সন্তান লাভের দোয়া । আমি এক দম্পতিকে দেখেছি। যারা একটি সুরম্য বিল্ডিংয়ে থাকতেন। বাজারের সবচেয়ে দামি গাড়ি তারা চালাতেন। তাদের ফুলের বাগান ছিল। সুবিশাল পুকুর ছিল। অনেক দাসী তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকতো। কিন্তু এত কিছুর পরও তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল। তারা তাদের পৃথিবীকে কুয়াশাচ্ছন্ন দেখেতো। তাদের জীবন অর্থহীন বলে মনে হচ্ছিলো। এ সবের কারণ ছিলো তাদের কোনো সন্তান ছিলো না।
সন্তান না থাকায় সম্ভাব্য সব উপায় প্রয়োগ করেও তরা সন্তান লাভ করতে পারনেননি। তাই তারা মনে করতেন সন্তান ছাড়া সম্পদ ও সম্মান মূল্যহীন।
তাদের এই গল্প থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, শিশুরা আল্লাহ তায়ালার প্রদত্ত একটি বিশেষ নেয়ামত এবং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সন্তান দান করেন। আর যাকে ইচ্ছা সন্তান ধারণ বঞ্চিত রাখেন। তাই সন্তান পেতে হলে সবার আগে গর্ভধারণের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করার বিকল্প নেই।
সন্তান লাভের দোয়া
সন্তান লাভের জন্য আমরা সে সব দোয়া করতে পারি যার দ্বারা আল্লাহর প্রিয় বান্দারা আল্লাহর কাছ থেকে সন্তান লাভ করেছিলেন। মনে রাখতে হবে, গর্ভধারণ ও সন্তান লাভের জন্য কোন নির্দিষ্ট দোয়া নেই। তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমরা পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন নবী ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের গল্পে উল্লেখিত দোয়াগুলো আমাদের আশার আলো দেখায়।
বিভিন্ন নবীর স্ত্রীগণ সেসব দোয়ার দ্বারা গর্ভবতী হওয়ার কথা পবিত্র কুরআনে এসেছে – তাই আপনি তাদের গর্ভধারণের দোয়াগুলোর উপর আমল করতে পারেন।
সন্তান লাভের দোয়াগুলো প্রাথমিকভাবে আরবি। আপনি যদি আরবি না জানেন তবে আপনি বাংলা ভাষায় দোয়া করতে পারেন। কেননা আল্লাহ সকল ভাষা বুঝেন এবং শুনেন।
জাকারিয়া আ. এর সন্তান লাভের দোয়া
সাইয়্যিদুনা জাকারিয়া আলাইহিস সালাম সন্তানের চেয়ে নিজের জন্য নিম্নোক্ত দোয়া করেছেন।
رَبِّ هَبْ لِي مِن لَّدُنْكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً ِّنَّكَ سَمِيعُ الدُّعَاء
উচ্চারণঃ রাব্বি হাবলি মিল্লাদুনকা জুররি-ইয়াতান তাই-ইবাতান। ইন্নাকা সামিউদ দুআ।
অনুবাদ: হে আমার পালনকর্তা, আমাকে আপনার কাছ থেকে একটি পবিত্র সন্তান দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি অতি দোয়া শ্রবণকারী। (সূরা আল ইমরান-৩৬)
ইব্রাহিম আঃ এর সন্তান লাভের দোয়া
প্রিয় নবী ইব্রাহিম আলায়হিস সালাম। তিনি প্রায় আশি বছর বয়সে একটি শিশুর জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন।
رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ
উচ্চারণঃ রাব্বি হুবলী মিনাস সালিহীন।
অনুবাদঃ হে আমার পালনকর্তা, আমাকে আপনার পক্ষ থেকে একটি সৎ সন্তান দান করুন। (সূরা সাফফাত: ১০০)
কুরআনে সন্তান লাভের দোয়া
আপনি পবিত্র কুরআনে নিম্নলিখিত প্রার্থনাটিও করতে পারেন। আল্লাহ তায়ালা আপনার প্রতি করুণার দৃষ্টিতে তাকালে হয়তো তিনি তা কবুল করবেন।
رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا’
উচ্চারণ– রাব্বানা হাব-লানা মিন আজওয়াযিনা ও জুররি-ইয়াতিনা কুররাতা আইয়ুনিন ওয়াজ-আলনা লিল মুত্তাকিনা ইমাম।
অনুবাদ: হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের জীবনসঙ্গী ও সন্তানদের নিয়ে আমাদের চোখ শীতল করুন। তাছাড়া আমাদেরকে মুত্তাকীদের ইমাম বানাও। (সূরা ফুরকান-৭৪)
আপনি পবিত্র কুরআনের নিচের দোয়াটি বেশি করে পড়তে পারেন। আশা করি আল্লাহ তায়ালা সাড়া দিবেন।
