শুধু অঙ্গ ধোয়ার মাধ্যমে ওজু সহিহ হয় না—বরং শারঈভাবে ওজুর জন্য নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়, যেগুলোর মধ্যে কিছু রয়েছে ওজু ফরজ হওয়ার জন্য এবং কিছু রয়েছে ওজু সহিহ হওয়ার জন্য।
এই শর্তগুলো জানা ও মানা অত্যন্ত জরুরি, কারণ যদি কোনো শর্ত পূর্ণ না হয়, তাহলে ব্যক্তির ওজু বাতিল বলে গণ্য হবে, ফলে তার সালাতও সহিহ হবে না। ফলে, একজন মুসলমানের জন্য ওজুর শর্তসমূহ জানা যেমন আবশ্যক, তেমনি তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করাও অপরিহার্য।
এই অধ্যায়ে আমরা দুই প্রকার শর্ত—ওজু ফরজ হওয়ার শর্ত এবং ওজু সহিহ হওয়ার শর্ত—বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব, যাতে একজন মুকাল্লাফ (শরীয়তের দায়বদ্ধ ব্যক্তি) সঠিকভাবে ইবাদতের পূর্বশর্ত পূরণ করতে সক্ষম হন।
তৃতীয় অনুচ্ছেদ – ওজুর শর্তসমূহ
ওজু ফরজ হওয়ার কারণ
ওজু ফরজ হওয়ার কারণ হল—অশুদ্ধ অবস্থা (হাদস), সালাতের সময় প্রবেশ, সালাত আদায়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ ইত্যাদি। শাফেয়ী মাযহাবের সঠিক অভিমত অনুযায়ী—এই দুটো একত্রে, অর্থাৎ ‘অশুদ্ধ অবস্থা’ এবং ‘সালাতের জন্য প্রস্তুতি’—উভয়ই ওজুকে ফরজ করে।
ওজুর শর্ত দুই ধরনের
১. ওজু ফরজ হওয়ার শর্ত (শর্তে ওজুব)
২. ওজু সহিহ হওয়ার শর্ত (শর্তে সহিহা)
প্রথমত: ওজু ফরজ হওয়ার শর্ত
ওজু একজন ব্যক্তির উপর ফরজ হওয়ার জন্য মোট আটটি শর্ত রয়েছে, যা নিম্নরূপ:
১. আক্ল (বুদ্ধি): পাগলের উপর ওজু ফরজ নয় এবং তার ওজু সহিহ নয়। মৃগীরোগ আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও একই কথা। ঘুমন্ত বা গাফিল (অবচেতন) ব্যক্তির ওজুও সহিহ নয়, কারণ তারা নিয়ত করতে পারে না। (জমহূর মাযহাব—হানাফি ছাড়া—এ মত দেন।)
২. বালেগ হওয়া: শিশুদের উপর ওজু ফরজ নয়। তবে ‘তামীয’ (সঠিক-ভুল বোঝার যোগ্যতা) থাকলে ওজু সহিহ হয়। সুতরাং, তামীয করা শর্ত।
৩. ইসলাম গ্রহণ: হানাফিদের মতে এটি ওজু ফরজ হওয়ার শর্ত, কারণ তাদের মতে কুফর অবস্থায় কেউ শরিয়তের শাখাগুলোর দ্বারা গৃহীত হয় না।
অপরদিকে, অন্যান্য মাযহাবের মতে ইসলাম হল ওজু সহিহ হওয়ার শর্ত, অর্থাৎ কাফের ব্যক্তির ওজু সহিহ হয় না, কারণ তাকে ইসলাম গ্রহণ করতে হবে যেন তার ইবাদত সহিহ হয়।
৪. পর্যাপ্ত ও বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের ক্ষমতা: যার পানি নেই বা আছে কিন্তু তা যথেষ্ট নয়, বা পানি ব্যবহারে ক্ষতি হয়, তার উপর ওজু ফরজ নয়।
তবে শাফেয়ী ও হাম্বলি মতে, যদি কিছু পানি থাকে, তাহলে তা ব্যবহারের পর তায়াম্মুম করতে হবে।
৫. অশুদ্ধতার অস্তিত্ব: যেহেতু অশুদ্ধতা (হাদস) ওজুর কারণ, তাই যে ব্যক্তি ওজু অবস্থায় আছে, তার পুনরায় ওজু করা জরুরি নয়।
৬. ও ৭. হায়েয ও নিফাসমুক্ত হওয়া: হায়েয বা নিফাসে থাকা অবস্থায় ওজু ফরজ হয় না।
৮. সালাতের সময় সংকীর্ণ হওয়া: অর্থাৎ যখন সালাতের সময় অল্প বাকি থাকে তখন ওজু ফরজ হয়। সময় বিস্তৃত থাকলে ফরজ হয় না।
