আখিরাতের প্রতিটি বিষয় আমাদের বিশ্বাস, চিন্তা ও কর্মপদ্ধতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। কুরআনের এমন কিছু শব্দ ও ধারণা আছে—যা শুধু শব্দমাত্র নয়, বরং আমাদের আত্মা ও নিয়তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তেমনি দুটি শব্দ হলো: ইল্লিন ও সিজ্জিন । এরা আমাদের চূড়ান্ত পরিণতির দুই বিপরীত মেরু—একটি সম্মানিত উচ্চতর অবস্থানের প্রতীক, অন্যটি অপমানজনক অধঃপতনের প্রতিচ্ছবি।
সূরা আল-মুতাফফিফীন-এ এই দুটি শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দেন মুমিন ও ফাসিকদের আমলনামা সংরক্ষণের ভিন্ন ভিন্ন স্থান। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে— ইল্লিন ও সিজ্জিন আসলে কী? এগুলো কি প্রতীকী কোনো ধারণা, নাকি বাস্তব কোনো সত্তা বা স্থান? এগুলোর অবস্থান কোথায়? এগুলোর সঙ্গে আমাদের আমলের কী সম্পর্ক?
এই ব্লগপোস্টে আমরা চেষ্টা করবো, কুরআন ও হাদীসের আলোকে ইল্লিয়িন ও সিজ্জিন-এর প্রকৃতি, অর্থ, ব্যাখ্যা ও শিক্ষাগুলো বুঝে নিতে।
✦ ইল্লিন ও সিজ্জিন । পরকালের দুই বিপরীত গন্তব্য
১. ইল্লিয়িন ও সিজ্জিনের অর্থ
ইল্লিয়িন (عِلِّيِّين) শব্দটি এসেছে আরবি “علوّ” মূল থেকে, যার অর্থ উচ্চতা, ঊর্ধ্বে ওঠা বা উচ্চস্থানে অবস্থান। এটি একবচনে “علّيّ” এবং বহুবচনে “عِلِّيِّين” – অর্থাৎ সবচেয়ে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন স্থানসমূহ।
সিজ্জিন (سِجِّين) শব্দটি এসেছে “سَجْن” মূল থেকে, যার অর্থ কারাগার, আটক বা সীমাবদ্ধ করা। “সিজ্জিন” মানে অত্যন্ত নিচু, সংকীর্ণ ও আবদ্ধ স্থান – যা হতে পারে জাহান্নামের এক স্তর বা আমলনামা সংরক্ষণের অন্ধকার কারাগার।
২. কুরআনে ইল্লিয়িন ও সিজ্জিন
এই দুই শব্দের উল্লেখ এসেছে সূরা আল-মুতাফফিফীন-এ:
◉ সিজ্জিনের উল্লেখ
كَلَّا إِنَّ كِتَابَ الْفُجَّارِ لَفِي سِجِّينٍ – وَمَا أَدْرَاكَ مَا سِجِّينٌ – كِتَابٌ مَّرْقُومٌ
“না, পাপাচারীদের আমলনামা তো সিজ্জিনে থাকবে। আপনি কী জানেন, সিজ্জিন কী? এটি একটি লিপিবদ্ধ দলিল।” — (সূরা আল-মুতাফফিফীন 83:7-9)
◉ ইল্লিয়িনের উল্লেখ:
كَلَّا إِنَّ كِتَابَ الْأَبْرَارِ لَفِي عِلِّيِّينَ – وَمَا أَدْرَاكَ مَا عِلِّيُّونَ – كِتَابٌ مَّرْقُومٌ – يَشْهَدُهُ الْمُقَرَّبُونَ
