নামাজ মুসলমানের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আর সেই নামাজের প্রতিটি অংশে রয়েছে গভীর অর্থবোধক দোয়া ও যিকির। রুকু থেকে মাথা ওঠানোর পর আমরা সবাই যে দোয়াটি পড়ি তা হলো – “রَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ” (রাব্বানা লাকাল হামদ) অথবা “رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ” (রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ)। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে—আসলে কোনটি সহীহ? কোনটি বেশি উত্তম? নবী করিম ﷺ কোন দোয়া পড়েছেন?
এই ভিন্নতার পেছনে রয়েছে হাদিসের রেওয়ায়েত ও কিরআতের পার্থক্য। তাই একজন মুসলিম হিসেবে সঠিক দোয়া পড়া এবং এর প্রমাণ জানা আমাদের জন্য জরুরি। এই ব্লগপোস্টে আমরা কুরআন ও সহীহ হাদিসের আলোকে বিষয়টি পরিষ্কার করার চেষ্টা করব, যাতে পাঠক সহজেই বুঝতে পারেন।
রুকু থেকে মাথা ওঠানোর পরের দোয়া
সংক্ষিপ্ত পরিচয়
নামাজে রুকু থেকে উঠার পর মুসল্লি আল্লাহর প্রশংসা ও মহিমা বর্ণনা করে একটি বিশেষ দোয়া পড়ে। রুকু অবস্থায় আমরা বলি “سُبْحَانَ رَبِّيَ الْعَظِيمِ” (সুবহানা রব্বিয়াল আযীম), আর সেখান থেকে মাথা ওঠানোর পর বলা হয়—
“سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ”
(সামিআল্লাহু লিমান হামিদাহ)।
এর জবাবে ইমাম বা মুস্তাহাব হিসেবে মুসল্লি বলে—
“رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ” অথবা “رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ”।
এ দোয়ার মাধ্যমে আমরা স্বীকার করি যে, সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য। নামাজের এই অবস্থানটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মুহূর্ত।
দোয়ার গুরুত্ব
- হাদিসে নির্দেশিত আমল – নবী করিম ﷺ নিজে এই দোয়া পাঠ করেছেন এবং সাহাবিদের শিখিয়েছেন।
- আল্লাহর প্রশংসা – এতে আল্লাহর কাছে তাঁর পূর্ণ প্রশংসা ফিরিয়ে দেওয়া হয়, যা ঈমানদারের অন্তরের বিনয় প্রকাশ করে।
- দোয়ার কবুল হওয়ার সময় – অনেক আলেমের মতে, রুকু থেকে ওঠার পরের এই দোয়া আল্লাহর কাছে বান্দার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এক মহৎ সুযোগ, যা আমলের ও সওয়াবের ভাণ্ডার বৃদ্ধি করে।
- নামাজের পূর্ণতা – এ দোয়া ছাড়া নামাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়, কারণ এটি নামাজের ফরজীয় রুকনের অন্তর্ভুক্ত যিকিরের একটি অংশ।
দোয়ার দুটি প্রচলিত রূপ
রুকু থেকে উঠার পর নবী করিম ﷺ বিভিন্ন রূপে দোয়া পড়েছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত দুটি হলো—
رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ
- আরবি: رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ
- উচ্চারণ: রাব্বানা লাকাল হামদ
- অর্থ: “হে আমাদের প্রতিপালক! সমস্ত প্রশংসা একমাত্র তোমারই জন্য।”
এ রূপে আল্লাহর প্রশংসা সরাসরি তাঁর জন্য নিবেদিত হয়েছে। এটি সংক্ষিপ্ত, সহজ এবং সহীহ হাদিসে বর্ণিত একটি রূপ।
رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ (রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ)
- আরবি: رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ
- উচ্চারণ: রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ
- অর্থ: “হে আমাদের প্রতিপালক! এবং সমস্ত প্রশংসা তোমারই জন্য।”
এ রূপে “وَ” (ওয়া) সংযোজনের মাধ্যমে অর্থে জোরালোতা এসেছে। অর্থাৎ, আমাদের প্রভু তুমি, এবং প্রশংসা-স্তুতি সবই তোমার প্রাপ্য।
