গান শোনা কি হারাম? সত্য জানুন এবং জ্ঞান বৃদ্ধি করুন

পোস্টটি শেয়ার করুন

আপনি কি গান শোনে অভ্যস্ত? অথবা গান শোনতে চান? সেই কারণেই আপনি জানতে চাচ্ছেন – গান শোনা কি হারাম? আপনার মতো অনেকেই এই প্রশ্নটি করছেন। সবার জন্য, ইসলামে সঙ্গীতের বিধান নিয়ে আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করছি। তাই নিবন্ধটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন যাতে এই বিষয়টি পরিপূর্ণ বুঝতে পারেন।

গান কী?

গান হলো শব্দ, সুর ও তাল মিলিয়ে রচিত একটি শিল্পকর্ম। মানুষ শ্রবণের মাধ্যমে সেটা উপভোগ করে। সাধারণত শব্দগুলোকে সুরেলা ধ্বনিতে সাজিয়ে তোলা হয়। গানে মূল ভূমিকা পালন করে কণ্ঠ। তার সাথে বাদ্যযন্ত্রও গানের আকর্ষণকে আরো বৃদ্ধি করে। গান বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি এবং ধরণে হতে পারে।

গানের প্রধান উপাদান

  • সুর: ধ্বনির উচ্চ-নিম্ন বিন্যাস। এটি গানকে সুরেলা করে তোলে।
  • তাল: সঙ্গীতের একটি ছন্দময় কাঠামো, যা গানকে গতি দেয়।
  • কথা/বাণী: গানের লিরিক্স বা শব্দাংশ। এটি গানের বার্তা বা গল্প প্রকাশ করে।
  • বাদ্যযন্ত্র: সুর ও তালের সাথে মিল রেখে গানকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তোলে।

গানের ধরণ

  • ধর্মীয় গান: আল্লাহর প্রশংসা, নবীজীর গুণগান বা ধর্মীয় মূল্যবোধ নিয়ে রচিত গান।
  • প্রেমের গান: ভালোবাসা বা আবেগ নিয়ে গাওয়া গান।
  • দেশাত্মবোধক গান: দেশপ্রেমের অনুভূতি প্রকাশ করে।
  • লোকগীতি: একটি অঞ্চলের স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরে।
  • ক্লাসিকাল গান: বিশেষ সুর ও তালের নিয়ম মেনে পরিবেশিত গান।
  • আধুনিক গান: সমসাময়িক ধারা ও বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত গান।

গান শোনা কি হারাম?

না, সাধারণভাবে গান শোনা হারাম নয়। এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে ইসলামের প্রাথমিক যুগে গান পরিবেশিত হয়েছে। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুমোদন দিয়েছেন। যেমন:

  • যুদ্ধের সময় সাহাবিদের অনুপ্রাণিত করার জন্য গান গাওয়া হতো।
  • তৎকালীন মুসলিম সমাজে বিবাহ অনুষ্ঠানে গান পরিবেশিত হতো।

এখান থেকে বোঝা যায় যে, গান ইসলামে হারাম নয়। তবে, কিছু ক্ষেত্রে গানের কথা বা উপাদানের কারণে সেটা অবশ্যই হারাম হবে। এই প্রকার গানকে আলেমরা হারাম বলেছেন।

গান নিয়ে ব্যাপক গবেষণার পর ইসলামী গবেষক বলেছেন যে, গান সাধারণভাবে হারাম নয়। তবে, নির্দিষ্ট ধরণের কিছু গান হারাম। এই সমস্ত গান বাদ দিয়ে অন্য সব গান হালাল। আমরা এই বিষয়ে ধাপে ধাপে আলোচনা করছি।

গান বিষয়ে কুরআনের নির্দেশনা

পবিত্র কুরআনের কোনো আয়াতে সরাসরি গানকে হারাম বলা হয়নি। তবে একটি আয়াত অস্পষ্টভাবে সঙ্গীতের সাথে সম্পর্কিত বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

আয়াতের অর্থ হলো –

“আর কিছু মানুষ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য অবান্তর কথা খরিদ করে, আর তারা ঐগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে; তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব” (সূরা লুকমান, আয়াত – ৬)

আল-ওয়াহিদি (রা.) এবং অন্যান্য মুফাসসিরগণ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন যে, এখানে ‘লাহাওল হাদীস’ শব্দটি সঙ্গীত বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।

তবে প্রতিটি সচেতন ব্যক্তি সহজেই বুঝতে পারবেন যে, এই আয়াতটি গানের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে হারামের ঘোষণা দেয় না।

কারণ আরবিতে গানের জন্য ব্যবহৃত শব্দ হলো ‘আগনিয়া,’ কিন্তু এই আয়াতে ‘লাহাওল হাদীস’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ হলো – ‘অর্থহীন কথাবার্তা। অনেকে বলেছেন, لَهۡوَ الۡحَدِیۡثِ বাক্যটিতে حديث শব্দের অর্থ কথা, কিসসা-কাহিনী এবং لهو শব্দের অর্থ গাফেল হওয়া। যেসব বিষয় মানুষকে প্রয়োজনীয় কাজ থেকে গাফেল করে দেয় সেগুলোকে لهو বলা হয়।

