ইসলামে তাহারাত বা পবিত্রতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। শুধু বাহ্যিক পবিত্রতা নয়, বরং আত্মিক ও আধ্যাত্মিক পবিত্রতাও অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য পবিত্রতা অপরিহার্য। এই ব্লগপোস্টে আমরা তাহারাতের সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, পবিত্রতার গুরুত্ব ও ফজিলত ইত্যাদি বিষয়গুলো কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিশদ আলোচনা করছি।
তাহারাত শব্দের অর্থ কী?
ভাষাগত সংজ্ঞা: ( طهارة) তাহারাত শব্দের অর্থ হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, অপবিত্রতা বা মলিনতা থেকে নিরাপদ থাকা। সেটা বাহ্যিক (শারীরিক) হোক বা আন্তরিক (আধ্যাত্মিক) হোক।
পারিভাষিক সংজ্ঞা: শারঈ পরিভাষায় তাহারাত বলতে বোঝানো হয়— হাদস (শারীরিক অপবিত্রতা) অথবা খাবাস (অশুচি) অথবা নাজাসাত (নাপাক) দূর করা। সেটা পানির মাধ্যমে হোক বা প্রয়োজনে পবিত্র মাটি ব্যবহার করে সম্পন্ন করা হোক।
তাহারাতের আরেকটি সংজ্ঞা হলো—শরীর থেকে এমন বৈশিষ্ট্য দূর করা যা নামাজ আদায়ে বাধা সৃষ্টি করে।
হাদস হলো – শরীর ওপর বা শরীরের কোনো অংশে সংঘটিত একটি বৈশিষ্ট্য। শরীর থেকে এটি দূর করার মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জিত হয়।
খাবাস হলো: ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে নোংরা বস্তু। সেটি শরীরের দৃশ্যমান অংশ থেকে দূর করার দ্বারা পবিত্রা অর্জিত হয়।
তাহারাতের প্রকারভেদ
তাহারাত দুই প্রকার:
১. বাহ্যিক পবিত্রতা (طهارة حسية):
বাহ্যিক পবিত্রতা বলতে বুঝায় – অপবিত্রতা দূর করা এবং শারীরিক পবিত্রতা অর্জন করা। বাহ্যিক পবিত্রতা আবার দুইভাবে বিভক্ত:
(ক) নাপাক দূরীকরণ (رفع الحدث) – এমন অবস্থা যা, মানুষের উপর বিদ্যমান থাকলে নামাজ বা ইবাদত গ্রহণযোগ্য হয় না। এটি দুই প্রকার:
- বড় অপবিত্রতা (حدث أكبر): এখানে সহবাস, স্বপ্নদোষ, মাসিক এবং সন্তান জন্মের পর নিঃসৃত রক্ত (নেফাস) অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন:
- ছোট অপবিত্রতা (حدث أصغر): এটি যেমন প্রস্রাব, মযি, ওদি বা পায়ুপথ থেকে বাতাস নির্গত হওয়া।
(খ) অশুচি দূরীকরণ (إزالة النجس) : এটি কাপড়, দেহ বা স্থান থেকে নাপাকি দূর করার প্রক্রিয়া। আল্লাহ বলেন:
“তোমার কাপড় পবিত্র রাখো।” (সূরা মুদ্দাসসির: ৪)
২. আত্মিক পবিত্রতা (طهارة معنوية):
আত্মিক বা অন্তরের পবিত্রতা মানে হল হৃদয়কে পাপ, হিংসা এবং হিংস্রতা থেকে মুক্ত করা।
নবী (সা.) বলেন:
“আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক রূপ ও সম্পদের দিকে তাকান না, বরং তিনি তোমাদের হৃদয় ও কর্মের দিকে তাকান।” (সহীহ মুসলিম)
উদাহরণস্বরূপ, এক নারী একটি কুকুরকে পানি পান করানোর জন্য তার জুতো ব্যবহার করেছিলেন। আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হন এবং তার পাপ ক্ষমা করে দেন। এটি আত্মিক পবিত্রতার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
পবিত্রতার গুরুত্ব ও ফজিলত
পবিত্রতার গুরুত্ব বুঝানোর জন্য অনেক আয়াত ও হাদিস রয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন,
নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারী ও ভালোভাবে পবিত্রা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন। ( সুরা বাকারা ; ২২২ )
তাহারাতের গুরুত্ব বোঝাতে নবী (সা.) বলেছেন:
“পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক।” (সহীহ মুসলিম)
পবিত্রতা মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। এটি ব্যক্তি, সমাজ এবং পরিবেশের নির্মল ও পরিচ্ছন্নতার বার্তা বহন করে।
