কিবলা বা কাবা ঘরকে প্রত্যেক মুসলিম অত্যন্ত সম্মানের সাথে বুকে লালন করেন। ইসালামিক ইতিহাস ও ঐতিয্য ধারণকারী কাবা শরীফ বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের ঐক্যের প্রতীক। মুসলিমদের জীবনযাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিবলার প্রতি সম্মান প্রদর্শন গুরুত্বপূর্ণ। এরই ধারাবাহিকতায় একটি প্রশ্ন প্রায়ই ওঠে, “পশ্চিম দিকে পা দিয়ে ঘুমানো যাবে কিনা?” এ বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা, ফিকহি আলোচনার ভিত্তি এবং সমাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি।
কিবলা ও পশ্চিম দিক
পশ্চিম দিকে পা দিয়ে ঘুমানোর বিষয়টি মূলত হচ্ছে কাবার দিকে পা দেওয়া প্রশ্ন। বাংলাদেশে বা সৌদি আরব থেকে যারা পূর্ব দিকে যারা বসবাস করেন তাদের জন্য কিবলা হচ্ছে পশ্চিম দিকে। আর যারা সৌদি আরব থেকে পশ্চিম দিকে অবস্থান করে তাদের কিবলা হচ্ছে পূর্ব দিকে। কাজেই এখানে মূল প্রশ্ন হবে কিবলার দিকে পা দিয়ে ঘুমানো যাবে কিনা। যদি পশ্চিম দিকে পা দিয়ে ঘুমানোর প্রশ্ন আসে তাহলে যারা সৌদি আরব থেকে পশ্চিমে বা উত্তরে বা দক্ষিনে বসবাস করে তাদের জন্য এই উত্তরটি প্রযোজ্য হবে না। কাজেই আমরা পশ্চিমের জায়গায় কিবলা শব্দটি ব্যবহার করে উত্তর দিচ্ছি।
ইসলামে কিবলার সম্মান
কিবলা হলো মক্কায় অবস্থিত পবিত্র কাবা ঘর। এটি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতীক। কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ
অনুবাদ: (তোমার মুখ পবিত্র মসজিদুল হারামের দিকে ফিরিয়ে নাও)। – সূরা বাকারা: ১৪৪
কিবলা কেবল নামাজের জন্য নির্ধারিত নয়; বরং এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব।
পশ্চিম দিকে পা দিয়ে ঘুমানো যাবে কিনা
পশ্চিম দিকে পা দিয়ে ঘুমানো উচিত নয়। কিবলার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অংশ হিসেবে ফিকহে অনেক বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেমন:
- কিবলার দিকে পায়খানা বা প্রস্রাব না করা।
- কিবলার দিকে পা প্রসারিত না করা।
পশ্চিম দিকে পা দিয়ে ঘুমানো ইসলামে মাকরুহ নাকি বৈধ? এই প্রশ্নের উত্তর বিভিন্ন মাজহাব ও ফকিহদের মধ্যে কিছুটা মতামতের রয়েছে।
আরব আলেমদের অভিমত
শায়খ ইবনে বায রাহিমাহুল্লাহসহ আরবের অনেক ফকিহ কিবলার দিকে পা দিয়ে ঘুমানোর বিষয়ে বলেছেন:
“এতে কোনো সমস্যা নেই। কিবলার দিকে পা প্রসারিত করা বৈধ। এমনকি যদি কেউ মসজিদুল হারামে থাকে এবং কাবার দিকে পা প্রসারিত করে, তাতেও কোনো বাধা নেই। নবী করিম (ﷺ) কাবার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছিলেন।
মূলত, কাবার দিকে পা প্রসারিত করা শরিয়তে নিষিদ্ধ নয়। এটি অনুমোদিত এবং এতে কোনো পাপ নেই।” এই লিংক থেকে তাঁর মূল ফাতাওয়াটি পড়তে পারবেন।