ইবনে মাসউদ, ইবনে আব্বাস ও জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহুম- এর মতে لَهۡوَ الۡحَدِیۡثِ অর্থ, গান-বাদ্য করা। অধিকাংশ সাহাবী, তাবেয়ী ও তফসীরবিদগণের মতে لَهۡوَ الۡحَدِیۡثِ অর্থ গান, বাদ্যযন্ত্র ও অনর্থক কিসসা-কাহিনীসহ যেসব বস্তু মানুষকে আল্লাহর ইবাদত ও স্মরণ থেকে গাফেল করে।

এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি যে সকল গান বা গল্প অনর্থক ও অসার সেগুলোর নিন্দা এখানে করা হয়েছে। সার্বিকভাবে সকল গানের সমালোচনা এখানে করা হয়নি।

গান নিয়ে হাদিসের নির্দেশনা

এখন আমরা সঙ্গীত সম্পর্কে হাদিসের আলোচনায় আসব। আবদুর রহমান ইবনে গনাম আশআরী (রাযি.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আবু আমির বা আবু মালিক আশআরী আমাকে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহর কসম, তিনি কখনো আমার কাছে মিথ্যা বলেননি।

তিনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন:

“আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু দল অবশ্যই দেখা দেবে, যারা ব্যভিচার, রেশমি কাপড়, মদ এবং সঙ্গীতের যন্ত্রসমূহকে হালাল মনে করবে।” (সহীহ বুখারী – ৫৫৯০)

অন্য একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“যখন আমার উম্মত পনেরোটি বিষয়ের প্রতি মনোনিবেশ করবে, তখন তাদের ওপর বিপর্যয় (কেয়ামত) আসবে।”

জিজ্ঞাসা করা হলো, “হে আল্লাহর রাসুল, সেগুলো কী কী?”

তিনি বলেন:

  • যখন যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হবে।
  • আমানত লুট হয়ে যাবে।
  • যাকাতকে বোঝা হিসেবে গণ্য করা হবে।
  • পুরুষরা তাদের স্ত্রীদের আনুগত্য করবে।
  • ছেলেরা তাদের মায়ের প্রতি অবাধ্য হবে।
  • বন্ধুর সাথে ভালো ব্যবহার করবে। কিন্তু বাবার সাথে দুর্ব্যবহার করবে।
  • মসজিদগুলোতে শোরগোল হবে।
  • খারাপ চরিত্রের লোক সম্প্রদায়ের নেতা হবে।
  • একজন মানুষকে তার ক্ষতির ভয়ে সম্মান দেখানো হবে।
  • মদপান করা হবে।
  • রেশমি কাপড় পরিধান করা হবে।
  • গায়ক এবং সঙ্গীতের যন্ত্র জনপ্রিয় হবে।
  • উম্মতের শেষ যুগের লোকেরা প্রথম যুগের লোকদের অভিশাপ দেবে। (তিরমিজি – ২২১০)

কোন ধরনের গান হারাম?

কুরআন এবং হাদিসের বর্ণনাগুলো পাশাপাশি রাখলে আমরা উপসংহারে আসতে পারি যে, নিচের বৈশিষ্ট্যযুক্ত গানগুলো হারাম।

আমরা নিচে তালিকা আকারে ধাপে ধাপে হারাম সঙ্গীতের ধরণ নিয়ে আলোচনা করছি:

  • যদি গানের কথাগুলো ইসলামের সাথে বিরোধপূর্ণ হয় বা ইসলামী শরিয়ার বিরুদ্ধে যায়। উদাহরণস্বরূপ, অনেক হিন্দি গানে এমন বাক্য থাকে – “তুহি মেরে রাব,” “তুহি মেরে সব,” বা “ছোড় দো খোদাউ কো মেয় তেরে লিয়ে।” তাহলে এই গান শোনা যাবে না।
  • যদি গান আল্লাহ বা রাসূলকে অপমান করে, তবে সেই গান হারাম উদাহরণস্বরূপ, কিছু নাস্তিকদের তৈরি কনটেন্ট বা গান, যা আল্লাহকে অস্বীকার করে বা রাসূলুল্লাহ (সা.) কে অপমান করে।
  • যদি গানের কথাগুলো কোনো ব্যক্তি, সম্প্রদায় বা দেশের সম্মানকে আঘাত করে, তবে তা শোনা যাবে না।
  • যদি গানে নারীর সৌন্দর্য বর্ণনা করা হয় বা অশ্লীল ভাষা এবং বাক্য প্রচারিত হয়।
  • যদি গানে বাদ্য যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।
    নারীর কণ্ঠে পরিবেশিত গান। কারণ কুরআনে নারীকে অপরিচিত পুরুষের সামনে আকর্ষণীয় কণ্ঠে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। এটি পুরুষের মনে আত্মিক রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
  • গানে যেন অর্থহীন কথাবার্তা না থাকে। কারণ অর্থহীন কথা শুধু সময়ের অপচয় এবং ভালো ফলাফল নিয়ে আসে না। পবিত্র কুরআনের ঐ আয়াতে অর্থহীন কথাবার্তাকে “লাহওয়াল হাদীস” দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
যে ধরণের গান শোনা হারাম
যে ধরণের গান শোনা হারাম

