চিংড়ি খাওয়া কি হালাল? হানাফি মাযহাব ও কুরআন সুন্নাহ যা বলে

পোস্টটি শেয়ার করুন

আমার এক ধর্মীয় ভাই ফেসবুকে চিংড়ি আমাকে প্রশ্ন করেছিলো। তার সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমি স্টাডি করে বেশ কিছু রেফারেন্স ও তথ্য সংগ্রহ করি। সব মিলিয়ে আমি একটি আর্টিকেল তৈরি করি। অতপর আমি দেখলাম গুগলে অনেক মানুষ এই একই প্রশ্ন – চিংড়ি খাওয়া কি হালাল?  লিখে সার্চ করছে। 

তাই সকল শ্রেণীর মানুষ যাতে তাদের কাঙ্ক্ষণীয় প্রশ্নটির উত্তর জানতে পারে সে জন্য আমি আমার ওয়েব সাইটে পোস্টটি পাবলিশ করে দিচ্ছি। আশা করি এটি পড়ার পর কেউ আর ইসলামে চিংড়ি হালাল না কি হারাম এ নিয়ে সংশয়ে থাকবেন না। 

চিংড়ি কি? এটি মাছের অন্তর্ভুক্ত?

প্রথমে আমরা চিংড়ির পরিচয় জেনে নেওয়া দরকার। কেননা কোনো কিছু সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন করতে হলে তার পরিচয় ও মূল উৎস সম্পর্কে জানাটা জরুরী। চিংড়ি একটি জলজ বা সামুদ্রিক প্রাণী। চিংড়ি যে পানিতে বসবাস করে বা বেড়ে ওঠে সেই পানির পরিমান ও স্থানভেদে চিংড়ি বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। যেমন,

  • টাইগার চিংড়ি,
  • রক চিংড়ি,
  • মিঠা পানির চিংড়ি,
  • বাম্বেল চিংড়ি ইত্যাদি।
  • আমাদের দেশে পুকুর ও খাল বিলে এক প্রকার চিংড়ি পাওয়া যায়। যা এসা নামে পরিচিত।

চিংড়ি কি মাছের অন্তর্ভুক্ত? এটি নিয়ে ইসলামিক স্কলারগণ, প্রাচীন অভিধানবিদ ও প্রাণিবিদগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। সে জন্য হানাফী মাযহাবে চিংড়ি নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। আমি প্রত্যেকটি বিষয় নিয়েই আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। কেউ কেউ চিংটিকে মাছ বলেছেন। আবার অনেকে এটিকে একটি সামুদ্রিক প্রাণী নামে অবহিত করেছেন।

  • প্রখ্যাত আরবী অভিধান ‘আল ক্বামূস’ এ চিংড়ি সম্পর্কে বলা হয়েছে- চিংড়ি পোকার মত দেখতে এক প্রকার মাছ।
  • সিহাহ’ ও তাজুল আরূস গ্রন্থদ্বয়ে বলা হয়েছে – চিংড়ি সাদা রঙের মাছ। যা পোকা সদৃশ এবং বসরাতে পাওয়া যায়।
  • হায়াতুল হায়ওয়ানাত নামক গ্রন্থে বলা আছে- চিংড়ি অনেক ছোট লাল রঙের মাছ।
  • ফতোয়া রবযিয়ায় উল্লেখ আছে – অভিধান ও চিকিৎসাশাস্ত্রের কিতাব, প্রাণিবিদ্যার কিতাব থেকে স্পষ্ট যে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে চিংড়ি হল মাছ। 

তবে অনকে চিংড়িকে মাছ নয় বলে মত দিয়েছেন। তাদের যুক্তি হলো – মাছের মেরুদণ্ড থাকে কিন্তু চিংড়ির মেরুদণ্ড নেই। তাই সেটি মাছ নয়। 

চিংড়ি খাওয়া হালাল । মাযহাব ও অভিমত

হ্যা চিংড়ি খাওয়া হালাল। এটিই সংখ্যাগরিষ্ট ফকিহগণের অভিমত। তাদের মধ্যে রয়েছেন মালিকি, শাফিয়ি ও হাম্বলি মাযহাবের উলামায়ে কেরাম। তারা বলেন সমুদ্রের সকল প্রাণীই খাওয়া হালাল। তবে অল্প কয়েকটি প্রাণী যেমন ব্যাঙ্গ শুকর ইত্যাদি খাওয়া হালাল নয়। 

একইভাবে হানিফি মাযহাবের অনেক গবেষক চিংড়িকে হালাল বলে মত দিয়েছেন। বিশেষভাবে ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশে চিংড়ি খাওয়ার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। আর এই দুই দেশের মুসলিমদের অধিকাংশই হানাফি মাযহাব অনুসরণ করে থাকেন। কিন্তু হানাফিদের মধ্যে অনেকে এটিকে খাওয়া বৈধ নয় বলেছেন। পরে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করছি। 

