মা হওয়া একজন নারীর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অনুভূতি। গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের দায়িত্ব দ্বিগুণ হয়ে যায়। কারণ তার সঙ্গে সঙ্গে গর্ভের শিশুটির সুরক্ষা এবং সুস্থতা নিশ্চিত করাও অপরিহার্য। ইসলাম ধর্ম আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। এই ধারবাহিকতায় গর্ভাবস্থায় বাচ্চা সুরক্ষিত রাখার আমল ও দোয়া সম্পর্কেও কুরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে।
১. তাওবার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি করা
গর্ভাবস্থায় নিজের আত্মাকে পবিত্র রাখা অত্যন্ত জরুরি। পাপ থেকে তওবা করা এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা একটি বড় আমল।
আমল
- নিয়মিত ইস্তিগফার পড়ুন:
أستغفر الله العظيم الذي لا إله إلا هو الحي القيوم وأتوب إليه
উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লাহাল আযীমাল্লাযি লা ইলাহা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুমা ওয়া আতুবু ইলাইহি।
অর্থ: আমি ক্ষমা চাই মহান আল্লাহর কাছে, যিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। তিনি চিরঞ্জীব ও সমস্ত কিছুর ধারক এবং আমি তাঁরই দিকে ফিরে আসি (তওবা করি)।
আপনি এই দোয়া বারবার পড়তে পারেন, বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় এটি অন্তরের প্রশান্তি ও আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার অন্যতম কার্যকর উপায়।
২. নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করা
কুরআন হলো শিফা এবং রহমত। গর্ভাবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করলে মায়ের আত্মা শান্তি পায় এবং বাচ্চার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়।
আমল
- প্রতিদিন কিছু পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াত করুন।
- সূরা ইয়াসিন, সূরা আর-রহমান, সূরা আল-ফাতিহা ও সূরা মারইয়াম বিশেষভাবে পড়তে পারেন।
৩. আল্লাহর কাছে সুস্থ সন্তানের জন্য দোয়া করা
হযরত ইব্রাহিম (আঃ) আল্লাহর কাছে সুস্থ ও নেক সন্তান চেয়ে দোয়া করেছিলেন। আমাদেরও উচিত আল্লাহর কাছে নিয়মিত সুস্থ ও নেক সন্তান চেয়ে দোয়া করা।
আমল
- দোয়া পড়ুন:
{رَبِّ هَبْ لِي مِن لَّدُنْكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً إِنَّكَ سَمِيعُ الدُّعَاءِ}
উচ্চারণ: “রব্বি হবল্লি লি মিল লাদুনকা যুররিয়্যাতান ত্যাইবাতান। ইন্নাকা সামি উদ দোয়া।” (সূরা ইবরাহিম: ৪০)
অর্থ: হে আমার রব! আমাকে তোমার পক্ষ থেকে পবিত্র সন্তানের দান করো। (সূরা ইবরাহিম: ৪০)
৪. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা
নামাজ মায়ের মানসিক প্রশান্তির পাশাপাশি গর্ভের শিশুর জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে মা শক্তি ও শান্তি পান।
আমল:
- পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত আদায় করুন।
- ফরজ নামাজের পাশাপাশি নফল নামাজ পড়তে পারেন। তবে নিষিদ্ধ সময়ে নামাজ পড়া যাবে না।
৫. সকাল-সন্ধ্যায় আজকার করা
আজকার ও তাসবিহ মায়ের এবং সন্তানের উপর শয়তানের প্রভাব থেকে রক্ষা করে। এটি আল্লাহর রহমত লাভের অন্যতম উপায়।
আমল:
- সকাল-সন্ধ্যার দোয়া ও তাসবিহ পড়ুন:
- সুরা আল ইখলাস (১১৩)
- সুরা আল ফালক (১১৪)
৬. সূরা মারইয়াম তিলাওয়াত করা
সূরা মারইয়াম গর্ভাবস্থায় পড়ার বিশেষ ফজিলত রয়েছে। এই সূরাটি গর্ভবতী মায়ের জন্য রহমত ও বরকত বয়ে আনে।
আমল
নিয়মিত সূরা মারইয়াম তিলাওয়াত করুন। বিশেষত, সপ্তাহে অন্তত একবার এই সূরা পড়ার চেষ্টা করুন।
৭. দান-সদকা করা
দান-সদকা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম। এটি বিপদ থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে। গর্ভাবস্থায় দান করলে মায়ের ও সন্তানের উপর আল্লাহর রহমত নাযিল হয়।
আমল
- নিয়মিত কিছু পরিমাণ দান করুন।
