পবিত্রতা ইসলামের মৌলিক একটি ভিত্তি। ঈমানদার মুসলমানের জীবনের প্রতিটি কাজেই শুদ্ধতা ও পবিত্রতার আবেদন রয়েছে। এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ওজু—একটি ছোট্ট আমল, যার মাঝে লুকিয়ে আছে ইমানের গাঢ় ছায়া, জান্নাতের পথ এবং আত্মিক প্রশান্তির সন্ধান। ওজুর আদব ও ফজিলত সংক্রান্ত এই আলোচনায় আপনি এগুলো বিস্তারিত জানতে পারবেন।
ওজু কেবল নামাজের প্রস্তুতি নয়; বরং এটি এক ধরনের আত্মিক সাধনা। ওজুর মাধ্যমে আমরা শুধু শরীরের ময়লা ধুয়ে ফেলি না, বরং ধুয়ে ফেলি অন্তরের গুনাহ, দৃষ্টির পাপ, কানের অবাধ্যতা, পায়ের গোমরাহি এবং হাতের অন্যায় স্পর্শ। আর এই আত্মশুদ্ধি তখনই পরিপূর্ণ হয় যখন আমরা ওজুর আদব—আচরণ, নিয়ম ও রুচি—সম্মানের সাথে পালন করি।
কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা ওজুকে ঈমানের অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ ওজুর মাধ্যমেই তাঁর সাহাবিদের মাঝে আত্মশুদ্ধি ও আমলের গভীরতা গড়ার বীজ বপন করেছেন। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন—ওজু করেও জান্নাত অর্জন করা যায়।
হানাফি মাযহাবের দৃষ্টিতে
তারা একে “আদাব” নামে উল্লেখ করেছেন, যা “আদব” এর বহুবচন। এর অর্থ হলো— এমন কাজ যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক বা দুইবার করেছেন কিন্তু নিয়মিত করেননি।
হুকুম: এটি করলে সওয়াব পাওয়া যাবে, না করলে কোনো গোনাহ নেই। হানাফিদের মতে, ওজুর আদব মোট ১৪টি।
মালিকি মাযহাবের দৃষ্টিতে:
তারা একে “ফাযিলাহ” বা “সুন্নাত নয় এমন মুস্তাহাব কাজ” বলে থাকেন। এটি এমন আমল, যা শরীয়ত কঠোরভাবে ফরজ বা সুন্নাহ হিসেবে নির্ধারণ করেনি, তবে তা পালন করা উত্তম।
ফারাক:
- সুন্নাহ হচ্ছে এমন আমল, যা শরীয়ত জোর দিয়ে করতে বলেছেন।
- মুস্তাহাব বা আদব এমন আমল যা হালকাভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে।
ওজুর কিছু গুরুত্বপূর্ণ আদব
১. কিবলার দিকে মুখ করে ওজু করা: কারণ কিবলা শ্রেষ্ঠ দিক, এবং দোয়া কবুলের বেশি সম্ভাবনা থাকে। হানাবিলা ও শাফেয়িরাও একে সুন্নত বলেছেন।
২. উঁচু স্থানে বসে ওজু করা: যেন নোংরা পানি বা ছিটা শরীরে না লাগে। মালিকিরা বলেন— পরিষ্কার জায়গায় ওজু করা উত্তম, বাথরুম বা নাপাক স্থানে না করা মাকরূহ।
৩. অপ্রয়োজনে মানুষের কথা না বলা: কারণ এটা দোয়ার মনোযোগ নষ্ট করে।
৪. অপ্রয়োজনে অন্যের সাহায্য না নেওয়া: ব্যতিক্রম শুধু প্রয়োজনে (যেমন অসুস্থতা)। বেশি সাহায্য নেওয়া অহংকার ও অলসতার প্রকাশ। তবে হাদিসে রোগ বা সফরের সময় সাহায্যের অনুমতি আছে।
৫. ঢিলা আংটি নড়ানো: যেন পানির প্রবেশ নিশ্চিত হয়। টাইট আংটির ভেতর পানি না গেলে সেটিও নাড়ানো ফরজ।
৬. ডান হাতে কুলি ও নাকে পানি দেওয়া, এবং বাঁ হাতে নাক ঝাড়া: কারণ ডান হাত সম্মানজনক, আর বাঁ হাত নিকৃষ্ট কাজের জন্য।
৭. ওজু আগে করে রাখা: সময় হওয়ার আগেই ওজু করা উত্তম। তবে হানাফিদের মতে, যারা ওজু ধরে রাখতে পারেন না, তারা সময় হওয়ার পরই করবেন।
৮. কান পরিস্কারে ভেজা কনিষ্ঠ আঙুল ঢোকানো: পরিষ্কার করার অংশ হিসেবে।
৯. ঘাড়ের পিছনের অংশ মুছা: হানাফিরা এটাকে সুন্নাত বলেন, তবে অনেক আলেম এটাকে অপছন্দ করেন ‘গোলাবাড়ি’র আশঙ্কায়।