“না, সৎকর্মশীলদের আমলনামা তো ইল্লিয়িনে থাকবে। আপনি কী জানেন, ইল্লিয়িন কী? এটি একটি লিপিবদ্ধ দলিল, যেটির সাক্ষী থাকেন নৈকট্যপ্রাপ্তরা।” — (সূরা আল-মুতাফফিফীন 83:18-21)
৩. তাফসিরবিদদের ব্যাখ্যা
▣ সিজ্জিন সম্পর্কে ব্যাখ্যা:
– ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন: এটি সাত নম্বর পৃথিবীর নিচে অবস্থিত জাহান্নামের এক স্তর, যেখানে কাফির ও ফাসিকদের আমলনামা সংরক্ষিত হয়।
– কাতাদা ও মুজাহিদ বলেন: এটি একটি অতি সংকীর্ণ জায়গা, যার নাম ‘সিজ্জিন’, যেখানে পাপীদের রুহ ও কৃতকর্ম সংরক্ষিত হয়।
▣ ইল্লিয়িন সম্পর্কে ব্যাখ্যা:
– ইবনে কাসীর বলেন: এটি সপ্তম আসমানের উপরে সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থান, যেখানে মুত্তাকী ও সৎদের আমলনামা রাখা হয়।
– তাফসিরে কুরতুবি ও জালালাইন অনুসারে, এটি শুধু একটি স্থান নয়, বরং এক সম্মান ও নৈকট্যের মর্যাদা।
৪. প্রতীক না বাস্তব?
অনেক আধুনিক চিন্তাবিদ এই শব্দগুলোকে প্রতীক হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন – যেমন “সিজ্জিন” অর্থ গভীর দুর্দশা এবং “ইল্লিয়িন” মানে চূড়ান্ত আত্মিক উৎকর্ষ। কিন্তু অধিকাংশ সালাফি ও ক্লাসিক্যাল তাফসিরকারগণ একে বাস্তব স্থান এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত পুরস্কার ও শাস্তির সংরক্ষণাগার হিসেবে মেনে নিয়েছেন।
৫. আমাদের জীবনে এর তাৎপর্য
ইল্লিয়িন ও সিজ্জিন আমাদের জন্য কেবল দুটি গন্তব্যের নাম নয়—বরং সতর্কতা ও অনুপ্রেরণার প্রতীক।
– আমাদের প্রতিটি আমল লিখিত হচ্ছে।
– কোন বইটি আমাদের জন্য নির্ধারিত হবে—তা আজকের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে।
– ইল্লিয়িনের বই পাবে তারা যারা অন্তর বিশুদ্ধ করে আল্লাহর পথে চলে।
– সিজ্জিনে নাম লেখাবে তারা, যারা অহংকার, অবাধ্যতা ও পাপাচারে লিপ্ত থাকবে।
✦ উপসংহার
ইল্লিয়িন ও সিজ্জিন—এই দুটি শব্দ যেন আমাদের চেতনাকে নাড়া দেয়। যেন মনে থাকে, আমলনামা শুধু কিয়ামতের দিনই দেখা হবে না, তা প্রতিদিনই রেকর্ড হচ্ছে। আমাদের কাজ হচ্ছে, সেই মহামূল্যবান কিতাবটি এমনভাবে সাজানো, যেন তা ইল্লিয়িন-এ উঠানো হয়।
জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই তাই আমাদের প্রশ্ন করা উচিত: “আমার আমল আজ কোন দিকে যাচ্ছে – ইল্লিয়িন, না সিজ্জিন?”
