ইন্নি ওয়াজ্জাহাতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস । তাওহিদের মহৎ ঘোষণা

Share this post

ইসলাম ধর্মে তাওহিদ বা একত্ববাদের ধারণাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাওহিদ বলতে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করাকে বোঝায়, যা মুসলমানদের ঈমানের ভিত্তি। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে এই তাওহিদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এর মধ্যে একটি শক্তিশালী ঘোষণা হলো “إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ” ইন্নি ওয়াজ্জাহাতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস…। (সূরা আনআম: ৭৯)।

এই আয়াতটি নবী ইবরাহিম (আ.)-এর একটি ঘোষণা, যা মুসলমানদের জন্য তাওহিদের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বহন করে। এই ব্লগপোস্টে আমরা আয়াতটির ব্যাখ্যা, গুরুত্ব ও আমাদের জীবনে এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবো।

ইন্নি ওয়াজ্জাহাতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস । এটি কীসের দোয়া

দোয়াটি হলো নফল নামাজের নিয়তের দোয়া। এটি মূলত নামাজের শুরুতে নিয়ত প্রকাশের জন্য পড়া হয়ে থাকে।

দোয়া:

إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ

উচ্চারণ: ইন্নি ওয়াজ্জাহাতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাঁ ওয়া মা আনা মিনাল মুশরিকীন।

অর্থ: “নিশ্চয়ই আমি আমার মুখমণ্ডল সেই সত্তার দিকে ফিরিয়ে নিলাম, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন একনিষ্ঠভাবে, এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।” (সূরা আল-আনআম: ৭৯)

এটি অনেক সময় তাকবীরে তাহরিমার পর সানা (সুবহানাকাল্লাহুম্মা…) দোয়ার পরিবর্তে পড়া হয়, তবে এটি পড়া আবশ্যক নয়।

আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যা

এই আয়াতের অর্থ হলো:

“নিশ্চয়ই আমি আমার মুখ সেই সত্তার প্রতি ফিরিয়ে নিয়েছি, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন একনিষ্ঠভাবে, এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।”

নবী ইবরাহিম (আ.) ছিলেন তাওহিদের এক মহান পথপ্রদর্শক। তিনি মুশরিকদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি একমাত্র আল্লাহর দিকেই নিজেকে নিবেদন করেছেন। এই আয়াতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে:

  • “إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ” – অর্থাৎ, আমি আমার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। এখানে ‘মুখ’ বলতে উদ্দেশ্য, দৃষ্টি বা লক্ষ্য বোঝানো হয়েছে। ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর প্রতি পূর্ণ মনোনিবেশ করেছেন।
  • “لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ” – তিনি সেই সত্তার দিকে মনোনিবেশ করেছেন যিনি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এর মাধ্যমে বোঝানো হয় যে, প্রকৃত ইলাহ (উপাস্য) একমাত্র আল্লাহই।
  • “حَنِيفًا” – এই শব্দটি একনিষ্ঠতা ও সরলতা বোঝায়। ইবরাহিম (আ.) দ্বিধাহীনভাবে একমাত্র আল্লাহকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
  • “وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ” – তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নন, অর্থাৎ তিনি কোনোভাবেই শিরক করেন না। এই বাক্যটি তাওহিদের পূর্ণতা প্রকাশ করে।

আয়াতের গুরুত্ব

১. তাওহিদের শিক্ষা: এই আয়াত আমাদের শিখায় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা উচিত নয়।

২. নবী ইবরাহিম (আ.)-এর অনুসরণ: কুরআনে ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনকে মুসলমানদের জন্য আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

৩. শিরক থেকে বাঁচার শিক্ষা: আমরা যেন কোনোভাবেই শিরকের পথে না যাই, সেটাই এই আয়াতের অন্যতম শিক্ষা।

৪. আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা: জীবনের প্রতিটি কাজে আমাদের একমাত্র আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হতে হবে।

আমাদের জীবনে এর বাস্তব প্রয়োগ

  • নামাজে খুশু-খুজু বজায় রাখা: প্রতিটি ইবাদতে আমাদের মনোযোগ আল্লাহর দিকে নিবদ্ধ করতে হবে।
  • আল্লাহর ওপর নির্ভর করা: কোনো সংকট আসুক বা শান্তির সময় আসুক, আমাদের কেবল আল্লাহর ওপরই ভরসা করতে হবে।
  • শিরক থেকে দূরে থাকা: আমরা যেন নিজেদের কর্ম ও চিন্তাধারায় সম্পূর্ণরূপে তাওহিদের পথে চলতে পারি।

নামাজে “ইন্নি ওয়াজ্জাহাতু ওয়াজহিয়া …” দোয়া পড়ার প্রয়োজনীয়তা ও উৎস

📌 প্রয়োজনীয়তা:

এই দোয়াটি মূলত নামাজ শুরুর পর তাকবীরে তাহরিমার পর সানা পড়ার বিকল্প হিসেবে পড়া যেতে পারে। তবে এটি আবশ্যক নয়, বরং একটি নফল আমল

✅ এই দোয়াটি পড়ার মাধ্যমে বান্দা নিজের মনোযোগ ও ইখলাসের (একনিষ্ঠতার) প্রকাশ ঘটায় যে, সে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নামাজ আদায় করছে এবং সকল শিরক থেকে মুক্ত।