চিংড়ি খাওয়া হালাল রয়েছে।

চিংড়ি হালাল হওয়ার রেফারেন্স

সাধারণভাবে যে জিনিসকে হারাম ঘোষণা করা হয়নি সেটাই হালাল বলে গণ্য হয়। আর কুরআন বা হাদিসে কোথায়ও সরাসরি চিংড়িকে হারাম করা হয়নি। তাই চিংড়ি হালাল। তদুপরি তারা কুরআন ও হাদিসে থেকে কিছু রেফারেন্স উপস্থাপন করেন। যা তাদের অভিমতকে প্রমাণিত করার পক্ষে যথেষ্ট শক্তিশালী। নিচে সেগুলো তুলে ধরছি।

পবিত্র আল্লাহ তায়ালা বলেছেন –

‘তিনি তোমাদের জন্য সর্বপ্রকার সামুদ্রিক শিকার ও সামুদ্রিক খাদ্য হালাল করেছেন। (সুরা মায়িদা – ৯৬)

এই আয়াতের নির্দেশনায় ব্যাপকতা রয়েছে। যা সমুদ্রে বিচরণকারী প্রাণীকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর চিংড়িও সমুদ্রে বিচরণকারী একটি প্রাণী।

রাসুলুল্লাহ – সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – বলেছেন,

‘সমুদ্রের পানি পাক ও তার মৃত প্রাণী হালাল।’ (মুসনাদে আহমদ)  

এই হাদিসে সমুদ্র থেকে মৃত অবস্থায় আহরিত প্রাণীকে হালাল ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু কোন প্রকার প্রাণী সেটা নির্দিষ্ট করা হয়নি। এই হাদিসটি থেকে আমরা জানতে পারছি সর্বপ্রকার সামুদ্রিক প্রাণী কেবল হালালই নয় বরং এগুলো মৃত অবস্থায় খাওয়া বৈধ।। 

আর এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, যেই প্রাণী মৃত অবস্থায় হালাল সেটা জীবিত অবস্থা আরো উত্তমভাবে হালাল হবে। সুতরাং  চিংড়ি যেহেতু একটি সামুদ্রিক প্রাণী। তাই অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর মতো চিংড়ি খাওয়াও বৈধ হবে। 

হানাফি মাযহাবে চিংড়ি কি হালাল? 

হানাফি মাযহাবে অধিকাংশ ফক্বীহ সাধারণভাবে চিংড়ি হালাল নয় বলে মত দিয়েছেন। তবে তারা সরাসরি হারামও বলেন নি। তারা চিংড়িকে মাকরুহ বলেছেন। আর মাকরুহ মানে হলো – এমন কিছু যা শরিয়ত পছন্দ করে না। তারা এটা খেতে নিরুৎসাহিত করেছেন।

এটা হানাফি মাযহাবের পূর্বসূরি আলেমদের অবস্থান। যেমন ইমাম ফক্বীহ শাহ আহমদ রেযা  ফতোয়ায়ে রযভিয়া- গ্রন্থে চিংড়ির নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর উল্লেখ করার পর বলেন,

আলহামদুদিল্লাহ, এই ফকীর (আহমদ রেযা) এবং তাঁর পরিবার জীবনে কোনদিন চিংড়ি খায় নি এবং কখনো খাবে না।

আধুনিক প্রাণী বিজ্ঞানে চিংড়ি

আধুনিক প্রাণিবিজ্ঞান ও প্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে  চিংড়ি মাছ নয়। বরং সেটা এক ধরণের সামুদ্রিক পোকা। 

প্রাণিজগতের শ্রেণিবিন্যাসে চিংড়ি ‘আর্থরোপোডা’ পর্বের প্রাণি। চিংড়িকে মাছ গণ্য না করার করণগুলো নিম্নরূপ – 

  • চিংড়ি আর্থ্রোপোডা পর্বের ম্যালাকোস্ট্রাকা ক্লাসের অমেরুদণ্ডী প্রানী। অন্যদিকে মাছ হলো কর্ডাটা শ্রেণীর অস্টিকথিস শ্রেনিভুক্ত। 
  • মাছের শরীরে সাইক্লোয়েড, গ্যানয়েড বা টিনয়েড ধরণের আঁইশ দ্বারা আবৃত থাকে কিন্তু চিংড়ি শরীরে এমনটা দেখা যায় না।
  • মাছের মাথার দুপাশে চারজোড়া ফুলকা থাকে; যা কানকো দিয়ে ঢাকা থাকে। কিন্তু চিংড়ির কোন প্রকার ফুলকা নেই। 