✦ হাদিসের আলোকে ইল্লিন ও সিজ্জিন
কুরআনের মতো হাদিসেও ইল্লিন ও সিজ্জিন পরকালীন আমলনামার স্থান হিসেবে বিশ্লেষিত হয়েছে। বিশেষ করে আত্মা মৃত্যুর পর কোথায় যায়, তা নিয়ে কিছু সহিহ হাদিসে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা এসেছে—যা আমাদেরকে এই দুটি অবস্থান আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করে।
১. জান্নাতি আত্মার ঊর্ধ্বগমন ও ইল্লিয়িন
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
“যখন কোনো মুমিন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে, তখন তার আত্মা জান্নাতের সুগন্ধি সহকারে তুলে আনা হয়। ফেরেশতাগণ একে আসমান থেকে আসমানে নিয়ে যেতে থাকে। প্রত্যেক আসমানে ফেরেশতাগণ জিজ্ঞেস করে, ‘এই উত্তম আত্মাটি কে?’ তারপর একে ইল্লিয়িন-এ নিয়ে যাওয়া হয়।” — (আবু দাউদ: 3231, সহিহ হিসেবে গ্রন্থিত)
🔹 উপকার্য: – এই হাদিসে দেখা যায়, আত্মার শেষ গন্তব্য ইল্লিয়িন শুধুই প্রতীকী নয়—বরং এটি ফেরেশতাদের দ্বারা সাক্ষ্যপ্রাপ্ত একটি ঊর্ধ্ব স্থান।
– সৎ ব্যক্তিদের আত্মা শুধু শান্তিতে থাকে না, বরং সর্বোচ্চ সম্মানপ্রাপ্ত স্থানেও পৌঁছায়।
২. কাফির ও পাপীদের আত্মা সিজ্জিনে
একই হাদিসের অন্য অংশে রাসূল ﷺ বলেছেন:
“যখন কোনো কাফির বা ফাসিক ব্যক্তি মারা যায়, তখন তার আত্মা অত্যন্ত দুর্গন্ধ নিয়ে বের হয়। ফেরেশতাগণ তা নিয়ে আসমানে উঠতে চেষ্টা করে, কিন্তু আসমানের দরজা তার জন্য খুলে না। তারপর তাকে নিচে ফেলে দেওয়া হয় এবং তার আত্মা সিজ্জিনে পাঠানো হয়।” — (মুসনাদে আহমাদ: 18534, সহিহ)
🔹 উপকার্য: – এই বর্ণনায় দেখা যায়, সিজ্জিন একটি বাস্তব জায়গা যেখানে অপবিত্র আত্মাগুলো আটকিয়ে রাখা হয়।
– এটি শুধু শাস্তির স্থান নয়, বরং পাপী আত্মার অপমান ও প্রত্যাখ্যানের প্রতীকও।
৩. আরও প্রাসঙ্গিক হাদিস
কুরআনে বলা হয়েছে:
كِتَابٌ مَّرْقُومٌ – يَشْهَدُهُ الْمُقَرَّبُونَ
“এটি একটি লিখিত কিতাব, যার সাক্ষী থাকেন নৈকট্যপ্রাপ্তরা।” — (মুতাফফিফীন 83:20–21)
হাদিসে এসেছে, ফেরেশতাগণ শুধু কিতাব লিখেন না, বরং জান্নাতি আত্মাকে ইল্লিয়িনে নিয়ে গিয়ে সাক্ষ্য দেন যে, এই আত্মাটি ছিল সৎকর্মশীল।
৪. আত্মার গন্তব্য এবং কিয়ামতের পূর্ববর্তী অবস্থা
রাসূল ﷺ বলেন:
“প্রত্যেক আত্মা তার নিজ নিজ কবরস্থানে বা অবস্থানে রিজ্জ করা হয়, এবং কিয়ামতের দিন সে সেই স্থান থেকেই উঠানো হবে।” — (আবু হায়সাম, সহিহ)
🔹 অর্থাৎ, ইল্লিয়িন ও সিজ্জিন কেবল একটি রেকর্ড রাখা নয়, বরং রুহ সেখানে “সংরক্ষিত” থাকে।
✦ একটু থেমে ভাবুন…
আমাদের আমলনামা কোথায় সংরক্ষিত হবে—ইল্লিয়িনে না সিজ্জিনে—এটি নির্ধারণ করবে আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপন। তাই নিজেকে প্রশ্ন করুন:
- 📖 আমি কী এমন জীবন যাপন করছি, যাতে আমার আমলনামা ইল্লিয়িনে স্থান পেতে পারে?