তাহারাতের আবশ্যকতা
সামর্থ্য বিদ্যমান থাকা অবস্থায় তাহারাত বা পবিত্রতা অর্জন করা আবশ্যক। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“আর তোমার পোশাক পবিত্র করো।” (সূরা আল-মুদ্দাসসির: ৪)
অন্য আয়াতে তিনি বলেন:
“আর যখন আমি ঘরটিকে মানুষের জন্য মিলনস্থল ও নিরাপদ স্থান করলাম, তখন ইবরাহিম ও ইসমাইলকে নির্দেশ দিলাম যে, আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী, রুকু ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো।” (সূরা আল-বাকারা: ১২৫)
তাহারাত ও ইবাদতের সম্পর্ক
তাহারাত ছাড়া ইবাদত কবুল হয় না। শরীর, কাপড় ও স্থানকে পবিত্র রাখা নামাজসহ অন্যান্য ইবাদতের শর্ত।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“পবিত্রতা ছাড়া কোনো নামাজ গ্রহণ করা হয় না।” (সহীহ মুসলিম)
তাহারাত এর উদ্দেশ্য
১. আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন: তাহারাত আল্লাহর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধার প্রতীক। পবিত্রতা বজায় রাখা আল্লাহর আদেশ পালনের একটি প্রমাণ।
২. আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন: আল্লাহ তায়ালা পবিত্র ও পরিশুদ্ধ ব্যক্তিদের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন:
“সেখানে ( কুবায়) এমন কিছু লোক আছে, যারা উত্তমভাবে পবিত্র হতে ভালোবাসে, আর আল্লাহ পবিত্রদের ভালোবাসেন।” (সূরা আত-তাওবা: ১০৮)
তাহারাত অর্জনের উপকরণসমূহ
১. পানি
তাহারাত অর্জনের মূল উপকরণ হলো পানি। শরিয়তে এটি তাহারাতের জন্য প্রাথমিক মাধ্যম হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে,
তাহারাতের জন্য প্রধান মাধ্যম হলো পানি।
কুরআন ও হাদিসে বারবার পানির উল্লেখ এসেছে এবং তাহারাতের জন্য এর গুরুত্ব স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাহারাতের মূল মাধ্যম হিসাবে পানি ব্যবহারের বিষয়ে ফুকাহাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
- জুমহুরের মত: অধিকাংশ আলেম মনে করেন, পানি ব্যবহার করেই অপবিত্রতা দূর করতে হবে।
- অন্য মত: ইমাম আবু হানিফা এবং ইমাম আবু ইউসুফের মতে, অন্যান্য উপকরণ বা পদার্থও তাহারাতের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
২. মাটি
মাটিও তাহারাত অর্জনের জন্য শরীয়তে নির্ধারিত একটি মাধ্যম। উদাহরণস্বরূপ:
- কুকুরের লালা পরিষ্কার করা: কুকুর কোনো পাত্রে মুখ দিলে তা সাতবার ধুতে হবে, যার মধ্যে একবার মাটি দিয়ে ধোয়ার নির্দেশ রয়েছে।
- তায়াম্মুম: মাটি ব্যবহার করে তায়াম্মুম করা হয়, যা তখন প্রযোজ্য যখন পানি পাওয়া যায় না বা পানি ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। তায়াম্মুম করার সময় পুরো মুখ মাটি দিয়ে মাসহ করতে হবে এবং দুই হাত কনুই পর্যন্ত মাসহ করতে হবে। কোনো বাধা থাকলে যেমন আংটি বা বালা, তা সরিয়ে নিতে হবে।
৩. পাথর
পাথর ব্যবহার করে অপবিত্রতা দূর করাকে ইস্তিজমার বলা হয়। এটি তখনও বৈধ, যখন পানি পাওয়া যায়। চার মাজহাবের আলেমরা এ বিষয়ে একমত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“আমি তোমাদের অভিভাবকের মতো; তোমাদের শিক্ষা দেই। যদি কেউ প্রাকৃতিক কাজ করতে যায়, তবে কেবলার দিকে মুখ করবে না এবং পেছন ঘুরাবে না। তিনটি পাথর দিয়ে ইস্তিজমার করবে এবং শুকনো গোবর বা হাড় ব্যবহার করবে না।” (সহীহ মুসলিম)
ইস্তিজমার: ইস্তিজমার বলতে বোঝানো হয়, প্রাকৃতিক কাজের পর দুই রাস্তা (মলমূত্র ত্যাগের পথ) পরিষ্কার করা। এর জন্য পাথর, কাগজ বা অন্য কোনো পবিত্র বস্তু ব্যবহার করা যায়।
তাহারাত এর লক্ষ্য
১. অজু (উজু)
অজু হল নামাজের শুদ্ধতার জন্য একটি আবশ্যিক শর্ত। অজু ছাড়া নামাজ বৈধ নয়। তবে অজু থাকা সত্ত্বেও নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক নয়; নামাজ না পড়লেও একজন মুসলিম অজু করতে পারেন।
- অজুর ধরন:
- ফরজ অজু: আবশ্যিক ইবাদতের জন্য যেমন ফরজ নামাজ এবং ফরজ তাওয়াফ।
- সুন্নত বা মুস্তাহাব অজু: নফল ইবাদতের জন্য যেমন দোয়া, জিকির, কুরআন তিলাওয়াত, নফল তাওয়াফ এবং নফল নামাজ।
২. গোসল
গোসল বলতে বুঝায় পবিত্র পানি দ্বারা সম্পূর্ণ শরীর ধৌত করা এবং এ উদ্দেশ্যে নিয়ত করা। গোসল ফরজ হওয়ার কিছু কারণ:
- সহবাস।
- বীর্যপাত।
- ঋতু বন্ধ হওয়া।
- সন্তান জন্ম দেওয়ার পর নেফাস।
গোসল শুধু ফরজ নয়, এটি সুন্নতও হতে পারে, যেমন: জুমার দিনে নামাজের আগে গোসল করা।
৩. তায়াম্মুম
যখন পানি পাওয়া যায় না, অথবা পানি ব্যবহার করা সম্ভব নয় (রোগ বা ভ্রমণের কারণে), তখন তায়াম্মুম করা যায়। কুরআন, হাদিস ও আলেমদের ঐকমত্যে তায়াম্মুমের অনুমোদন প্রমাণিত।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“আর যদি তোমরা অসুস্থ হও অথবা ভ্রমণরত থাকো, কিংবা কারও পায়খানা থেকে আসার প্রয়োজন হয় অথবা তোমরা স্ত্রীদের স্পর্শ কর এবং পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করো এবং মুখমণ্ডল ও হাত মুছে নাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা আন-নিসা: ৪৩)
তায়াম্মুম গোসল ও অজুর বিকল্প হিসেবে নির্ধারিত। তবে এটি নির্দিষ্ট শর্তের আওতায় কার্যকর।
তাহারাত সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা
কুরআনে পবিত্রতার বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:
- নাপাকি দূর করার নির্দেশ: আল্লাহ বলেন: “তোমার কাপড় পবিত্র রাখো।” (সূরা মুদ্দাসসির: ৪)
- নামাজের আগে পবিত্রতা অর্জন: আল্লাহ বলেন: “যখন তোমরা নামাজের জন্য দাঁড়াবে, তখন তোমাদের মুখমণ্ডল এবং হাত ধুয়ে নাও।” (সূরা মায়েদা: ৬)
হাদিসেও পবিত্রতার বিষয়ে বিস্তর আলোচনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:
- নবী (সা.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি প্রস্রাব থেকে বাঁচতো না, তাকে কবরের আজাব দেওয়া হচ্ছে।” (সহীহ বুখারি)
- একবার এক বেদুইন মসজিদে প্রস্রাব করলে নবী (সা.) তাকে বাধা দিতে নিষেধ করেন এবং সাহাবাদের সেই স্থানে পানি ঢেলে পরিষ্কার করার নির্দেশ দেন। (সহীহ বুখারি)
উপসংহার
তাহারাত ইসলামের একটি মৌলিক অংশ। এটি শুধুমাত্র বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতা নয়, বরং এটি আত্মিক উন্নতি এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। পবিত্রতা ছাড়া ইবাদত গ্রহণযোগ্য নয়। তাই প্রত্যেক মুমিনের উচিত তাহারাত বজায় রাখা এবং কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা অনুসরণ করা।
সচরাচর জিজ্ঞাসা
প্রশ্ন ১: তাহারাত কি শুধুমাত্র নামাজের জন্য প্রয়োজন?
উত্তর: না, তাহারাত শুধু নামাজের জন্য নয়, বরং সব ধরনের ইবাদতের জন্য অপরিহার্য।
প্রশ্ন ২: ছোট অপবিত্রতা এবং বড় অপবিত্রতার মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর: ছোট অপবিত্রতা দূর করতে অজু যথেষ্ট, তবে বড় অপবিত্রতার জন্য গোসল করা আবশ্যক।
প্রশ্ন ৩: অপবিত্রতা দূর করার সঠিক পদ্ধতি কী?
উত্তর: কাপড় বা দেহে অপবিত্রতা থাকলে তা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা উচিত। অপবিত্র স্থানে নামাজ পড়ার আগে সেই স্থানও পবিত্র করতে হবে।