ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যেখানে শুধু বড় বড় ইবাদত নয়, বরং প্রতিটি ক্ষুদ্র কাজের মাঝেও রয়েছে বরকত ও সওয়াব অর্জনের সুযোগ। অযুর দোয়া — যা আত্মিক ও বাহ্যিক পবিত্রতার এক গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলন—তার প্রতিটি ধাপে দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের এক অপূর্ব সুযোগ এনে দেয়।
আমরা অনেকেই ওজুর সময় শুধু অঙ্গ ধোয়া ও তার শর্তগুলো পালন করে থাকি, অথচ প্রতিটি অঙ্গ ধোয়ার পেছনে রয়েছে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ দোয়া ও আদব, যা শুধু অঙ্গ ধোয়ার কাজকে নয়, বরং পুরো আমলটিকে ইবাদতে রূপান্তর করে। এই দোয়াগুলো আমাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে, আমলকে করে আরও প্রাণবন্ত ও অর্থবহ।
এই ব্লগপোস্টে আমরা আলোচনা করবো—
🔹 ওযুর পরের প্রমাণিত দোয়া ও তার ফজিলত
🔹 ওযুর প্রতিটি অঙ্গ ধোয়ার সময় পাঠযোগ্য দোয়াগুলো (যা কিছু সালাফ ও ফুকাহা কর্তৃক উল্লেখিত)
🔹 প্রতিটি দোয়ার আরবি, উচ্চারণ এবং অর্থ
🔹 এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ—যা আপনার ওজুকে করে তুলবে আরও পূর্ণতা ও ইখলাসভরা
আসুন, এই পবিত্র অভ্যাসকে শুধুই আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে না দেখে—তা হৃদয়ের সাথে যুক্ত করি দোয়ার মাধ্যমে। কারণ, পবিত্রতা শুধু বাহ্যিক নয়—আত্মিক পবিত্রতাও ইসলামের চিরন্তন আহ্বান।
অযুর দোয়া
🌿 ১. কফ ধোয়ার সময়:
আরবি:
اللَّهُمَّ احْفَظْ يَدَيَّ مِنْ مَعَاصِيكَ كُلِّهَا
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইহফায ইয়াদাইয়া মিন মা‘আসীকা কুল্লিহা।
বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ! আমার হাতকে তোমার সব ধরনের অবাধ্যতা থেকে রক্ষা করুন।
🌿 ২. মুখে পানি নেওয়ার সময় (মাদমাদাহ):
আরবি:
اللَّهُمَّ أَعِنِّي عَلَى تِلَاوَةِ الْقُرْآنِ وَذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আ‘ন্নি ‘আলা তিলাওয়াতিল কুরআন, ওয়া জিকরিকা, ওয়া শু্করিকা, ওয়া হুসলি ইবাদাতিকা।
বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ, আমাকে কুরআন তিলাওয়াত, আপনার জিকির, আপনার শুকরিয়া আদায় এবং উত্তম ইবাদতে সাহায্য করুন।
🌿 ৩. নাকে পানি নেওয়ার সময় (ইস্তিনশাক)
আরবি:
بِسْمِ اللَّهِ، اللَّهُمَّ أَرِحْنِي رَائِحَةَ الْجَنَّةِ، وَلَا تُرِنِي رَائِحَةَ النَّارِ
উচ্চারণ: বিসমিল্লাহ, আল্লাহুম্মা আরিহনি রা-ইহাতাল জান্নাহ, ওয়া লা তুরিনি রা-ইহাতান নার।
বাংলা অর্থ: আল্লাহর নামে শুরু করছি, হে আল্লাহ! আমাকে জান্নাতের সুবাস উপভোগ করান, আর জাহান্নামের দুর্গন্ধ কখনো দেখাবেন না।
🌿 ৪. মুখ ধোয়ার সময়
আরবি:
اللَّهُمَّ بَيِّضْ وَجْهِي يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা বাইয়্যিদ ওয়াজহি ইয়াওমা তাবইয়াদ্দু উজূহু ওয়া তাসওাদ্দু উজূহ।
বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ, যেদিন কিছু মুখ উজ্জ্বল হবে আর কিছু মুখ কালো হয়ে যাবে, সেদিন আমার মুখ উজ্জ্বল করে দিও।
🌿 ৫. ডান হাত ধোয়ার সময়
আরবি:
اللَّهُمَّ أَعْطِنِي كِتَابِي بِيَمِينِي، وَحَاسِبْنِي حِسَابًا يَسِيرًا
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আ‘তিনি কিতাবি বিযামিনী, ওয়া হাসিবনি হিসাবান ইয়াসিরা।
বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ, আমাকে আমার আমলনামা ডান হাতে দিন এবং আমাকে সহজ হিসাব নিকাশে হিসাব করুন।
🌿 ৬. বাম হাত ধোয়ার সময়
আরবি:
اللَّهُمَّ لَا تُعْطِنِي كِتَابِي بِشِمَالِي، وَلَا مِنْ وَرَاءِ ظَهْرِي
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা লা তু‘তিনি কিতাবি বিশিমালি, ওয়া লা মিন ওরাই যাহরি।
বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ! আমাকে আমার আমলনামা বাম হাতে দেবেন না, কিংবা পেছন দিক থেকেও নয়।
🌿 ৭. মাথা মাসেহ করার সময়