- অসহায় ও দরিদ্রদের সাহায্য করুন।
৮. আল্লাহর নামের জিকির করা
আল্লাহর নামের জিকির করলে মায়ের অন্তর প্রশান্ত হয় এবং সন্তান আল্লাহর রহমতে বেড়ে ওঠে।
আমল
সর্বদা জিকির করুন:
- সুবহানা আল্লাহ।
- আল হামদু লিল্লাহ
- আল্লাহু অকবার।
৯. হারাম থেকে দূরে থাকা
গর্ভাবস্থায় হারাম খাদ্য, পানীয় এবং কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকা অত্যন্ত জরুরি। হারাম কোনো কিছু গ্রহণ করলে বাচ্চার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
আমল
- হালাল খাদ্য গ্রহণ করুন।
- সব ধরনের হারাম কাজ ও উপার্জন থেকে বিরত থাকুন।
১০. আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করা
গর্ভাবস্থায় প্রতিটি কাজে আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখা উচিত। তাওয়াক্কুল করলে আল্লাহ সব সমস্যা থেকে রক্ষা করেন।
আমল
- নিয়মিত দোয়া করুন:
أَللّٰهُمَّ إِنَّكَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ
উচ্চারণ:আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আলা কুল্লি শাইইন কাদীর।
অর্থ:হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই তুমি সবকিছুর উপর ক্ষমতাশালী।
এই দোয়াটি গর্ভাবস্থাসহ জীবনের যে কোনো সময়ে আল্লাহর উপর ভরসা এবং সাহায্য চাওয়ার জন্য পড়া যেতে পারে। আল্লাহ সবকিছুর মালিক এবং তিনি যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম।
মারইয়াম (আ.) এর গর্ভাবস্থায় বাচ্চা সুরক্ষিত রাখার আমল
কুরআনে বর্ণিত মারইয়াম (আ.) এর ঘটনা গর্ভবতী মায়েদের জন্য এক অনুপ্রেরণা। আল্লাহ তায়ালা মারইয়াম (আ.) কে গর্ভাবস্থায় রক্ষা করেছিলেন এবং তাঁর সন্তান ঈসা (আ.)-এর সুরক্ষা নিশ্চিত করেছিলেন। সূরা মারইয়াম-এ উল্লেখ করা হয়েছে, গর্ভাবস্থার কষ্ট এবং মানসিক চাপের মধ্যে আল্লাহ তাঁকে শান্তির বার্তা দেন।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“আর তুমি খেজুর গাছের গুঁড়ি ধরে ঝাঁকাও, তা থেকে তোমার ওপর টাটকা খেজুর পড়বে। তা খাও, পান কর এবং মনকে ঠান্ডা রাখো।” (সূরা মারইয়াম: ২৫-২৬)
এই আয়াত থেকে পাওয়া আমল:
১. খেজুর খাওয়া: গর্ভাবস্থায় খেজুর খাওয়া শরীরের শক্তি বৃদ্ধি করে এবং শিশুর জন্য উপকারী।
২. আল্লাহর উপর ভরসা রাখা: কঠিন সময়েও আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল রাখা জরুরি।
৩. মনকে প্রশান্ত রাখা: মানসিক শান্তি নিশ্চিত করা গর্ভবতী মায়ের জন্য অপরিহার্য।
মারইয়াম (আ.) এর জীবন থেকে এই শিক্ষা আমরা পেতে পারি যে, আল্লাহর সাহায্য ও সঠিক খাদ্যাভ্যাস গর্ভাবস্থায় বাচ্চাকে সুরক্ষিত রাখতে সহায়ক।
জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
প্রশ্ন ১: গর্ভাবস্থায় কোন সূরাগুলো বেশি তিলাওয়াত করা উচিত?
উত্তর: গর্ভাবস্থায় সূরা মারইয়াম, সূরা ইয়াসিন, সূরা আর-রহমান এবং সূরা আল-ফাতিহা বেশি পড়া উচিত।
প্রশ্ন ২: গর্ভাবস্থায় নিয়মিত দান-সদকা করার ফজিলত কী?
উত্তর: দান-সদকা বিপদ থেকে রক্ষা করে এবং আল্লাহর রহমত লাভ হয়। এটি মা ও সন্তানের জন্য বরকতময়।
প্রশ্ন ৩: আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল কেন জরুরি?
উত্তর: আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করলে সব দুশ্চিন্তা দূর হয় এবং আল্লাহ বিপদ থেকে রক্ষা করেন।
প্রশ্ন ৪: গর্ভাবস্থায় আজকার করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর: আজকার মাকে মানসিক প্রশান্তি দেয় এবং শয়তানের প্রভাব থেকে রক্ষা করে।
উপসংহার
গর্ভাবস্থায় মায়ের জন্য আমল করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কুরআন তিলাওয়াত, নামাজ আদায়, দোয়া ও তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে গর্ভের শিশুকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সুস্থ ও নেক সন্তান দান করুন এবং তাদের ইসলামের পথে পরিচালিত করুন। আমিন।