ফিকহি মতামত: হানাফি, শাফিয়ি ও হাম্বলি মাজহাব
হানাফি মাজহাব
হানাফি মাজহাবে কিবলার বা পশ্চিম দিকে পা দিয়ে ঘুমানোকে মাকরুহ গণ্য করা হয়।
قال الزيلعي في تبيين الحقائق : ويكره مد الرجل إلى القبلة وإلى المصحف وإلى كتب الفقه في النوم وغيره – (تبيين الحقائق، ১/১৬৮)
যিলাঈ “তাবিয়িনুল হাকায়েক”-এ বলেছেন: কিবলার দিকে পা প্রসারিত করা, কুরআন মাজীদ বা ফিকহের কিতাবদির দিকে পা প্রসারিত করা মাকরুহ। সেটা ঘুমের অবস্থায় হোক বা অন্য কোনো অবস্থায় (তাবিয়িনুল হাকায়েক, ১/১৬৮)
শাফিয়ি মাজহাব
শাফিয়ি মাজহাবের অনেক আলিম কিবলার সম্মান বজায় রাখতে এটি মাকরুহ বলেছেন। তবে এটি নিষিদ্ধ নয়।
হাম্বলি মাজহাব
হাম্বলি মাজহাবেও একই রকম মত রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, যেমন অসুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে, এটি অনুমোদিত। কাসফুশ কিনা”-তে বলা হয়েছে:
قال صاحب كشاف القناع : ( ويكره أن يسند الإنسان ظهره إلى القبلة ) نص عليه واقتصر الأصحاب على استحباب استقبالها وفي معنى ذلك مد الرجل إلى القبلة في النوم وغيره ومد رجليه في المسجد ذكره في الآداب قال ولعل تركه أولى.
“মানুষের জন্য কিবলার দিকে পিঠ ঠেকানো মাকরুহ। ফিকাহবিদগণ এখানে কিবলার সম্মান বজায় রাখতে সে দিকে মুখ করা পছন্দনীয় বলেছেন। এই অর্থেই ঘুমের সময় কিবলার দিকে পা প্রসারিত করাও মাকরুহ। এমনকি মসজিদে পা প্রসারিত করা সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটি এড়িয়ে চলা উত্তম।” (কাসফুশ কিনা, ২/৩৭)
কিবলার প্রতি পায়খানা প্রস্রাবের নিষেধাজ্ঞা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিবলার দিকে পেশাব পায়খানা করতে নিষেধ করেছেন। এগুলোর কারণে কিবলার সম্মান বিনষ্ট হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
إِذَا أَتَيْتُمْ الْغَائِطَ فَلَا تَسْتَقْبِلُوا الْقِبْلَةَ بِغَائِطٍ وَلَا بُولٍ وَلَكِنْ شَرِّقْولَ أَوْ غَرِّبُوا
(তোমরা যখন পায়খানা বা প্রস্রাব করতে যাও, তখন কিবলার দিকে মুখ বা পেছন দিও না। বরং পূর্ব বা পশ্চিম দিকে মুখ করো)। – সহীহ বুখারি
পায়ের দিক নির্ধারণ ও সমাজিক শিষ্টাচার
সমাজে বড়দের দিকে পা দেওয়া অভদ্রতা হিসাবে গণ্য হয়। কিবলা বা পশ্চিম দিকে পা দেওয়াটাও এই শিষ্টাচারের লঙ্ঘন। তাই এটি এড়িয়ে চলাই উত্তম।
বিশেষ পরিস্থিতিতে অনুমতি
বিশেষ পরিস্থিতিতে পশ্চিম দিকে পা দিয়ে ঘুমানো যাবে। কেননা শরিয়তে বিশেষ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে। যেমন:
- অসুস্থ ব্যক্তি যদি কিবলার দিকে পা দিয়ে শুয়ে থাকা ছাড়া অন্য কোনো উপায় না পায়।