উপরোক্ত কারণগুলোসহ মাছের অন্যান্য সকল বৈশিষ্ট্য চিংড়ির সাথে অমিল হওয়ার কারনে চিংড়িকে মাছ বলা হয় না। 

তাছাড়া এটি রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমান বাড়িয়ে দেয়। যা শরীরের জন্য বেশ ক্ষতিকর। আর ক্ষতিকর সকল জিনিসই হারাম।

ইসলামে চিংড়ির বিধান ও একটি পর্যালোচনা

আমরা দুটি অভিমত আলোচনা করে এসেছি। তার মধ্যে একটি হালাল ও অপরটি মাকরুহ। কিন্তু যারা চিংড়িকে মাকরুহ বলেছেন তারা চিংড়ি মাছের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় এমনটি বলেছেন।

এখন প্রশ্ন বাকী থাকে যে সামুদ্রিক প্রাণীদের মধ্যে থেকে মাছ ব্যতীত অন্য প্রাণী খাওয়া যাবে না এই কথাটি সর্বসম্মত নয়। 

মাছ ব্যতীত অন্য অনেক সামুদ্রিক প্রাণী রয়েছে যেগুলো খাওয়া বৈধ। যেমন অক্টোপাস, কাঁকড়া ইত্যাদি। 

সেই সাথে এর পক্ষে শক্তিশালী দলিল রয়েছে। তাই আমরা বলতে পারি চিংড়ি খেতে অসুবিধা নেই। ইসলামে চিংড়ি হালাল। 

উপসংহার

চিংড়ি খাওয়া সম্পর্কে দুইটি মতামত রয়েছে:

  • মালিকি, শাফিয়ি ও হাম্বলি মাযহাবে চিংড়ি স্পষ্টভাবে হালাল।
  • হানাফি মাযহাবে কিছু স্কলার এটিকে মাকরুহ বলেছেন, তবে হারাম নয়।

সুতরাং, যেহেতু চিংড়ির হারাম হওয়ার বিষয়ে কোনো স্পষ্ট দলিল নেই এবং এটি অধিকাংশ ইসলামী স্কলারের মতে হালাল, তাই চিংড়ি খাওয়া বৈধ বলা যায়।

কিছু প্রশ্ন ও উত্তর

১. চিংড়ি কি ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্পষ্টভাবে হালাল?

হ্যাঁ, অধিকাংশ ইসলামী মাযহাব (মালিকি, শাফিয়ি, হাম্বলি) অনুসারে চিংড়ি স্পষ্টভাবে হালাল। তবে হানাফি মাযহাবে এটি মাকরুহ বলে বিবেচিত হয়, তবে হারাম নয়।

২. হানাফি মাযহাবে চিংড়ি কেন মাকরুহ বলা হয়েছে?

কারণ হানাফি স্কলারদের মতে, চিংড়ি মাছের অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং এটি একটি সামুদ্রিক পোকা। ইসলামিক স্কলারদের মতে, শুধুমাত্র মাছ ও নির্দিষ্ট সামুদ্রিক প্রাণী খাওয়া বৈধ।

৩. কুরআন ও হাদিসে কি চিংড়ির ব্যাপারে কিছু বলা হয়েছে?

কুরআনে (সূরা মায়িদা ৫:৯৬) বলা হয়েছে, “তিনি তোমাদের জন্য সামুদ্রিক শিকার হালাল করেছেন।” এছাড়া রাসুল (সা.) বলেছেন, “সমুদ্রের পানি পাক এবং এর মৃত প্রাণী হালাল।” (মুসনাদে আহমদ)

৪. চিংড়ি খাওয়া কি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর?

চিংড়িতে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল রয়েছে, যা অতিরিক্ত গ্রহণ করলে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তবে পরিমাণমতো খেলে এটি শরীরের জন্য উপকারীও হতে পারে।

৫. যদি কেউ হানাফি মাযহাব অনুসরণ করে, তবে কি চিংড়ি খেতে পারবে?

হানাফি মাযহাবে এটি মাকরুহ, তবে হারাম নয়। তাই কেউ চাইলে খেতে পারে, তবে খাওয়া এড়ানো উত্তম বলে বিবেচিত হয়।

৬. চিংড়ির পরিবর্তে অন্য সামুদ্রিক খাবার কী খাওয়া যেতে পারে?

যদি কেউ চিংড়ি খেতে না চায়, তবে মাছ, কাঁকড়া, অক্টোপাস ইত্যাদি অন্যান্য হালাল সামুদ্রিক খাবার খেতে পারে (যদিও কাঁকড়া ও অক্টোপাস নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে)।


পোস্টটি শেয়ার করুন