বিল ইবাদ।

অর্থ: “নিশ্চয়ই আল্লাহ বান্দাদের প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টি রাখেন।”

এটি আল্লাহর সর্বজ্ঞতা এবং সর্বদর্শিতার পরিচায়ক। এই বাক্যটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে আল্লাহ আমাদের প্রতিটি কাজ, চিন্তা ও অভিপ্রায় সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত। তাঁর দৃষ্টি থেকে কিছুই লুকানো নেই। এটি আমাদেরকে সৎ পথে চলতে এবং গোপন ও প্রকাশ্য সব কাজে সতর্ক থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। পাশাপাশি, এটি আল্লাহর ন্যায়বিচার এবং অভিভাবকত্বের প্রতীক, যা বান্দাদের হৃদয়ে সাহস ও শান্তি যোগায়।

পরিপূর্ণ আয়াত

فَسَتَذۡکُرُوۡنَ مَاۤ اَقُوۡلُ لَکُمۡ ؕ وَ اُفَوِّضُ اَمۡرِیۡۤ اِلَی اللّٰہِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ بَصِیۡرٌۢ بِالۡعِبَادِ ﴿۴۴

অর্থ: ‘আমি তোমাদেরকে যা বলছি, অচিরেই তোমরা তা স্মরণ করবে। আর আমার বিষয়টি আমি আল্লাহর নিকট সমর্পণ করছি; নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে সর্বদ্রষ্টা।’ ( সুরা গাফির- আয়াত :৪০)

আয়াতের ব্যাখ্যা

আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের সব কাজ দেখেন এবং তাঁদের অন্তরের অবস্থা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখেন। তিনি জানেন কে হিদায়াতের যোগ্য এবং কাকে হিদায়াত প্রদান করা উচিত। তাঁর অসীম প্রজ্ঞা ও কৌশলে তিনি প্রত্যেকের প্রাপ্য অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যারা সত্যের সন্ধানী, আল্লাহ তাদের জন্য সঠিক পথ সহজ করেন। অন্যদিকে, যারা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদের জন্য ভ্রষ্টতা নির্ধারিত হয়। এ ব্যবস্থার পেছনে আল্লাহর এক অপার হিকমত রয়েছে, যা মানুষের জ্ঞানের বাইরে। তাঁর এই ন্যায়বিচার এবং প্রজ্ঞা মানবজীবনে সৎপথে চলার প্রেরণা যোগায়।

  • আল্লাহ সবকিছু জানেন: আমাদের প্রতিটি কাজ, কথা এবং ইচ্ছা আল্লাহর দৃষ্টিতে স্পষ্ট।
  • গোপনীয়তা বলতে কিছু নেই: আল্লাহ আমাদের অন্তরের খবর জানেন।
  • উদ্বুদ্ধ করা: এই জ্ঞান আমাদের ভালো কাজের জন্য অনুপ্রাণিত করে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে।
ইন্নাল্লাহা বাসিরুন বিল ইবাদ
ইন্নাল্লাহা বাসিরুন বিল ইবাদ

এই আয়াতের গুরুত্ব

১. আল্লাহর সর্বজ্ঞান

“إِنَّ اللَّهَ بَصِيرٌ” বলে বোঝানো হয়েছে যে, আল্লাহ আমাদের বাহ্যিক কর্ম ও অভ্যন্তরীণ চিন্তাধারার সবকিছুই জানেন। এটি আমাদের দায়িত্বশীলতার অনুভূতি জাগ্রত করে।

২. আল্লাহর অভিভাবকত্ব

আল্লাহর দৃষ্টি শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণের জন্য নয়, বরং আমাদের সহায়তা এবং অভিভাবকত্বের জন্য। এটি বিশ্বাসীদের অন্তরে একটি আশ্বাস দেয় যে তারা কখনোই একা নয়।

৩. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা

এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আল্লাহ ন্যায়পরায়ণ। তাঁর দৃষ্টি থেকে কিছুই লুকানো নেই, তাই তিনি পরিপূর্ণ ন্যায়বিচারকারী।

বাস্তব জীবনে প্রয়োগ

  • আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি: আমাদের কর্ম এবং চিন্তা সবকিছু আল্লাহর জ্ঞানের আওতায় রয়েছে জেনে আমরা আরও আত্মসচেতন হতে পারি।
  • ধৈর্য ধারণ: বিপদের সময়ে এই আয়াত আমাদের ধৈর্য ধরতে সাহায্য করে। আমরা জানি যে, আল্লাহ আমাদের অবস্থা দেখছেন এবং আমাদের কষ্টের পুরস্কার দেবেন।
  • সৎ পথে চলা: এটি আমাদের অনুপ্রাণিত করে সবসময় সৎ পথে চলতে এবং গোপনে বা প্রকাশ্যে অন্যায় থেকে বিরত থাকতে।