➡️ উভয় দোয়াই সহীহ হাদিসে এসেছে। পার্থক্য কেবল শব্দগত, অর্থে তেমন কোনো বিরোধ নেই। এজন্য আলেমরা বলেছেন—দুটিই পড়া বৈধ, বরং বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন রূপ পড়া সুন্নাতের সাথে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সহীহ হাদিসের প্রমাণ
সাহাবিদের বর্ণনা
রুকু থেকে ওঠার পর এই দোয়ার বিভিন্ন রূপ সরাসরি সাহাবায়ে কেরাম নবী করিম ﷺ থেকে শিখে বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে চারটি রূপ পাওয়া যায়—
- اللَّهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ (আল্লাহুম্মা রাব্বানা লাকাল হামদ)
- رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ (রাব্বানা লাকাল হামদ)
- اللَّهُمَّ رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ (আল্লাহুম্মা রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ)
- رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ (রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ)
ইমাম নববী (রহ.) বলেছেন—
“এসব রূপের সবগুলোই সহীহ এবং নবী ﷺ থেকে বর্ণিত। কখনো তিনি এভাবে পড়েছেন, কখনো অন্যভাবে। সুতরাং মুসল্লির জন্য মাঝে মাঝে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পড়া মুস্তাহাব।” (শরহ মুসলিম, নববী, ৪/১০৫)
হাদিস গ্রন্থে উল্লেখিত ভিন্ন ভিন্ন রেওয়ায়েত
📌 রাব্বানা লাকাল হামদ
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে এসেছে: আবু হুরায়রা (রা.) বলেন—রাসূল ﷺ বলতেন:
سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ، رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ
(সহীহ বুখারী ৭৯৬, সহীহ মুসলিম ৩৯২)
📌 রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ
সাহাবি আনাস ইবন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত: রাসূল ﷺ বলতেন:
سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ، رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ
(সহীহ বুখারী ৭৯৫, সহীহ মুসলিম ৩৯৩)
📌 আল্লাহুম্মা রাব্বানা লাকাল হামদ
আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত: রাসূল ﷺ বলতেন:
سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ، اللَّهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ
(সহীহ বুখারী ৭৯৪)
📌 আল্লাহুম্মা রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ
- আবু হুরায়রা (রা.) থেকেও এ রূপে বর্ণিত আছে। (সহীহ মুসলিম ৩৯২ এর অন্যান্য সনদ)
আলেমদের ব্যাখ্যা
উভয় দোয়ার গ্রহণযোগ্যতা
ইসলামের শীর্ষ আলেমগণ একমত যে—চারটি রূপই সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তাই যে কোনো রূপ পড়া বৈধ এবং নামাজ সহীহ হবে।
- ইমাম নববী (রহ.) বলেছেন: “এসব রূপ সবই নবী ﷺ থেকে প্রমাণিত। মুসল্লির জন্য মাঝে মাঝে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পড়া সুন্নাতের সাথে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ।”
- ইবনে হজর আল-আসকালানী (রহ.) বলেন: “রাব্বানা লাকাল হামদ” ও “রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ”—উভয়টি সঠিক। এগুলোতে বিরোধ নয় বরং বৈচিত্র্য।”
কোনটি বেশি উত্তম— এ নিয়ে মতামত
আলেমদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী—
- কোনো একটি রূপকে একেবারে শ্রেষ্ঠ বলা যায় না। কারণ, সবগুলোই সহীহ হাদিস দ্বারা সমর্থিত।
- বৈচিত্র্য বজায় রাখা উত্তম – অর্থাৎ, কখনো “রাব্বানা লাকাল হামদ”, কখনো “রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ”, আবার কখনো “আল্লাহুম্মা রাব্বানা লাকাল হামদ”—এভাবে পড়া। এতে সুন্নাতের সব রূপ পালন হয়।