আরবি:
اللَّهُمَّ حَرِّمْ شَعْرِي وَبَشَرِي عَلَى النَّارِ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা হাররিম শা‘রি ওয়া বাশারি ‘আলান নার।
বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ! আমার চুল ও চামড়াকে জাহান্নামের আগুনের জন্য হারাম করে দিন।
🌿 ৮. কান মাসেহ করার সময়
আরবি:
اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِنَ الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ، فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইজ‘আলনি মিনাল্লাযীনা ইয়াসতামি‘উনাল কাওলা ফাইত্তাবি‘উনা আহসানাহু।
বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ, আমাকে সেইসব মানুষের অন্তর্ভুক্ত করুন, যারা কথা শোনে এবং তার উত্তমটিই অনুসরণ করে।
🌿 ৯. পা ধোয়ার সময়
আরবি:
اللَّهُمَّ ثَبِّتْ قَدَمَيَّ عَلَى الصِّرَاطِ، يَوْمَ تَزِلُّ الْأَقْدَامُ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা সাব্বিত কাদামাইয়া ‘আলাসসিরাত, ইয়াওমা তাজিলুল আকদাম।
বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ, সেই দিন যেদিন অনেক পা পিছলে যাবে, সেদিন আমার পা সিরাতে মজবুত রাখুন।
ওজুর পরে পাঠযোগ্য দোয়া ও এর ফজিলত
দোয়া: ওজু শেষ করে বলা হয়—
أشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، وأشهد أن محمداً عبده ورسوله،
اللهم اجعلني من التوابين، واجعلني من المتطهرين،
سبحانك اللهم وبحمدك، أشهد أن لا إله إلا أنت، أستغفرك وأتوب إليك
বাংলা অনুবাদ: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।
হে আল্লাহ! আমাকে তওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন, আমাকে পবিত্রতা অর্জনকারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করুন।
হে আল্লাহ, আপনি পবিত্র, আপনার জন্য সমস্ত প্রশংসা, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আপনার দিকেই ফিরে আসছি।
এরপর: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি দরূদ-সালাম পাঠ করা মুস্তাহাব (উত্তম)। যেমন বলা:
اللهم صل وسلم على محمد وآل محمد
(হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবার-পরিজনের উপর দরূদ ও সালাম প্রেরণ করুন।)
হাদীসের প্রমাণ
✅ সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ ও ইবনু মাজাহে বর্ণিত: হযরত উমর (রাযি.) হতে মারফু হাদীসে এসেছে:
“তোমাদের কেউ যখন ওজু করে এবং তা পূর্ণভাবে করে, এরপর বলে—
‘أشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، وأشهد أن محمداً عبده ورسوله’
—তখন তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেওয়া হয়; সে যেকোনো দরজা দিয়ে ইচ্ছা করে প্রবেশ করতে পারবে।”
✅ তিরমিজি: এই হাদীসে আরও যোগ করেছেন:
“سبحانك اللهم وبحمدك، أشهد أن لا إله إلا أنت، أستغفرك وأتوب إليك”
“اللهم اجعلني من التوابين، واجعلني من المتطهرين”
এই বাড়তি অংশগুলো আহমদ ও আবু দাউদও বর্ণনা করেছেন।
✅ নাসায়ী ও হাকিম (সহীহ বলেছেন) — হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাযি.) থেকে বর্ণিত:
“যে ব্যক্তি ওজু করে, তারপর বলে—
‘سبحانك اللهم وبحمدك، أشهد أن لا إله إلا أنت، أستغفرك وأتوب إليك’
—তার এ কথাগুলো লিখে রাখা হয় একটি কাগজে, এবং তা সীলমোহর দিয়ে সিল করা হয়, কিয়ামত পর্যন্ত তা ভাঙা হবে না।” অর্থাৎ: তার দোয়া বাতিল বা অকার্যকর হবে না।
✅ আল-সামুরী বলেন: ওজুর পরে সূরা কদর তিনবার পড়া উত্তম।
✦ অযুর দোয়া: বেদআত নাকি সুন্নাহ? একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্লেষণ
ইসলামী শরীয়তে ইবাদতের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়েই দলিলের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই যখন কেউ বলে, “অযুর সময় অঙ্গ ধোয়ার নির্দিষ্ট দোয়া পাঠ করা বেদআত”—তখন প্রশ্ন উঠে: এর পক্ষে বা বিপক্ষে সত্যিকারের শরয়ি অবস্থান কী?
