ইসলামে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার উপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রতিদিনের জীবনে এই পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন বিধান ও নিয়মাবলী রয়েছে। পবিত্রা লাভের একটি বিশেষ উপায় হলো ঢিলা কুলুখ ব্যবহার করা। এক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য কিছুটা ব্যতীক্রম নিয়ম রয়েছে। এই ব্লগপোস্টে আমরা মহিলাদের ঢিলা কুলুখ ব্যবহারের নিয়ম, এবং কুরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে ফুকাহায়ে কেরামের মতামত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ঢিলা কুলুখ কী?
ঢিলা কুলুখ হল ছোট পাথর, মাটি বা টিসু ইত্যাদি, যা মল-মুত্র ত্যাগের পর পবিত্রা লাভের জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি একটি প্রাচীন প্রথা, যা এখনও অনেক মুসলিম সমাজে প্রচলিত। ঢিলা কুলুখের মূল উদ্দেশ্য হল মলমূত্র পরিস্কার করে নিজেকে পবিত্র রাখা। প্রাচীন আরবে পানির বিকল্পে ঢিলা কুলুখ হিসাবে ব্যবহার করা হতো, সেটা আরবি ভাষায় ইসতিজমার হিসাবে পরিচিত। তবে বর্তমানে যেহেতু পানি সহজেই পাওয়া যায় তাই পবিত্রার জন্য পাথর বা মাটি বা টিসু ইত্যাদি দ্বারা ঢিলা কুলুখ ব্যবহার করার মধ্যে আলাদা কোনো ফজিলত নেই। বরং পানি দ্বারা মূল নাপাকি দূর করাই উত্তম।
মহিলাদের পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জনের বিধান
নারীদের জন্য প্রস্রাবের পর পবিত্রতা অর্জনের (ইসতিঞ্জা) ক্ষেত্রে করণীয় হলো—তাঁর যে অঙ্গ বসার সময় প্রকাশ পায়, কেবল সেই বাহ্যিক অংশ ধৌত করা। অর্থাৎ বাহ্যিক ফরজ বা যৌনাঙ্গের বাহিরে যে অংশ দেখা যায়, সেটুকুই ধোয়া ফরজ। এর অতিরিক্ত কোনো অংশ ধোয়া আবশ্যক নয়, যতক্ষণ না সেখানে নাপাকী (নজাসত) পৌঁছে।
শায়খ জাকারিয়া আনসারী (রহ.) তাঁর কিতাব আসনা আল-মাতালিব-এ “রাওদ আল-তালিব” কিতাবের সাথে মিলিয়ে বলেন:
“(নারীর জন্য যথেষ্ট) — হোক সে কুমারী বা বিধবা — ইসতিঞ্জার সময় কেবল সেই অংশ ধোয়া, যা সে পায়ের উপর বসলে প্রকাশ পায়।”
মহিলাদের ঢিলা কুলুখ ব্যবহারের নিয়ম
চার মাযহাব এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, যদি মল-মূত্র স্ব-স্থান অতিক্রম করে এবং অনেক খানি ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে শুধু পাথর বা টিস্যু দিয়ে পরিষ্কার করাটা যথেষ্ট নয়; বরং পানির দ্বারা ধোয়া আবশ্যক। মল ও মুত্রের পর মহিলাদের ঢিলা কুলুখ ব্যবহার নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। মালিকি মাযহাব মতে মহিলারা কেবল মল ত্যাগের পর ঢিলা কুলুখ করতে পারবেন, মুত্রের পর নয়।
এর ব্যাখ্যা হলো: ইস্তিজমার (পাথর বা টিস্যু দিয়ে মল-মূত্র মোছা) হলো একধরনের রুখসাত বা বিকল্প। এটা পানির অনুপস্থিতে সাধারণভাবে মানুষের মাঝে সহজলভ্য। এ কারণে, এটি কেবল সেই অংশের জন্য প্রযোজ্য যেখানে সাধারণভাবে এই সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু যেটা অতিরিক্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তার জন্য পানি দিয়ে ধোয়া অপরিহার্য। (মুসুআ’তুল ফিকহিয়্যা (৪/১২১) থেকে সংকলিত)
তবে বিশুদ্ধ ও প্রমাণযোগ্য মত হলো, নারীরা পুরুষদের মতোই— হোক সে কুমারী বা বিবাহিতা। এটাই অনেক বিশিষ্ট আলেম গ্রহণ করেছেন যেমন: মাজদ ইবন তাইমিয়া (শাইখুল ইসলামের দাদা), মারদাওয়ী প্রমুখ ।
শাইখ আবদুল্লাহ আত-তাইয়ার (হাফিজাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল:
❝কেউ কেউ বলেন, নারীদের জন্য প্রস্রাবের পর অবশ্যই পানি দিয়ে ইস্তিঞ্জা করতে হবে, বিশেষ করে যারা নিজেদের মালিকি মাযহাব অনুসারী বলে দাবি করে। এ কথাটি কি সহীহ?❞
তিনি জবাব দেন:
❝আমি এ কথার কোনো দলিল জানি না। নারী ও পুরুষ সমান —
তারা চাইলে পানি ব্যবহার করতে পারে, আবার চাইলে পাথর/টিস্যু দিয়েও ইস্তিজমার করতে পারে।
তবে যদি কেউ পাথরের পর পানি ব্যবহার করে, সেটাই সবচেয়ে উত্তম।❞
শালীন ও মার্জিত নিয়মে মহিলারা যেভাবে ঢিলা কুলুখ ব্যবহার করবেন
১. পর্যাপ্ত পরিমাণে কুলুখ ( পাথর, মাটি-ইস্তিজমার) নিন: সাধারণত তিনটি ঢিলা কুলুখ যথেষ্ট হলেও পরিষ্কার না হলে আরও ব্যবহার করতে পারেন।
২. বাম হাতে ঢিলা কুলুখ ধরুন: ইসলামে বাম হাত ব্যবহার করে পরিষ্কার হওয়ার বিধান আছে। তাই বাম হাতে ঢিলা কুলুখ ধরে পরিস্কার করুন।
৩. মলত্যাগের পর পরিস্কার শুরু করুন: মলত্যাগের পরপরই ঢিলা কুলুখ দিয়ে পরিষ্কার করা উচিত, যাতে মল শুকিয়ে না যায়।
৪. মলমূত্র সম্পূর্ণরূপে পরিস্কার করুন: পরিষ্কার হওয়ার সময় মলমূত্র সম্পূর্ণরূপে পরিস্কার করা উচিত, যাতে শরীর ও কাপড় পবিত্র থাকে।
মহিলারা কখন ঢিলা কুলুখ ব্যবহার করবেন?