- তবে যারা সহজ রাখতে চান, তাদের জন্য সবচেয়ে প্রচলিত ও সহজ রূপ হলো—
- رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ (রাব্বানা লাকাল হামদ)
- رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ (রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ)
✅ তাই আলেমদের সারমর্ম হলো—সব রূপই সহীহ ও গ্রহণযোগ্য। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্নভাবে পড়া উত্তম। তবে যারা এক রূপেই অভ্যস্ত থাকতে চান, তারা “রাব্বানা লাকাল হামদু” বা “রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদু”—যেকোনো একটি পড়তে পারেন।
আরো পড়ুন:
বাস্তবিক দিকনির্দেশনা
সাধারণ মুসল্লির জন্য সহজ করণীয়
সবাই হাদিসের গভীর ইলম জানেন না। তাই একজন সাধারণ মুসল্লির জন্য করণীয় হলো—
- সহজ একটি রূপ মুখস্থ করে নেয়া।
- “رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ (রাব্বানা লাকাল হামদ)” অথবা
- “رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ (রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ)”
– এ দুটির যেকোনো একটি মুখস্থ করলেই নামাজ সহীহ হবে।
- চেষ্টা করলে ভিন্ন ভিন্ন রূপও শিখতে পারেন। এতে সুন্নাতের বিভিন্ন দিক জীবনে আসবে।
- কেবল উচ্চারণ ঠিক রাখা জরুরি। অর্থ মনে রাখতে হবে না, তবে সঠিকভাবে পড়া গুরুত্বপূর্ণ।
নামাজে কোনটি পড়া উচিত?
- যারা একটিই পড়তে চান 👉 তাদের জন্য “رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ (রাব্বানা লাকাল হামদ)” সবচেয়ে সহজ ও প্রচলিত।
- যারা বৈচিত্র্য চান 👉 তারা মাঝে মাঝে “رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ” অথবা “اللَّهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ” পড়তে পারেন।
- ইমাম হলে 👉 ইমাম “سَمِعَ اللَّهُ لِمَنْ حَمِدَهُ” বলবেন, আর মুসল্লিরা উত্তর দেবেন—“رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ” (বা অন্য রূপ)।
✅ সহজভাবে বললে— উভয় দোয়াই সহীহ। নামাজে “রাব্বানা লাকাল হামদ” পড়লে নামাজ পূর্ণ হবে, আর মাঝে মাঝে অন্য রূপ পড়লে সুন্নাতের বৈচিত্র্য পাওয়া যাবে।
উপসংহার
মূল সারসংক্ষেপ
রুকু থেকে মাথা ওঠানোর পর পড়া দোয়া নামাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নবী করিম ﷺ একাধিক রূপে এ দোয়া পড়েছেন, যেমন—
- رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ
- رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ
- اللَّهُمَّ رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ
- اللَّهُمَّ رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ
সব রূপই সহীহ হাদিসে প্রমাণিত। অর্থে কোনো বিরোধ নেই, বরং প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতার ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র্য এসেছে।
পাঠকের জন্য আমলযোগ্য বার্তা
👉 সাধারণ মুসল্লির জন্য সবচেয়ে সহজ রূপ হলো—
“رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ” (রাব্বানা লাকাল হামদ)।
👉 যারা বেশি যত্নশীল, তারা মাঝে মাঝে অন্য রূপগুলোও পড়তে পারেন। এতে সুন্নাতের বৈচিত্র্য পালন হবে এবং নামাজ আরও সুন্দর হবে।
👉 নামাজে এই দোয়া আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতার প্রতীক। তাই শুধু মুখে পড়া নয়, হৃদয়েও উপলব্ধি রাখা উচিত যে—সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য।
✅ সারকথা: উভয় দোয়া সহীহ। আপনি যেকোনো একটি পড়তে পারেন। তবে মাঝে মাঝে ভিন্ন রূপ পড়া সুন্নাতের সাথে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ।