নামাজের পূর্বশর্ত ওযু—এটি শুধু শারীরিক পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমই নয়, বরং এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতও বটে। অনেকেই দৈনন্দিন জীবনে ওযু করলেও এর সঠিক নিয়ম, ফরজ, সুন্নত ও আদব সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন নন। অথচ রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের জন্য ওযুর এমন একটি সুন্দর ও পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতি রেখে গেছেন, যা অনুসরণ করলে শুধু শারীরিক পবিত্রতা নয়, বরং আত্মিক প্রশান্তি ও অনেক সওয়াবও অর্জন করা যায়। এখানে আমার আলোচনা করছি – ওযু করার নিয়ম।
এই লেখায় থাকবে:
- ৪টি ফরজ (যা না হলে ওযু হবে না),
- ১৭টি সুন্নত (যা করলে ওযু পূর্ণতা পায়),
- এবং ১৫টি আদব (যা ওযুকে আরো সৌন্দর্যময় করে তোলে)
—এসব বিষয় স্টেপ বাই স্টেপভাবে তুলে ধরব। যাতে করে ওযু করা শুধু অভ্যাস না হয়ে ওঠে, বরং হয়ে উঠুক এক পূর্ণাঙ্গ ইবাদত।
ওযু – অর্থাৎ পবিত্রতা অর্জনের একটি মহান ইবাদত। এটি শুধু নামাজের পূর্বশর্ত নয়, বরং এটি একটি ইমানী পরিচ্ছন্নতা। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“পরিচ্ছন্নতা হল অর্ধ ঈমান।” (সহীহ মুসলিম ২২৩)
আসুন জেনে নিই কীভাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ- এর সুন্নতের আলোকে একে একে ওযু সম্পন্ন করতে হয়।
ধাপে ধাপে ওযু করার নিয়ম
✅ ধাপ ১: ওযুর পূর্বে নিয়ত করা ও বিসমিল্লাহ বলা
- নিয়ত (সুন্নত): অন্তরে স্থির সংকল্প—“আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমি ওযু করছি”
- বিসমিল্লাহ (সুন্নত): মুখে বলা: بِسْمِ اللَّهِ
(বিসমিল্লাহ)
📌 কেউ বিসমিল্লাহ ভুলে গেলে ওযু শুদ্ধ হবে, তবে ফজিলত কমে যাবে।
✅ ধাপ ২: দুই হাত কব্জি পর্যন্ত ধোয়া (সুন্নত)
- ডান হাত → বাম হাত
- ৩ বার করে ধোয়া উত্তম
📌 হাত ধোয়া দিয়ে শুরু করাটা রাসূলের নিয়ম। এতে হাত পরিচ্ছন্ন হয়।
✅ ধাপ ৩: মিসওয়াক ব্যবহার করা (সুন্নত)
- ডান হাতে দাঁতের গোড়ায় মিসওয়াক
- না থাকলে আঙ্গুলেও করা যায়
📌 এটি মুখের দুর্গন্ধ দূর করে, নামাজে খুশু বাড়ায়।
✅ ধাপ ৪: কুলি করা (সুন্নত)
- ডান হাত দিয়ে পানি নিয়ে কুলকুচি
- ৩ বার
📌 সুন্নত: ভালোভাবে কুলি করা, দাঁতের ফাঁকে পানি পৌঁছানো।
✅ ধাপ ৫: নাকে পানি দেওয়া ও ঝাড়া (সুন্নত)
- ডান হাতে পানি টেনে নাকে নেওয়া
- বাম হাতে নাক ঝাড়া
📌 এটি মুখমণ্ডলের অঙ্গগুলোর পবিত্রতা বাড়ায়।
✅ ধাপ ৬: মুখ ধোয়া (১ম ফরজ)
- কপালের চুলের গোড়া থেকে চিবুক পর্যন্ত
- কান থেকে কান পর্যন্ত
📌 ফরজ: মুখ ধোয়া
📌 সুন্নত: ৩ বার ধোয়া
✅ ধাপ ৭: হাত ধোয়া কনুইসহ (২য় ফরজ)
- ডান হাত → বাম হাত
- আঙ্গুল থেকে কনুই পর্যন্ত
- ৩ বার
📌 ফরজ: কনুইসহ ধোয়া
📌 সুন্নত: আঙ্গুল থেকে শুরু করা
✅ ধাপ ৮: মাথা মাসেহ করা (৩য় ফরজ)