رَبِّ لَا تَذَرْنِي فَرْدًا وَأَنتَ خَيْرُ الْوَارِثِينَ
উচ্চারণ- রাব্বি লা তাইজারনি ফারদান। ওয়া আনতা খায়রুল ওয়ারিসীন।
অনুবাদঃ হে আমার প্রভু, আমাকে নিঃসন্তান রেখো না। তুমিই শ্রেষ্ঠ অভিভাবক। (সূরা আম্বিয়া-৬৯)
গর্ভধারণের জন্য দোয়ার গুরুত্ব
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে তাদের বিপদ ও বিভিন্ন সমস্যায় আল্লাহর সাহায্য চাইতে নির্দেশ দিয়েছেন।
তিনি সূরা ফাতিহাতে আমাদের শিখিয়েছেন, ‘আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং একমাত্র তোমার কাছেই সাহায্য চাই।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন – ‘দোয়াই ইবাদাত।’ (বুখারি ও মুসলিম)।
আবু হুরায়রা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে কিছু চায় না, আল্লাহ তার ওপর অসন্তুষ্ট হন। (তিরমিযী-৪৫৬)
সালমান ফারসী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“দোয়া ছাড়া আর কিছুই ভাগ্যের লেখাকে উল্টাতে পারে না, এবং ভালো কাজ ছাড়া আর কিছুই জীবনকে বাড়াতে পারে না।” (তিরমিযী, ৪৪৮)
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইসলামে দোয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই সন্তান লাভের জন্য দোয়ার কোনো বিকল্প হতে পারে না।
যে সকল বোনেরা সন্তান নিতে অধীর আগ্রহ দিন পার করছে। অনেক চেষ্টা করেও আপনি সন্তান নিতে পারছেন না। বিনীত চিত্তে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন। আল্লাহ অবশ্যই আপনার ডাকে সাড়া দেবেন।
গর্ভধারণের জন্য কার্যকর দোয়া করার টিপস
ইস্তেগফার সাগর সম পাপকে পুণ্যে পরিণত করতে পারে। আল্লাহ তায়ালার ক্ষমার দরজা খোলার জন্য অনন্য এটি অনন্য। সুতরাং, আপনি যদি ক্ষমা চান, তাহলে আল্লাহ তায়ালা করুণাময় হতে পারেন এবং আপনার গর্ভধারণের দোয়া কবুল করতে পারেন। সেরা ইস্তেগাফার হল :
اَللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّىْ لآ إِلهَ إلاَّ أَنْتَ خَلَقْتَنِىْ وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوْذُبِكَ مِنْ شَرِّمَا صَنَعْتُ، أبُوْءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَىَّ وَأَبُوْءُ بِذَنْبِىْ فَاغْفِرْلِىْ، فَإِنَّهُ لاَيَغْفِرُ الذُّنُوْبَ إِلاَّ أَنْتَ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা আনতা রব্বী লা ইলা-হা ইল্লা আনতা খালাক্বতানি, ওয়া আনা ‘আবদুকা ওয়া আনা আলা আহদিকা ওয়া ওয়া‘দিকা মাসতাত্বাতু, আঊযুবিকা মিন শার্রি মা ছানাতু। আবূউ লাকা বিনি‘মাতিকা ‘আলাইয়া ওয়া আবূউ বিযাম্বী ফাগফিরলী ফাইন্নাহূ লা ইয়াগফিরুয্ যুনূবা ইল্লা আনতা।
অর্থ : ‘হে আল্লাহ, আপনি আমার পালনকর্তা। আপনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি আপনার দাস। আমি আমার সাধ্যমত আপনার নিকটে দেওয়া অঙ্গীকারে ও প্রতিশ্রুতিতে দৃঢ় আছি। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট হতে আপনার নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমি আমার উপরে আপনার দেওয়া অনুগ্রহকে স্বীকার করছি এবং আমি আমার গোনাহের স্বীকৃতি দিচ্ছি। অতএব আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। কেননা আপনি ব্যতীত পাপসমূহ ক্ষমা করার কেউ নেই।’
দুই – তাওবা আগুনকে পানিতে, রাগকে দয়াতে এবং পাপকে পুরস্কারে পরিণত করতে পারে। তাই বেশি বেশি তওবা করুন।
আপনার পাপের নাম উল্লেখ করে এবং দয়াময় প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। অনুতাপের জন্য কোন নির্দিষ্ট বাক্য বা শব্দ নেই।
আপনার ভাষায় সুন্দর এবং সুস্বাদু খাবারের সাথে বাক্য তৈরি করে বিনীতভাবে অনুতপ্ত হন।
কখন এবং কিভাবে সন্তান লাভের জন্য প্রার্থনা করতে হবে?