আরো পড়ুন:

প্রাসঙ্গিক হাদিস

এই একটি প্রশ্নের উত্তর। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কিছু সাহাবীদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তখন তারা বললেন: “হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের রব কি আমাদের নিকটবর্তী, যেন আমরা তাকে নিঃশব্দে ডাকি? নাকি তিনি দূরে, যেন আমরা তাকে উচ্চস্বরে ডাকি?” তখন আল্লাহ এই আয়াত অবতীর্ণ করেন:

{আর যখন আমার বান্দারা আমার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, (তাদের বল) আমি তো নিকটেই আছি।} (সূরা বাকারা: ১৮৬)।

কারণ আল্লাহ তাআলা সবকিছুর প্রতি পর্যবেক্ষণকারী, গোপন বিষয় এবং এর চেয়েও লুকানো বিষয় সম্পর্কে অবগত। তিনি জানেন চোখের চুরি এবং অন্তরের গোপন কথা। তিনি তাঁর ডাকনেওয়ালার কাছেও নিকটবর্তী, আর তাই তিনি বলেন: {আমি প্রার্থনাকারীর প্রার্থনার জবাব দিই, যখন সে আমাকে ডাকে।} (সূরা বাকারা: ১৮৬)।

দোয়া দুই প্রকারের হয়:

১. ইবাদতের দু’আ (উপাসনা হিসেবে আল্লাহকে স্মরণ করা)।
২. মাসআলার দু’আ (আল্লাহর কাছে কোনো কিছু চাওয়া বা প্রার্থনা করা)।

একটি বাস্তব উদাহরণ

মোহাম্মদ নামে একজন যুবক, যিনি একবার একটি পেয়ারার বাগানে কাজ করতেন। একদিন তিনি খুব ক্ষুধার্ত হয়ে একটি পেয়ারা খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু তার মনে হয়, “আল্লাহ আমাকে দেখছেন।” এরপর তিনি সেই পেয়ারা না খেয়ে মালিকের অনুমতি নেন। তার এই সততা দেখে মালিক তাকে তার ব্যবসার দায়িত্ব দেন। এটি আমাদের শেখায় যে, আল্লাহর দৃষ্টি সবসময় আমাদের উপর থাকে, যা আমাদের সৎ পথে থাকতে সাহায্য করে।

প্রাসঙ্গিক প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১: এই আয়াতটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলে?

উত্তর: এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা সবসময় আল্লাহর দৃষ্টির আওতায় রয়েছি। এটি আমাদের কর্ম ও চিন্তায় সৎ থাকতে উৎসাহিত করে।

প্রশ্ন ২: আল্লাহর দৃষ্টি কীভাবে আমাদের কাজের গুণমান উন্নত করতে পারে?

উত্তর: যখন আমরা বুঝতে পারি যে আল্লাহ আমাদের কাজ দেখছেন, তখন আমরা প্রতিটি কাজ সততা এবং নিষ্ঠার সাথে সম্পন্ন করতে চেষ্টা করি।

প্রশ্ন ৩: আল্লাহর দৃষ্টির ধারণা কেন ন্যায়বিচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?

উত্তর: আল্লাহর দৃষ্টি সর্বজনীন এবং নিরপেক্ষ। তিনি সবকিছু দেখেন এবং জানেন, তাই তাঁর ন্যায়বিচারে কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই।

প্রশ্ন ৪: কীভাবে আমরা এই আয়াত থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে মন্দ কাজ এড়াতে পারি?

উত্তর: এই আয়াত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আল্লাহর দৃষ্টিতে কিছুই গোপন নয়। এই সচেতনতা আমাদের অন্যায় কাজ থেকে দূরে রাখে।

উপসংহার

“ইন্নাল্লাহা বাসিরুন বিল ইবাদ” আয়াতটি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর পর্যবেক্ষণ এবং দায়িত্বশীলতার গুরুত্ব তুলে ধরে। এটি আমাদের সৎ পথে চলতে এবং আল্লাহর ন্যায়বিচারের উপর আস্থা রাখতে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে এই আয়াতের শিক্ষাগুলো প্রয়োগ করলে আমরা আরও সুশৃঙ্খল, সৎ এবং আল্লাহভীরু হতে পারি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আমিন।


পোস্টটি শেয়ার করুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x