- উভয় হাত ভিজিয়ে সামনের দিক থেকে পেছনে, আবার সামনের দিকে ফেরত
- একবার
📌 ফরজ: মাথার একভাগ মাসেহ
📌 সুন্নত: পুরো মাথা মাসেহ
📌 সাথে: দুই কানের ভিতর ও বাইরের মাসেহ
✅ ধাপ ৯: পা ধোয়া গোড়ালি পর্যন্ত (৪র্থ ফরজ)
- ডান পা → বাম পা
- আঙুলের ফাঁক ভালোভাবে ধুতে হবে
- গোড়ালি পর্যন্ত ৩ বার ধোয়া
📌 ফরজ: গোড়ালিসহ ধোয়া
📌 সুন্নত: আঙুলের ফাঁক পরিষ্কার করা

🕌 অতিরিক্ত সুন্নত ও আদব
আমল | ধরন | ব্যাখ্যা |
---|---|---|
মুখে নিয়ত ও বিসমিল্লাহ | সুন্নত | ইখলাস ও বরকতের জন্য |
অজুর সব অঙ্গ ৩ বার ধোয়া | সুন্নত | রাসূলের নিয়ম |
অজুর শেষে দোআ | সুন্নত | “اللهم اجعلني من التوابين…” |
কিবলার দিকে মুখ করে ওযু | আদব | আদব ও সম্মানজনক |
কারও সাহায্য না নেওয়া | আদব | স্বাবলম্বী হওয়া |
ওযুর পর দুই রাকাত সালাত | নফল | গুনাহ মাফ হয় (সহীহ বুখারী/মুসলিম) |
🌟 ওযুর ফজিলত (হাদীস থেকে)
- “যে ওযু করে সুন্দরভাবে ও খুশু সহকারে দুই রাকাত পড়ে, তার পূর্ববর্তী গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়”
(সহীহ বুখারী) - “কেয়ামতের দিন ওযুকারীর অঙ্গসমূহ নূরে উদ্ভাসিত থাকবে” (সহীহ মুসলিম ২৪৬)
✅ সংক্ষিপ্ত চেকলিস্ট (ওযু করার নিয়ম)
☑ নিয়ত ও বিসমিল্লাহ
☑ দুই হাত ধোওয়া
☑ কুলি
☑ নাকে পানি
☑ মুখ ধোওয়া
☑ হাত কনুইসহ
☑ মাথা মাসেহ
☑ কান মাসেহ
☑ পা গোড়ালি পর্যন্ত
☑ দোআ ও দুই রাকাত সালাত
ওযুর সময় সাধারণ ভুল – যা আমাদের এড়িয়ে চলা উচিত
ওযু একটি ইবাদত, যা নামাজের পূর্বশর্ত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অনেকেই ওযুর সময় কিছু সাধারণ ভুল করেন, যার কারণে ওযু অসম্পূর্ণ থেকে যায় বা তার ফজিলত থেকে বঞ্চিত হতে হয়। নিচে এমন কিছু প্রচলিত ভুল তুলে ধরা হলো, যেন আমরা সচেতন হতে পারি:
১. বিনা নিয়তে ওযু শুরু করা
অনেকেই মুখে কিছু না বললেও অন্তরে নিয়ত করে না। অথচ নিয়ত ছাড়া ইবাদত কবুল হয় না।
📌 ইবাদতের শুরুতে নিয়ত হৃদয়ের কাজ। এটা সুন্নত হলেও মূল ভিত্তি।
২. বিসমিল্লাহ না বলা
ওযুর শুরুতে “বিসমিল্লাহ” বলা সুন্নত। অনেকেই তা বাদ দেন।
📌 রাসূল ﷺ বলেন: “যে ব্যক্তি ওযুর সময় বিসমিল্লাহ বলে না, তার ওযুতে বরকত থাকে না।” (আবু দাউদ ১০১)
৩. অঙ্গগুলো ঠিকমতো ধোয়া না
- মুখ ধোয়ার সময় চিবুক ও কান বরাবর না ধোয়া
- হাত ধোয়ার সময় কনুই পর্যন্ত না যাওয়া
- পা ধোয়ার সময় গোড়ালি শুকনো রেখে ফেলা
📌 কিয়ামতের দিনে এমন লোকের জন্য আফসোস করা হবে যাদের অঙ্গগুলো পূর্ণভাবে ধোয়া হয়নি।
৪. আঙুলের ফাঁকে পানি না পৌঁছানো
হাত বা পায়ের আঙুলের ফাঁকে পানি না গেলে ওযু অসম্পূর্ণ থাকে। এটি রাসূল ﷺ নিজ হাতে করে দেখিয়েছেন।
৫. ওযুর ফরজ ও সুন্নতের পার্থক্য না জানা
অনেকে মনে করেন সব ধাপ সমান গুরুত্বপূর্ণ, আবার কেউ সুন্নতকেও বাদ দিয়ে দেন। ফলে গাফলতি হয়।
📌 ফরজ বাদ পড়লে ওযুই হবে না। সুন্নত বাদ পড়লে সওয়াব কমে যাবে।
