মানুষের জীবনের মূল উদ্দেশ্যই হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। আমরা নামাজ আদায় করি, রোজা রাখি, সদকা দিই, হজ করি — সবই এই এক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে: যেন আল্লাহ আমাদের আমলগুলো কবুল করে নেন। আর এই কবুলিয়তের আকাঙ্ক্ষাই এক হৃদয়ছোঁয়া দোয়ায় প্রকাশ পেয়েছে, যা নবী ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ.) একসাথে আল্লাহর দরবারে পেশ করেছিলেন — রাব্বানা তাকাব্বাল মিন্না ইন্নাকা আন্তাস সামিউল আলীম
“رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ”
“হে আমাদের রব! আপনি আমাদের পক্ষ থেকে গ্রহণ করুন, নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১২৭)
এই দোয়া কেবল একটি প্রার্থনা নয়; বরং এটি আমাদের সব আমলের অন্তরাত্মা। এ আয়াতে যে বিনয়, ভয়, ও আল্লাহর ওপর নির্ভরতা প্রকাশ পেয়েছে, তা প্রতিটি মুমিন হৃদয়ের জন্য এক অসাধারণ শিক্ষা।
এই ব্লগপোস্টে আমরা দোয়াটির আরবি, উচ্চারণ, বাংলা অর্থ, প্রেক্ষাপট, তাফসির ও আমাদের জীবনে এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করব। চলুন শুরু করি এই পবিত্র বাক্যটির গভীরে প্রবেশের মাধ্যমে আমাদের আমলের মান উন্নত করার এক নতুন যাত্রা।
রাব্বানা তাকাব্বাল মিন্না ইন্নাকা আন্তাস সামিউল আলীম
🌸 رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
✅ আরবি:
رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
📖 বাংলা উচ্চারণ: রাব্বানা তাকাব্বাল মিন্না ইন্নাকা আন্তাস সামিউল আলীম।
🌷 বাংলা অর্থ:
“হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদের পক্ষ থেকে (এ কাজটি) কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।” 📚সূত্র: [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১২৭]
🕋 প্রেক্ষাপট
এই দোয়াটি করেছেন আল্লাহর দুই মহান নবি — ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ.), যখন তাঁরা কা’বা ঘর নির্মাণ করছিলেন।
তাঁরা মহান এক ইবাদত করছিলেন — বাইতুল্লাহ নির্মাণ — তবুও তাঁরা অহংকার করেননি বরং কেঁপে কেঁপে প্রার্থনা করেছেন:
“হে আমাদের রব! আপনি এটা আমাদের পক্ষ থেকে গ্রহণ করে নিন।”
এটি আমাদের শেখায় — কেবল নেক কাজ করলেই হবে না, বরং সেটা আল্লাহর কাছে কবুল হওয়ার জন্য প্রার্থনা করাও জরুরি।
🧠 শব্দ বিশ্লেষণ
- رَبَّنَا (রাব্বানা) — হে আমাদের প্রতিপালক
- تَقَبَّلْ (তাকাব্বাল) — গ্রহণ করুন
- مِنَّا (মিন্না) — আমাদের পক্ষ থেকে
- إِنَّكَ (ইন্নাকা) — নিশ্চয়ই আপনি
- أَنتَ (আন্তা) — আপনিই
- السَّمِيعُ (আস্-সামীউ) — সর্বশ্রোতা
- الْعَلِيمُ (আল-আলীম) — সর্বজ্ঞ
এখানে আল্লাহর দুইটি গুণবাচক নাম ব্যবহার করা হয়েছে —
🔊 সামীউন (সর্বশ্রোতা): তিনি আমাদের দোয়া ও কথাবার্তা শোনেন।