- 🕋 আমি কি নিয়মিতভাবে আমার নিয়ত ও কাজ বিশুদ্ধ রাখছি?
- 🤲 আমি কি গোপনে এমন কিছু করছি যা আমার আমলনামাকে সিজ্জিনে নিয়ে যেতে পারে?
- 💔 আমি কি তাওবা করে ফিরে আসছি, নাকি অবহেলায় ডুবে আছি?
🌿 আপনার হাতে এখনো সময় আছে…
এখনো আপনার কলম চলছে, এখনো আপনার কিতাব লেখা হচ্ছে। তাই পরিবর্তন আজই হোক।
“হে আল্লাহ! আমাদের আমলনামা ইল্লিয়িনে রাখুন এবং আমাদেরকে সিজ্জিন থেকে রক্ষা করুন।”
اللَّهُمَّ اجْعَلْ كِتَابَنَا فِي عِلِّيِّينَ وَنَجِّنَا مِنَ السِّجِّينِ
✦ আধুনিক জীবনের প্রেক্ষাপটে ইল্লিন ও সিজ্জিন
কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত ‘ইল্লিয়িন’ ও ‘সিজ্জিন’ কেবল মৃত্যুর পরের গন্তব্য নয়, বরং এই দুনিয়ার জীবনেও তার প্রতিফলন দেখা যায়। আল্লাহ আমাদেরকে ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, যাতে আমরা প্রতিদিনই বেছে নিতে পারি—উচ্চের দিকে যাব, না নিচে নামবো।
🔹 ইল্লিয়িনের পথে—উচ্চমার্গীয় আত্মা
যারা…
- সত্যের জন্য দাঁড়ায়
- গোপনে ও প্রকাশ্যে সৎ আমল করে
- অহংকার থেকে দূরে থাকে
- নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখে
তাদের আত্মা একধরনের আধ্যাত্মিক উচ্চতায় পৌঁছায়—শান্তি, তৃপ্তি, আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ। এটাই দুনিয়ায় ইল্লিয়িনের পূর্বস্বাদ।
🟢 উদাহরণ:
– যে কর্মচারী ঘুষ না নিয়ে হালাল উপার্জন বেছে নেয়
– যে ছাত্র পরীক্ষায় ফাঁকি না দিয়ে কষ্ট করে পড়ে
– যে মানুষ রাতের অন্ধকারে নামাজ পড়ে, কেউ না দেখলেও
এরা প্রত্যেকেই এই দুনিয়াতেই আত্মিক উঁচুতে উঠতে শুরু করে।
🔻 সিজ্জিনের দিকে পতন—আত্মার কারাগার
যারা…
- প্রতিনিয়ত পাপ করে কিন্তু তাওবা করে না
- অন্যকে ঠকিয়ে সুবিধা নেয়
- আল্লাহর বিধান নিয়ে উদাসীন থাকে
তারা শুধু আখিরাতে নয়, দুনিয়াতেও আত্মিকভাবে “নিচে পড়ে যায়”। তাদের ভেতরেই সৃষ্টি হয় অপরাধবোধ, অস্থিরতা, মানসিক চাপ। এটি দুনিয়ার সিজ্জিন—আত্মার অদৃশ্য কারাগার।
🔴 উদাহরণ:
– সুদ খাওয়ার পরও আত্মতুষ্ট থাকা
– গীবত ও মিথ্যাচারে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া
– পাপকে স্বাভাবিক ভেবে নির্লজ্জ জীবনযাপন করা
এগুলি একেকটি সিজ্জিনে পতনের সিঁড়ি।
🧭 আমাদের প্রতিদিনের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করছে—
আমরা ধীরে ধীরে ইল্লিয়িন-এর দিকে উঠছি, না সিজ্জিন-এর দিকে নামছি।