৬. ওযুর মাঝে লম্বা বিরতি দেওয়া
এক অঙ্গ ধুয়ে অন্য অঙ্গ ধোয়ার মাঝে অনেক সময় নেওয়া হলে “তরতি” (ধারাবাহিকতা) নষ্ট হয়। এটি সুন্নতের বিরোধী।
৭. কারও সাহায্যে ওযু করা
যদি শরীরিক অসুবিধা না থাকে, তবুও অন্যের সাহায্যে ওযু করা আদববিরুদ্ধ।
৮. ওযুর সময় হাসাহাসি বা দুনিয়াবি কথা বলা
ওযু একটি ইবাদত। এতে একাগ্রতা ও সংযম থাকা উচিত। অথচ অনেকে গল্পগুজবে লিপ্ত হন।
৯. ওযুর পর সুন্নত দোআ না পড়া
রাসূল ﷺ ওযুর পর বলতেন:
اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِنَ التَّوَّابِينَ، وَاجْعَلْنِي مِنَ الْمُتَطَهِّرِينَ
(হে আল্লাহ! আমাকে তওবাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করো এবং পবিত্রতাপ্রিয়দের অন্তর্ভুক্ত করো)
১০. ওযুর পর সালাতুল ওযু না পড়া
রাসূল ﷺ বলেছেন:
“যে ব্যক্তি আমার মতো করে ওযু করে এবং তারপর দুই রাকাত সালাত পড়ে, তার পূর্ববর্তী গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
১. সুন্নত ও আদব মেনে ওযু করা
✦ বৈশিষ্ট্য
- নিয়তের সঙ্গে শুরু হয়
- “বিসমিল্লাহ” বলা হয়
- সওয়াক বা মিসওয়াক করা হয়
- প্রতিটি অঙ্গ তিনবার করে ধোয়া হয়
- আঙুল ও দাড়ির ফাঁকে পানি পৌঁছায়
- ডান দিক থেকে শুরু হয়
- মাথা সম্পূর্ণ মাসহ করা হয়
- কান মাসহ করা হয়
- ধারাবাহিকভাবে অঙ্গগুলো ধোয়া হয়
- ওযুর পর দোআ ও দুই রাকাত নামাজ আদায় করা হয়
✅ ফলাফল:
- ওযু সহিহ হয়
- সওয়াব বৃদ্ধি পায়
- রাসূল ﷺ এর সুন্নতের অনুসরণ হয়
- অন্তরের প্রশান্তি ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়
🟥 ২. সুন্নত ও আদব লঙ্ঘন করে ওযু করা
✦ বৈশিষ্ট্য:
- কোনো নিয়ত করে না, শুধু পানিতে হাত দেয়
- “বিসমিল্লাহ” বলে না
- সওয়াক বা মিসওয়াক করে না
- একবার করে অঙ্গ ধোয়, বা তাড়াহুড়া করে
- আঙুল, দাড়ি বা কনুই ঠিকমতো ধোয় না
- বাম দিক থেকে শুরু হয়
- মাথার সামান্য অংশ মাসহ করে
- কান মাসহ করে না
- মাঝে বিরতি দিয়ে ধোয়া হয়
- দোয়া পড়তে ভুল হওয়া।
⚠️ ফলাফল:
- ফরজগুলো ঠিক থাকলে ওযু সহিহ হয়, তবে—
- সওয়াব অনেক কমে যায়
- সুন্নত থেকে বঞ্চিত হয়
- ইবাদতের রুহ (আত্মা) হারায়
- রাসূল ﷺ এর সুন্নত থেকে দূরে থাকে
📌 এক নজরে পার্থক্য:
দিক | সুন্নত ও আদব মেনে | সুন্নত ও আদব লঙ্ঘন করে |
---|---|---|
নিয়ত ও বিসমিল্লাহ | ✔️ | ❌ |
অঙ্গ ধোয়ার নিয়ম | সুন্দরভাবে তিনবার | অবহেলা ও তাড়াহুড়ায় |
সুন্নত অনুসরণ | ✔️ | ❌ |
দোআ ও নামাজ | আদায় করে | করে না বা ভুলে যায় |
সওয়াব | পূর্ণ সওয়াব | কম সওয়াব |
রুহানিয়াত | বৃদ্ধি পায় | অনুপস্থিত থাকে |
উপসংহার
ওযু একটি ছোট আমল হলেও এর প্রভাব অনেক বড়। একটি ভুল ওযুকে বাতিল করে দিতে পারে, আবার একটি সুন্নত অনুসরণে বান্দা আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারে। তাই আসুন, ওযুর সময় এসব ভুল থেকে নিজে সতর্ক হই, অন্যকেও সচেতন করি।