✅ এই দোয়ায় ইব্রাহীম (আ.)-এর তাওহিদের ঘোষণা রয়েছে, যা নামাজের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে।

📌 উৎস (হাদিস থেকে প্রমাণ)

এই দোয়াটি কুরআনের সূরা আল-আনআম (৬:৭৯) আয়াতের অংশ।

📖 আল্লাহ বলেন:

إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ

“নিশ্চয়ই আমি আমার মুখমণ্ডল সেই সত্তার দিকে ফিরিয়ে নিলাম, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন একনিষ্ঠভাবে, এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।”
(সূরা আল-আনআম: ৭৯)

এছাড়াও, হাদিসে নবী (ﷺ) থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, তিনি নামাজের শুরুতে বিভিন্ন দোয়া পড়তেন।

📜 হাদিস: 🔸 হজরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “যখন রাসুলুল্লাহ (ﷺ) নামাজের জন্য দাঁড়াতেন, তখন তিনি বলতেন:

إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ…”

(সহীহ মুসলিম: ৭৭০)

🔸 অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এই দোয়াটি কিয়ামের সময় পড়তেন, যা তাকবীরে তাহরিমার পর পড়া যায়। (আবু দাউদ: ৭৬১)

📌 উপসংহার

  • এই দোয়াটি পড়া সুন্নাত, তবে আবশ্যক নয়।
  • এটি একনিষ্ঠতা ও তাওহিদের ঘোষণা, যা নামাজের খুশু-খুযু বৃদ্ধি করে।
  • এটি নবী (ﷺ) থেকে প্রমাণিত দোয়া, তবে চাইলে সানার দোয়া (সুবহানাকাল্লাহুম্মা…) পড়া যেতে পারে।

💡 যদি কেউ এই দোয়াটি না জানে বা না পড়ে, তবে তার নামাজ শুদ্ধ হবে। তবে পড়লে তা উত্তম ও ফজিলতপূর্ণ।

ইন্নি ওয়াজ্জাহাতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস …” সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর

প্রশ্ন: এই দোয়াটি কি নামাজের জন্য বাধ্যতামূলক?

উত্তর: না, এটি বাধ্যতামূলক নয়। এটি নফল ও সুন্নাত দোয়া, যা নামাজের প্রথম অংশে পড়া যায়। কেউ না পড়লেও তার নামাজ শুদ্ধ হবে।

প্রশ্ন: এই দোয়াটি কখন পড়তে হয়?

উত্তর: এটি তাকবীরে তাহরিমার (নামাজ শুরুর “আল্লাহু আকবার” বলার) পর সানা দোয়ার পরিবর্তে পড়া যায়। কেউ চাইলে সানাও পড়তে পারেন, আবার চাইলে উভয় দোয়াই পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করতে পারেন।

প্রশ্ন: এটি কোন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত?

উত্তর: এটি সহিহ মুসলিম (৭৭০) ও আবু দাউদ (৭৬১) হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যেখানে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) নামাজের শুরুতে এই দোয়াটি পড়তেন।

প্রশ্ন: নবী (ﷺ) কি সবসময় এই দোয়াটি পড়তেন?

উত্তর: না, তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দোয়া পড়তেন। কখনো এই দোয়াটি, কখনো “সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা…” সানা দোয়া পড়তেন। তাই উভয়টি সুন্নাত।

প্রশ্ন: এই দোয়াটি পড়লে কি কোনো বিশেষ ফজিলত রয়েছে?

উত্তর: এটি তাওহিদের ঘোষণা এবং ইখলাস (একনিষ্ঠতা) প্রকাশের দোয়া। এটি পড়লে মনোযোগ বৃদ্ধি পায় এবং নামাজে অধিক খুশু-খুযু (বিনয় ও একাগ্রতা) আসে।

প্রশ্ন: যদি কেউ এই দোয়াটি না জানে, তাহলে কি তার নামাজ ناقص (অসম্পূর্ণ) হবে?

উত্তর: না, এটি না জানলে বা না পড়লে নামাজ ناقص হবে না। তবে এটি পড়া সুন্নাত ও উত্তম।

প্রশ্ন: কোন নামাজে এটি পড়া যায়?

উত্তর: এটি ফরজ, সুন্নাত ও নফল—সব ধরনের নামাজেই পড়া যায়।

প্রশ্ন: মহিলারা কি এই দোয়াটি পড়তে পারবেন?

উত্তর: হ্যাঁ, মহিলারাও এই দোয়াটি পড়তে পারবেন। এটি নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য সুন্নাত।

প্রশ্ন: যদি ভুলক্রমে এটি সানার সাথে পড়ে ফেলি, তাহলে কি সমস্যা হবে?

উত্তর: না, এতে কোনো সমস্যা নেই। এটি সুন্নাত হওয়ায় একাধিক দোয়া পড়লেও নামাজে কোনো ক্ষতি হবে না। বরং এটি ভালো আমল।

🔟 প্রশ্ন: ছোট বাচ্চাদের বা নতুন নামাজ শেখা ব্যক্তিদের জন্য কোনটি সহজ—সানা না এই দোয়া?

উত্তর: সাধারণত সানা দোয়া (سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ…) শেখানো হয়, কারণ এটি সংক্ষিপ্ত ও সহজ। তবে কেউ চাইলে এই দোয়াটিও শিখতে পারেন।


Share this post
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x