- বসে নামাজ পড়ার সময় কিবলার দিকে পা রাখা অনুমোদিত।
এ প্রসংঙ্গে হানাফি মাযহাবের প্রশিদ্ধ কিতাব আদ্-দুররুল মুখতার-এ বলা হয়েছে::
و في الدر المختار : وإن تعذر القعود ولو حكما أومأ مستلقيا على ظهره ورجلاه نحو القبلة غير أنه ينصب ركبتيه لكراهة مد الرجل إلى القبلة ويرفع رأسه يسيرا ليصير وجهه إليها
– (الدر المختار، ৫/৪০২)
“যদি বসা সম্ভব না হয়, তবে এমন অবস্থায় নামাজের ইশারা করা যাবে যেখানে ব্যক্তি চিত হয়ে শুয়ে থাকবে এবং তার পা কিবলার দিকে থাকবে। তবে কিবলার দিকে পা প্রসারিত করাকে মাকরুহ মনে করে হাঁটু উঠিয়ে রাখা উত্তম। একই সঙ্গে মাথা কিছুটা উঁচু রাখা উচিত, যাতে মুখ কিবলার দিকে হয়।” (আদ্-দুররুল মুখতার, ৫/৪০২)
কিবলার অসম্মান করার উদ্দেশ্য
কিবলার দিকে পা প্রসারিত করা যদি অসম্মানজনক মনোভাব থেকে হয়, তাহলে এটি হারাম হবে। আল্লাহর ঘর কাবার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা বড় পাপ।
পশ্চিম দিকে পা দিয়ে ঘুমানো এবং পাপের প্রশ্ন
পশ্চিম দিকে পা দিয়ে ঘুমানো মাকরুহ হতে পারে, তবে এটি সরাসরি পাপ নয়। কোনো কাজ পাপ হিসেবে গণ্য করতে হলে কুরআন বা হাদিসে স্পষ্ট দলিল থাকতে হবে।
সমাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ইসলামি শিষ্টাচার
ইসলাম আমাদের সমাজিক শিষ্টাচার ও আচার-আচরণকে গুরুত্ব দিতে শিখিয়েছে। এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় দিক নয়, বরং একটি নৈতিক বিষয়ও। পশ্চিম দিকে পা না দেওয়া কিবলার সম্মান বজায় রাখার পাশাপাশি সামাজিক ভদ্রতাও প্রকাশ করে।
উপসংহার
পশ্চিম দিকে পা দিয়ে ঘুমানো ইসলামে সরাসরি নিষিদ্ধ নয়। তবে কিবলার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য এটি এড়িয়ে চলা উত্তম। এটি সামাজিক শিষ্টাচার ও ইসলামি চেতনাকে সুরক্ষিত রাখার একটি অভ্যাস।
প্রশ্ন উত্তর
১. পশ্চিম দিকে পা দিয়ে শোয়া কি হারাম?
না, এটি হারাম নয়। তবে এটি মাকরুহ বলে বিবেচিত।
২. কিবলার দিকে পা দিয়ে বসা কি অনুমোদিত?
না, এটি মাকরুহ। তবে যদি কোনো বৈধ কারণ থাকে, তাহলে এটি অনুমোদিত।
৩. অসুস্থ ব্যক্তির জন্য কিবলার দিকে পা রাখা কি অনুমতি আছে?
হ্যাঁ, বিশেষ পরিস্থিতিতে এটি অনুমোদিত।
৪. কিবলার প্রতি অসম্মান করলে কী পাপ হবে?
হ্যাঁ, কিবলার প্রতি অসম্মান করা পাপ এবং এটি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
৫. পশ্চিম দিকে পা না দিয়ে ঘুমানোর বিকল্প কী?
কিবলার দিক এড়িয়ে উত্তর বা দক্ষিণ দিকে পা রেখে ঘুমানো উত্তম।
সমাপ্তি: ইসলামের দৃষ্টিতে কিবলার প্রতি সম্মান প্রদর্শন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। পশ্চিম দিকে পা দিয়ে ঘুমানোর বিষয়ে সচেতন থেকে ইসলামি শিক্ষার আলোকে জীবন পরিচালনা করা উচিত।