📚 আলীম (সর্বজ্ঞ): তিনি জানেন আমাদের নিয়ত, অন্তরের কথা এবং আমাদের আমলের অন্তরস্থ মান।
💡 শিক্ষা ও প্রভাব
- আমল করার পর দোয়া – এটি আমাদের শেখায়, নেক আমলের পরেও বান্দার দায়িত্ব হলো আল্লাহর কাছে কবুল হওয়ার প্রার্থনা করা।
- নিজেকে ক্ষুদ্র ভাবা – কা’বা নির্মাণের মতো বড় কাজ করেও নবীগণ নিজেদের অহংকারে ভাসাননি।
- দুয়া ও আমলের সম্পর্ক – আমল ও দোয়া একে অপরের পরিপূরক। আমরা যতই পরিশ্রম করি না কেন, কবুল না হলে তার কোনো মূল্য নেই।
- নিয়তের গুরুত্ব – এই দোয়া মনে করিয়ে দেয়, আমাদের কাজের পেছনের উদ্দেশ্য ও নিয়তও আল্লাহর কাছে গোপন নয়।
📖 তাফসির
📚 তাফসির ইবনে কাসির অনুসারে:
“এই দোয়া প্রমাণ করে, কোনো ইবাদত যতই মহান হোক না কেন, বান্দার উচিত আল্লাহর কাছে কবুল হওয়ার জন্য প্রার্থনা করা।”
তিনি বলেন, সাহাবারা ও তাবেয়িনগণ এ আয়াত থেকে শিক্ষা নিয়েই তাঁদের প্রতিটি আমলের শেষে আল্লাহর কাছে কবুলের দোয়া করতেন।
🧠 তাফসির আস-সা’দী অনুসারে
“আল্লাহর কাছে আমল কবুল হওয়ার জন্য শুধু বাহ্যিক কাজ যথেষ্ট নয়। বরং দরকার হয় — ইখলাস (বিশুদ্ধ নিয়ত) এবং সুন্নাহ অনুসারে কাজ করা। ইব্রাহিম (আ.) এর দোয়ায় এই দুই মূলনীতি নিহিত রয়েছে।”
💎 শিক্ষা
বিষয় | ব্যাখ্যা |
---|---|
আমলের মূল উদ্দেশ্য | আল্লাহর সন্তুষ্টি ও কবুলিয়ত অর্জন |
অন্তরের অবস্থা | ভয় (আমল নষ্ট হওয়ার) ও আশা (কবুল হওয়ার) |
আমলের পর দোয়ার গুরুত্ব | নেক কাজের শেষেও আত্মসমালোচনা ও দোয়ায় অবলম্বন |
আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস | তিনিই শুনেন, তিনিই জানেন — তিনিই কবুল করেন |
🧭 আমাদের জন্য শিক্ষা
- আমরা যখন সালাত, সিয়াম, দান, তিলাওয়াত বা অন্য যেকোনো নেক কাজ করি, তখন এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয়: “আমল নয়, কবুল হওয়া জরুরি!”
- এই আয়াত শেখায়: আত্মম্ভরিতা নয়, বরং বিনয়ই প্রকৃত মু’মিনের পরিচয়।
🌟 ফজিলত বা গুরুত্ব
১. 🎯 দোয়াটি ইখলাসের চূড়ান্ত প্রকাশ
নবী ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.) আল্লাহর ঘর নির্মাণ করার মতো বিরাট কাজ করেও আত্মতৃপ্ত হননি। বরং কবুল হওয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে চোখের পানিতে প্রার্থনা করেছেন। এটি শেখায় —
আমল নয়, আল্লাহর কবুলিই আসল।
২. 🤲 নেক আমলের পরে এই দোয়ার গুরুত্ব
এই দোয়া আমাদের প্রতিটি ভালো কাজের পরে শেখায় বিনয়ের সাথে দোয়া করা। আল্লাহ তাআলা বলেন:
“তাদের দান-সদকা এমন হয়, তারা তা দান করে আবার ভয় করে — না জানি কবুল হলো কি না!” 📖 (সূরা মু’মিনূন, আয়াত ৬০)
৩. 🧠 আল্লাহর গুণবাচক নাম দ্বারা দোয়ার শক্তি বৃদ্ধি
এই দোয়ায় ব্যবহৃত হয়েছে — السَّمِيعُ (সর্বশ্রোতা) ও الْعَلِيمُ (সর্বজ্ঞ) — যা প্রমাণ করে:
দোয়া শুধু শব্দ নয়, অন্তরের ভাষাও — আর তা আল্লাহ জানেন ও শুনেন।