🔹 প্রথমত: প্রমাণিত দোয়া কোনটি?
সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত দোয়া হলো ওযু শেষে পাঠযোগ্য দোয়া:
“أشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، وأشهد أن محمدًا عبده ورسوله. اللهم اجعلني من التوابين، واجعلني من المتطهرين.”
– (সহীহ মুসলিম: ২৩৪, তিরমিজি: ৫৫)
এর সাথে আরও রয়েছে:
“سبحانك اللهم وبحمدك، أشهد أن لا إله إلا أنت، أستغفرك وأتوب إليك”
– (তিরমিজি, নাসায়ী, হাকিম)
এগুলো অযু শেষে পড়া সুন্নাহ। এগুলোর ফজিলতও হাদিসে এসেছে—“জান্নাতের আটটি দরজা তার জন্য খুলে দেওয়া হবে…”
🔹 দ্বিতীয়ত: অঙ্গ ধোয়ার সময় যেসব দোয়া পড়া হয়, সেগুলোর হুকুম কী?
এই দোয়াগুলো যেমন:
- কুল ধোয়ার সময়: “اللهم أعني على تلاوة القرآن وذكرك وشكرك”
- মুখ ধোয়ার সময়: “اللهم بيض وجهي يوم تبيض وجوه وتسود وجوه”
- ডান হাত ধোয়ার সময়: “اللهم أعطني كتابي بيميني…” ইত্যাদি।
👉 এসব দোয়ার বিশুদ্ধ সানাদে হাদিসে কোনো প্রমাণ নেই। অর্থাৎ রাসূল (সা.) কিংবা সাহাবায়ে কেরাম থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে এগুলোর আমল প্রমাণিত হয়নি।
📌 তাই ইসলামী উসূল অনুযায়ী বলা হয়:
- যদি কেউ এগুলোকে “সুন্নাহ” বা “ফরজ” মনে করে নিয়মিত আমল করে, তবে সেটা বেদআত হবে।
- কিন্তু কেউ যদি এগুলোকে ইবাদতের অংশ মনে না করে, বরং সাধারণ দোয়া মনে করে — এবং মাঝে মাঝে পাঠ করে বা শেখার উদ্দেশ্যে পড়ে — তাহলে সেটি হারাম বা বেদআত নয়, বরং বৈধ।
🔹 তৃতীয়ত: সালাফদের অভিমত
বিভিন্ন ফিকহ মাযহাবে এসব দোয়া “আদাব” বা “فضائل” নামে কিছু কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশেষ করে কিছু মালিকি ও শাফেয়ি কিতাবে। তবে অনেক মুহাদ্দিস ও উসূলবিদ যেমন ইবনে তাইমিয়্যা, ইমাম নববী ও ইবনে বাজ প্রমুখ এগুলোর হাদিস ভিত্তির অভাবের কারণে আমল থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করেছেন।
✅ সারসংক্ষেপ
বিষয় | হুকুম |
---|---|
ওজু শেষে “আশহাদু…اللهم اجعلني من التوابين…” | সুন্নাহ, হাদিস দ্বারা প্রমাণিত |
অযুর অঙ্গ ধোয়ার সময় নির্দিষ্ট দোয়া | হাদিসে প্রমাণ নেই; সুন্নাহ নয় |
এই দোয়াগুলো নিয়মিত ও ইবাদত মনে করে পড়া | বেদআত |
মাঝে মাঝে সাধারণ দোয়া মনে করে পড়া | বৈধ, তবে সাবধানতা অবলম্বন করা উত্তম |
🔸 উপদেশ
আমল করার আগে জেনে নিই: রাসূল (সা.) যেভাবে করেছেন, সেভাবেই ইবাদত করি। অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি পরিহার করি, কারণ—
قال رسول الله ﷺ: “إياكم والغلو في الدين، فإنما هلك من كان قبلكم بالغلو في الدين”
– (নাসায়ী, ইবনু মাজাহ)