মহিলারা টয়লেট ব্যবহারের পরপরই ঢিলা কুলুখ ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়াও, যদি পানি পাওয়া না যায় বা পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকে, তবে ঢিলা কুলুখ ব্যবহার করা যেতে পারে।
মহিলাদের ঢিলা কুলুখ ব্যবহারের ব্যাপারে কুরআন ও হাদিস কী বলে?
কুরআন ও হাদিসে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার উপর জোর দেয়া হয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে:
“إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ”
অর্থাৎ, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কারীদের ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখেন এমনদের ভালোবাসেন” (সুরা বাকারা, ২:২২২)।
হাদিসে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
“الطهور شطر الإيمان”
অর্থাৎ, “পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক” (মুসলিম)।
পানি ব্যবহার করলেও কী ঢিলা কুলুখ ব্যবহার করতে হবে?
না, পানি ব্যবহার করলে ঢিলা কুলুখ ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই। ইসলামের নির্দেশ হচ্ছে মলমূত্র ত্যাগের পর ভালোভাবে ও উত্তমরূপে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্নতা গ্রহণ করা। সেটা যদি পানি দিয়ে হয় তাহলে সবথেকে ভালো। কিন্তু যদি পানি না পাওয়া যায় তাহলে মাটি ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু পানি ব্যবহারের পর মাটি ব্যবহার অনুপযোগী। তবে টিসু দ্বারা মুছা ভালো। এটি একটি অতিরিক্ত পরিস্কারতার স্তর যোগ করে এবং পবিত্রতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। যাদের সংবেদনশীল ত্বক আছে তাদের জন্য এটি বিশেষভাবে উপকারী হতে পারে, কারণ এটি অতিরিক্ত ময়লা ও ব্যাকটেরিয়া দূর করতে সাহায্য করে।
সারাংশ
মহিলাদের ঢিলা কুলুখ ব্যবহারের নিয়ম সম্পর্কে সচেতন হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি স্বাস্থ্য, পবিত্রতা এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য। সঠিক নিয়ম ও পদ্ধতি অনুসরণ করে ঢিলা কুলুখ ব্যবহার করলে মহিলারা তাদের দৈনন্দিন জীবনে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে পারেন। কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত নির্দেশনা অনুসরণ করে আমরা আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারি।
সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী ও উত্তর
প্রশ্ন ১: ঢিলা কুলুখ ব্যবহার করা কি বাধ্যতামূলক?
উত্তর: না, ঢিলা কুলুখ ব্যবহার বাধ্যতামূলক নয়, তবে এটি একটি সুন্নত যা পরিষ্কারতার জন্য সুপারিশকৃত।
প্রশ্ন ২: ঢিলা কুলুখের পরিবর্তে কি কাগজ ব্যবহার করা যাবে?
উত্তর: হ্যাঁ, কাগজ ব্যবহার করা যায়, তবে নিশ্চিত করতে হবে যে এটি যথেষ্ট পরিমাণে পরিষ্কার করে।
প্রশ্ন ৩: শুধুমাত্র পানি দিয়ে পরিস্কার করা কি যথেষ্ট?
উত্তর: পানি দিয়ে পরিস্কার করা যথেষ্ট হতে পারে, তবে অতিরিক্ত পরিষ্কারতার জন্য ঢিলা কুলুখ ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রশ্ন ৪: ঢিলা কুলুখ ব্যবহারে ত্বকের কোন সমস্যা হতে পারে?
উত্তর: সাধারণত না, তবে সংবেদনশীল ত্বক হলে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
প্রশ্ন ৫: ঢিলা কুলুখ ব্যবহারের পর কি হাত ধুতে হবে?
উত্তর: হ্যাঁ, ঢিলা কুলুখ ব্যবহারের পর হাত ধুতে হবে, যা পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার একটি অপরিহার্য অংশ। ঢিলা কুলুখ ব্যবহারের নিয়ম ও গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে মহিলারা তাদের দৈনন্দিন জীবনে পবিত্রতা ও স্বাস্থ্য বজায় রাখতে পারেন। ইসলামের নির্দেশনা অনুসরণ করে আমরা আমাদের জীবনকে আরো সুন্দর ও পরিপূর্ণ করতে পারি।