🧭 দোয়াটির ব্যবহারিক উদাহরণ
এই দোয়াটি জীবনের বহু ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। নিচে কিছু পরিস্থিতি দেওয়া হলো:
📌 সময় / ঘটনা | ✅ দোয়ার ব্যবহার |
---|---|
নামাজ শেষে | নফল/সুন্নত/তারাবীহর পরে পড়া যায় |
রোযা রাখার পরে | ইফতারের সময় নিজের আমল কবুলের দোয়া |
দান বা সদকা করার পর | দান শুধু নয়, কবুল হোক সেই চাওয়া |
ইসলামী দাওয়াহ বা শিক্ষা কার্যক্রম শেষে | ক্লাস, মজলিস, ওয়াজ বা লেখা শেষ করে |
হজ/উমরা/জামাত থেকে ফিরে | বড় ইবাদতের পর আল্লাহর দরবারে এই দোয়া |
কুরআন খতম বা তিলাওয়াত শেষে | “হে আল্লাহ! আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন…” |
👶 শিশুদের ও শিক্ষার্থীদের শেখানোর উপায়
১. 🎵 ছোট্ট ছন্দ আকারে
🎶 রাব্বানা তাকাব্বাল, মুখে নয় অন্তর তাল সামিউল আলীম তুমি, কবুল কর এই আমল…
🎯 এতে শিশুরা ছন্দে ছন্দে মুখস্থ করতে পারে।
২. 🎨 চিত্রায়নের মাধ্যমে শেখানো
দোয়াটিকে সুন্দর গ্রাফিক্সে তুলে ধরা, যেখানে দুই নবী কা’বা বানাচ্ছেন আর দোয়া করছেন — এটা শিশুদের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলবে।
৩. ✍️ কপি-লেখা ও অর্থ শেখানো
উচ্চারণের পাশে বাংলা অর্থ ও ছোট ব্যাখ্যা দিয়ে প্র্যাকটিস করানো।
৪. 💬 সাংবাদিকের মতো প্রশ্ন করুন
“তুমি যদি আল্লাহর জন্য কিছু করো, তাহলে দোয়া করবে কেন?”
— উত্তর দিতে গিয়ে দোয়ার তাৎপর্য শিশুর অন্তরে গেঁথে যাবে।
৫. 💡 কুইজ বা গেইম বানানো যায়
- “এই দোয়াটি কবে বলা হয়েছিল?”
- “এই দোয়ায় আল্লাহর কোন নাম দুটি আছে?”
- “কোন আমল শেষে এটি পড়া যায়?”
🪞 আত্ম-পর্যালোচনার প্রশ্ন
১. ❓ আমার আমল কি সত্যিই আল্লাহর জন্য?
আমি যা করি — নামাজ, রোযা, দান — এসব কি মানুষের চোখের জন্য, না আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য?
২. ❓ আমি কি আমার আমল কবুল হওয়ার ব্যাপারে চিন্তিত থাকি?
আমি কি শুধু কাজ শেষ হওয়া নিয়ে ব্যস্ত, না কাজটি কবুল হওয়ার চিন্তাও করি?
৩. ❓ নেক কাজ করার পর কি বিনয় আসে, না আত্মতুষ্টি?
আমি কি কাজ শেষে বলি, “আলহামদুলিল্লাহ! কবুল করে নিন”, নাকি মনে মনে ভাবি, “ভালোই করলাম!”?
৪. ❓ আমি কি আল্লাহর নাম “السَّمِيعُ” ও “الْعَلِيمُ”-এর অর্থ অন্তরে ধারণ করি?
আমি কি বিশ্বাস করি, আল্লাহ আমার অশ্রু, আমার চিন্তা, আমার অভ্যন্তরের ব্যথাও জানেন?
৫. ❓ আমি কি শিশুদের ও অন্যদের শেখানোর জন্য নিজেই এ দোয়ার চর্চা করি?
যদি আমি শিক্ষার্থী, শিক্ষক, বা অভিভাবক হই — আমি কি নিজেই এ দোয়া পড়ি ও অন্যদের শিখাই?
৬. ❓ আমি কি কুরআন তিলাওয়াত, সালাত, দান ইত্যাদির পর এই দোয়া পাঠ করি?
প্রতিদিনের জীবনে কি আমি এই দোয়াকে বাস্তবতায় প্রয়োগ করি?
৭. ❓ আমার কাজের শুরুতে নিয়ত ঠিক করি তো?
আমি কি আমল শুরু করার আগে অন্তরে বলি: “এইটা একমাত্র আল্লাহর জন্যই”?