সংক্ষেপে: এই সব শর্তগুলোকে একত্রে বলা যায়—যখন কোনো মুকাল্লাফ ব্যক্তি বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার ও ব্যবহারের ক্ষমতা রাখে, তখন তার উপর ওজু ফরজ হয়।
দ্বিতীয়ত: ওজু সহিহ হওয়ার শর্ত
হানাফিদের মতে তিনটি, এবং জমহূরের মতে চারটি শর্ত রয়েছে:
১. অঙ্গসমূহে বিশুদ্ধ পানি পৌঁছানো: যে অঙ্গগুলো ধোয়া ফরজ, তাতে পানি পৌঁছানো আবশ্যক। এক বিন্দুও যদি শুকনা থাকে (যেমন সূচ ফোটানোর পরিমাণ), তাহলে ওজু সহিহ নয়।
👉 ফলে, আঙুলে টাইট আংটি থাকলে তা নাড়াতে হবে যেন নিচে পানি পৌঁছায়।
👉 মালেকিরা বলেন, অনুমোদিত আংটি হলে নাড়ানো জরুরি নয়, এমনকি পানি না পৌঁছালেও।
❌ ভিনধরনের তরল (যেমন: ভিনেগার, দুধ, রস ইত্যাদি) দিয়ে ওজু সহিহ নয়।
❌ অপবিত্র পানি দিয়েও ওজু হয় না।
২. পানির পথে বাধা না থাকা: যেমন—মোম, গাঢ় চর্বি, কসমেটিকস, ঘন কালির স্তর, নেইল পালিশ ইত্যাদি।
তবে পাতলা তেল বা লোশন থাকলে ওজু সহিহ হয়, কারণ তা পানি থামায় না।
৩. অশুদ্ধতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকা: অর্থাৎ ওজু করার সময় কোনো হাদস (যেমন প্রস্রাব, ঋতুস্রাব ইত্যাদি) চলতে থাকলে বা ওজু শুরু হওয়ার পর মাঝখানে তা হলে ওজু সহিহ হবে না (যদি ব্যক্তি ‘মা’যূর’ না হয়)।
৪. দায়েমুল হাদস (যার অশুদ্ধতা স্থায়ী)—তার ক্ষেত্রে সময়ের প্রবেশ: অর্থাৎ সালাতের সময় প্রবেশ ছাড়া তাদের তায়াম্মুম সহিহ নয়। এ বিধান হানাফিদের বাদে অন্যদের (যেমন শাফেয়ী, হাম্বলি) মতে।
ওজুর শর্তসমূহ বিষয়ক ৫টি মৌলিক প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন ১: ওজু ফরজ হওয়ার প্রধান কারণ কী কী?
উত্তর: ওজু ফরজ হয় মূলত দুইটি কারণে:
১. পবিত্রতা নষ্ট হওয়া (যেমন: পেশাব-পায়খানা ইত্যাদি)
২. সালাত বা এরূপ ইবাদতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।
প্রশ্ন ২: ওজু ফরজ হওয়ার শর্ত কয়টি এবং কী কী?
উত্তর: ওজু ফরজ হওয়ার শর্ত ৮টি, যেমন:
১. عقل (বুদ্ধি থাকা)
২. بلوغ (বালেগ হওয়া)
৩. ইসলাম গ্রহণ
৪. পানি ব্যবহারে সক্ষমতা
৫. নাপাক হওয়া
৬. হায়েজ/নেফাস থেকে মুক্ত থাকা
৭. সময়ের সংকীর্ণতা
৮. তমিজ বা বুঝদার হওয়া (অন্তর্ভুক্ত হিসাবে ধরা হয়)
প্রশ্ন ৩: ওজু সহিহ হওয়ার শর্ত কয়টি?
উত্তর: ওজু সহিহ হওয়ার জন্য হanafি মাযহাবে তিনটি এবং অন্যান্য মাযহাবে চারটি মূল শর্ত রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
১. বিশুদ্ধ পানি দিয়ে অঙ্গ ধোয়া
২. পানির পৌঁছাতে বাধা না থাকা
৩. ওজুর সময় কোনো নাপাকি বের না হওয়া
৪. (হানাফি ছাড়া অন্যদের মতে) সময়ের মধ্যে হওয়া (যদি ওজু তায়াম্মুমের বিকল্প হয় বা স্থায়ী নাপাকি থাকে)
প্রশ্ন ৪: একজন অমুসলিম যদি ওজু করে, তাহলে তা সহিহ হবে কি?
উত্তর: না, সহিহ হবে না। ইসলাম গ্রহণ ছাড়া কোনো ইবাদত, ওজু সহ, সহিহ হয় না।
প্রশ্ন ৫: নারীদের নখে নেইল পলিশ থাকলে ওজু সহিহ হবে কি?
উত্তর: না, নেইল পলিশ পানি পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি করলে ওজু সহিহ হবে না। কারণ, এটি শরীরের যে অংশ ধোয়া ফরজ, সেখানে পানি পৌঁছানো বাধ্যতামূলক।