১০. গুররাহ ও তাহজীল বাড়ানো: মুখ, হাত ও পা এমনভাবে ধোয়া যাতে আলাদা করে উজ্জ্বলতা দেখা যায়। কিয়ামতের দিন উজ্জ্বলতা বাড়ানোর জন্য এ আমল প্রশংসনীয়।
১১. হাত মুছে ফেলা বা তোয়ালে দিয়ে শুকানো না করা: হানাফি ও হানাবিলা মতে, এটা না করাই উত্তম।
১২. জোরে পানি ঝাড়া বা ঝাঁক না দেওয়া: হাদিসে এটাকে ‘শয়তানের পাখা’ বলা হয়েছে।
১৩. অল্প পানি ব্যবহার করা: পানির অপচয় না করা উত্তম।
১৪. জলপাত্র ডান দিকে রাখা: যেন সহজে পানি নিতে পারেন।
১৫. ওজুর পর কালেমা ও দোয়া পড়া:যেমন:
أشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له وأشهد أن محمداً عبده ورسوله
🌿 ওজুর ১০টি ফজিলত – পবিত্রতার পথে জান্নাতের জানালা
ইসলামে ওজু শুধু শারীরিক পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম নয়; বরং এটি আত্মিক, আমলী এবং আখিরাতের কল্যাণ লাভের এক বিশেষ চাবিকাঠি। নিচে হাদীসের আলোকে ওজুর ১০টি গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত তুলে ধরা হলো:
১. ❝গুনাহ ঝরে পড়ে❞
রাসূল ﷺ বলেন:
“যখন বান্দা ওজু করে, তখন তার মুখ ধোয়ার মাধ্যমে চক্ষু দিয়ে করা গুনাহ ঝরে পড়ে… হাত ধোয়ার মাধ্যমে হাত দিয়ে করা গুনাহ ঝরে পড়ে… পা ধোয়ার মাধ্যমে পায়ে হেঁটে করা গুনাহও ঝরে পড়ে…” (সহীহ মুসলিম: ২৪৪)
২. ❝গুনাহ মাফের মাধ্যম❞
রাসূল ﷺ বলেন:
“যে ব্যক্তি ভালোভাবে ওজু করে, তারপর বলে: ‘আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ…’ – তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।” (মুসলিম: ২৩৪)
৩. ❝জান্নাতের আটটি দরজা খুলে যায়❞
“…ওজু শেষে এই দোয়া পড়লে, জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা, সে প্রবেশ করতে পারবে।” (মুসলিম: ২৩৪)
৪. ❝ওজু ইমানের অর্ধেক❞
রাসূল ﷺ বলেন:
“الطُّهُورُ شَطْرُ الإِيمَانِ”
“পবিত্রতা হলো ঈমানের অর্ধেক।” (সহীহ মুসলিম: ২২৩)
৫. ❝ওজু রাখা ঈমানের আলামত❞
“আমার উম্মতের কেউ ওজু ছাড়া ঘুমায় না – এটা ঈমানের নিদর্শন।” (ইবনু হিব্বান: সহীহ)
৬. ❝কেয়ামতের দিন মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হবে❞
“কেয়ামতের দিন আমার উম্মতদের পরিচয় হবে ওজুর কারণে: তাদের মুখ, হাত-পা ঝলমল করবে…” (বুখারী: ১৩৬, মুসলিম: ২৪৬)
৭. ❝নামাজ কবুলের পূর্বশর্ত❞
“নামাজ কবুল হয় না, যতক্ষণ না ওজু করা হয়।” (বুখারী: ৬৯৫৪)
৮. ❝ওজু অবস্থায় থাকা শহীদের মর্যাদা দেয়❞
“যে ব্যক্তি ওজু অবস্থায় ঘুমিয়ে মৃত্যু বরণ করে, সে শহীদের মর্যাদা পায়।” (আবু দাউদ: ৬০৪৮)
৯. ❝ওজু রাখা ফেরেশতার সঙ্গ পেতে সাহায্য করে❞
“ওজু অবস্থায় থাকলে ফেরেশতা তার জন্য দোয়া করতে থাকে।” (মুসনাদে আহমাদ)
১০. ❝ওজু রাখা শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচায়❞
“ওজু অবস্থায় থাকা ব্যক্তি শয়তানের ধোঁকায় সহজে পড়ে না।” (মুস্তাদরাক হাকিম)
🔹 শেষ কথা
ওজু কেবল নামাজের জন্য নয়—বরং পুরো জীবনের একটি আত্মিক প্রস্তুতি। যিনি ওজুকে ভালোবাসেন, তিনি পবিত্রতাকে ভালোবাসেন। আর পবিত্রতা আল্লাহ তায়ালার প্রিয় একটি গুণ।
“إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ”
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।” – (সূরা বাকারা: ২২২)