এগুলো হলো সঙ্গীতের মৌলিক দিক। এরকম আরোও কিছু বিষয় ছাড়া অন্যান্য সব গান হালাল। সেটা মুসলিম বা কাফির কেউই রচনা বা পরিবেশন করুক না কেন।

ইসলামে কোন ধরণের গান হালাল?

ভালো কথাবার্তাসমৃদ্ধ গান সর্বদাই গ্রহণযোগ্য। এমনকি এর মাধ্যমে পরকালে চিরস্থায়ী পুরস্কারও অর্জিত হতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো সংগীতে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার পবিত্রতা বর্ণিত হয় অথবা আমাদের রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মহত্ব তুলে ধরা হয়, তাহলে এই গানগুলোর মাধ্যমে সাওয়াব পাওয়া সম্ভব।

আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন, তখন মদিনার বালক এবং বালিকারা একটি গান পরিবেশন করেন তাকে স্বাগত জানাতে। সেই গানটি হলো ‘তালা আল বাদরু আলাইনা।’

একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন। তখন ছোট মেয়েরা বদরের যুদ্ধের শহীদদের কীর্তন করে নবী (স.) এর সামনে গান পরিবেশন করেন।

সে গানে তারা একটি বাক্য উল্লেখ করেন:

“আমাদের মধ্যে একজন নবী আছেন, যিনি জানেন কাল কী হবে।”

সেই সময়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেয়েদের এই বাক্যটি বলা থেকে বিরত থাকতে বলেন। তবে, তিনি তাদের গান গাওয়া নিষেধ করেননি।

মুসলিম পণ্ডিতদের মতামত

আমরা এখানে কিছু ইসলামী পণ্ডিতের মতামত সংযুক্ত করেছি, যারা সঙ্গীতকে হালাল বলে উল্লেখ করেছেন।

  • মিশরের গ্র্যান্ড মুফতি শাওকি আল্লাম এর মতামত।
  • তুরস্কের ন্যাশনাল ফতোয়া কাউন্সিলের ফতোয়া।
  • মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদের আদিল আল-কালবানীর ফতোয়া।
  • জর্ডানের মুফতি শাইখ আবু ইয়াস-এর ফতোয়া।
  • শাইখ আহমদ কুট্টি (টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক)-এর মতামত।
  • আল-আজহারের স্কলার ওমর গ্যাব্রিয়েলের হাদিস তালিকা ও উপসংহার।
  • শাইখ মুহাম্মদ আলী আল-হানতুর বক্তব্য।
  • আল-মাকাসিদ ইসলামিক সেমিনার পরিচালক শাইখ ইয়াহিয়া-এর ফতোয়া।

কেন গান শোনা হারাম?

যে গানগুলোহারাম সেগুলোর মধ্যে কিছু মানব নৈতিকতাকে ধ্বংস করে, অপরাধে প্ররোচিত করে, অথবা অবাধ যৌনতাকে উৎসাহিত করে।

যদি প্রশ্ন করা হয়, “ইসলামে সঙ্গীত কেন হারাম?” তাহলে আমরা বলতে পারি, উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে সঙ্গীত ইসলামে হারাম নয়।

ইসলাম সঙ্গীতের জন্য একটি সীমারেখা দিয়েছে। কেউ যদি এই সীমারেখা অনুসরণ করে সঙ্গীত তৈরি করে, তাহলে তার সঙ্গীত কখনো হারাম হবে না। কেবল যেসব গান এই নিয়মের বাইরে যায়, সেগুলো হারাম হবে।

কারণ, সে গান দ্বারা হয়তে অবমাননাকর হবে বা অবৈধ যৌন কার্যকলাপ বা যিনার প্রচার থাকবে, সর্বোপরি অনুষ এটা দ্বারা মানুষ নৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অথবা এতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে অস্বীকার করা হবে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অপমান করা হবে।

কেবল ইসলামিক বিধান নয় বরং মানুষের সাধারণ বিবেকও দাবি করে যে, এই ধরণের সঙ্গীত হারাম হওয়া উচিত। ইসলাম মানুষের স্বাভাবজাত ধর্ম। তাই এখানে কোনো আইন মানুষের স্বাভাবিকতার বাইরে চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। সব আইন মানুষের কল্যাণের জন্যই আরোপ করা হয়েছে।


পোস্টটি শেয়ার করুন