আমরা উপরে গর্ভাবস্থার দোয়া ও আমল পেশ করেছি। তবে কখন কিভাবে করবেন এসব দোয়া ও আমল, এটা বাকি থাকে।
গর্ভাবস্থার দোয়া ও আমল অন্যান্য দোয়ার মতো একটি দোয়া। তাই পাক পবিত্র হয়ে যে কোন সময় করতে পারেন।
তবে হাদিসে দোয়া কবুলের কিছু উত্তম সময় রয়েছে। যেমন-
আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদিস আছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করা হল: কোন দোয়াটি অধিক গ্রহণযোগ্য? তিনি বললেন, শেষ রাতে এবং ফরজ সালাতের পরে। (তিরমিযী-৩৪৯৯)
ধৈর্য এবং আল্লাহর উপর ভরসা
সন্তানদের লাভের জন্য আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করার সময়, এটা মনে রাখা অপরিহার্য যে আল্লাহর পরিকল্পনা নিখুঁত। তিনি জানেন কোনটি আমাদের জন্য সর্বোত্তম এবং কোনটি আমাদের প্রকৃত সুখ নিয়ে আসবে। এটা হতে পারে যে গর্ভধারণে বিলম্ব করা ধৈর্য এবং আল্লাহর প্রজ্ঞার উপর আস্থার পরীক্ষা।
হযরত জাকারিয়া (আ.) এর কাহিনী একটি সুন্দর অনুস্মারক। তার বার্ধক্য এবং তার স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব সত্ত্বেও, তিনি তাকে একটি নেক সন্তান দান করার জন্য আল্লাহর ক্ষমতা থেকে কখনই আশা হারাননি।
তার অটল বিশ্বাস এবং দোয়ায় অটল থাকার পুরস্কার হিসাবে আল্লাহ তাকে হযরত ইয়াহিয়া আ. কে দান করেছিলেন।
চিকিৎসা সহায়তা
প্রার্থনার পাশাপাশি, ইসলামে গর্ভধারণে অসুবিধার সম্মুখীন হলে চিকিৎসা সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
চিকিৎসার অগ্রগতি এবং চিকিত্সা অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলির সমাধান করতে পারে এবং গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
মুসলিম দম্পতিদের উচিত চিকিৎকদের পরামর্শ করা, যারা নৈতিক মান বজায় রাখে এবং ইসলামী নীতিগুলি মেনে চলে। চিকিৎসা সহায়তা চাওয়া আল্লাহর উপর নির্ভরতার বিরোধিতা করে না বরং এটাও আল্লাহর সাহায্যের একটি মাধ্যম।
উপসংহার
সন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষা মানুষের মধ্যে একটি স্বাভাবিক প্রবণতা। ইসলামে, সন্তান লাভের জন্য দোয়া অনেক গুরুত্ব রয়েছে। দোয়ার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের আন্তরিক ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারি, তাঁর নির্দেশনা চাওয়া এবং তাঁর ঐশ্বরিক পরিকল্পনার উপর আস্থা রাখা আবশ্যক।
এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা শিশুদের জন্য প্রার্থনা করার সময়, আমাদের অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে এবং আল্লাহর প্রজ্ঞার উপর আস্থা রাখতে হবে।
তিনি জানেন আমাদের জন্য কোনটি সর্বোত্তম এবং তাঁর অসীম জ্ঞানে আমাদের সবচেয়ে উপযুক্ত। প্রক্রিয়ায়, চিকিৎসা সহায়তা চাওয়া অনুমোদিত এবং যেকোন অন্তর্নিহিত সমস্যা সমাধানের একটি অতিরিক্ত উপায় হতে পারে।