বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম সমাজে ‘ফাজিল’ শব্দটি একটি পরিচিত পরিভাষা। এটি যেমন একজন ব্যক্তির ধর্মীয় শিক্ষাগত স্তর বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, তেমনি এর আরবি উৎস ও ব্যুৎপত্তিগত অর্থও রয়েছে যা গভীরভাবে চিন্তা করার মতো। অনেকে ‘ফাজিল’ বলতে শুধুই কোনো আলিম বা ইসলামী শিক্ষায় ডিগ্রি অর্জনকারী ব্যক্তিকে বোঝেন, আবার কেউ কেউ এটিকে একটি গুণবাচক শব্দ হিসেবেও ব্যবহার করেন—যেমন, “ফাজিল মানুষ” অর্থাৎ গুণবান বা জ্ঞানী মানুষ। কিন্তু বাস্তবে ‘ফাজিল’ শব্দটির অর্থ, প্রেক্ষাপট ও ব্যবহার কতটা গভীর এবং বৈচিত্র্যময়, তা অনেকের কাছেই অস্পষ্ট।
এই ব্লগপোস্টে আমরা ‘ফাজিল’ শব্দটির শাব্দিক অর্থ, আরবি উৎস, ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থায় এর অবস্থান, এবং সমাজে এর ব্যবহারিক দিকগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করব। পাশাপাশি আমরা জানার চেষ্টা করব, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিতে স্থান করে নিয়েছে এবং এর প্রকৃত তাৎপর্য কী।
ফাজিল শব্দের বিশ্লেষণ ও তাৎপর্য
‘ফাজিল’ (فاضل) শব্দটি মূলত আরবি ভাষা থেকে আগত। এটি “ফা-দাল-লা” (ف-ض-ل) মূলধাতু থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হয় “অধিক হওয়া”, “গুণে বা মর্যাদায় উত্তম হওয়া”, “অতিরিক্ত থাকা” বা “উৎকৃষ্ট হওয়া”। এই মূল ধাতু থেকেই ফاضل শব্দটি গঠিত হয়েছে, যার শাব্দিক অর্থ দাঁড়ায়—”গুণবান”, “উত্তম”, “মর্যাদাসম্পন্ন” বা “বিশিষ্ট” ব্যক্তি।
আরবি ভাষায় ফاضل শব্দটি সাধারণত সেইসব ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় যাঁরা জ্ঞানে, আচরণে বা গুণে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। উদাহরণস্বরূপ, কোনো আলেম বা পণ্ডিত ব্যক্তিকে “আল-ফাযিল ash-shaykh” বলা হয়, যার মানে, “মর্যাদাবান শায়খ” বা “জ্ঞানী আলেম”। ইসলামী সমাজে এই শব্দটির ব্যবহার মূলত সম্মানসূচক এবং গুণগত শ্রেষ্ঠত্ব নির্দেশ করে।
ফাজিল শব্দের ব্যবহার: প্রাত্যহিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিকতা
বাংলাদেশের সাধারণ মুসলিম সমাজে ‘ফাজিল’ শব্দটির ব্যবহার দ্বিমাত্রিক। একদিকে এটি একটি গুণবাচক শব্দ—যেমন, “তিনি একজন ফাজিল মানুষ” বলতে বোঝানো হয় যে তিনি জ্ঞানী, পরহেজগার, এবং ভদ্রচরিত্রের অধিকারী। অপরদিকে, এটি একটি আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগত স্তর নির্দেশ করে, যা ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার নির্দিষ্ট একটি ধাপকে বোঝায়।
ফাজিল: বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি স্তর
বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় ‘ফাজিল’ হলো একটি ডিগ্রি স্তর, যা সরকার কর্তৃক স্বীকৃত। এটি সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার স্নাতক পর্যায়ের সমতুল্য।
মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের ধাপে ধাপে পাঠ্যক্রম নিম্নরূপ:
- ইবতেদায়ী (প্রাথমিক)
- দাখিল (এসএসসি সমতুল্য)
- আলিম (এইচএসসি সমতুল্য)
- ফাজিল (স্নাতক সমতুল্য)
- কামিল (স্নাতকোত্তর সমতুল্য)
ফাজিল শ্রেণিতে ছাত্রছাত্রীরা সাধারণত তিন বছর মেয়াদী কোর্স সম্পন্ন করেন (আলিমের পর)। এই পর্যায়ে বিভিন্ন বিভাগে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে, যেমন: তাফসির, হাদিস, ফিকহ, আরবি সাহিত্য ইত্যাদি। বাংলাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত এই কোর্সগুলো সরকারি-বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে।
অর্থাৎ, এখানে ‘ফাজিল’ শুধু একটি শব্দ নয়, বরং এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদার প্রতীক—একজন আলেম তার জ্ঞানচর্চায় একটি বিশেষ স্তরে পৌঁছেছেন, তার প্রমাণ হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়।
ফাজিল: আধুনিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্ব
বর্তমানে ‘ফাজিল’ ডিগ্রিধারীরা শুধু মসজিদ বা মাদরাসা কেন্দ্রিক সেবা প্রদানকারী নন। অনেকেই গবেষণা, অনুবাদ, ইসলামি ব্যাংকিং, শিক্ষাদান, সাংবাদিকতা ও লেখালেখি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুনাম কুড়াচ্ছেন। ফলে ‘ফাজিল’ শব্দটি এখন শুধুই ধর্মীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়, বরং এটি একধরনের জ্ঞানের পরিচয়পত্র হয়ে উঠেছে।
ফাজিল ডিগ্রির স্বীকৃতি ও কর্মক্ষেত্র
বাংলাদেশে ফাজিল ডিগ্রি শুধু একটি ধর্মীয় যোগ্যতার প্রমাণ নয়—এটি একটি সরকার স্বীকৃত শিক্ষাগত স্তর, যা জাতীয় শিক্ষা কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়-এর অধীনে পরিচালিত ফাজিল ডিগ্রি বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (Pass) কোর্সের সমতুল্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
✅ সরকারিভাবে স্বীকৃতি:
- বাংলাদেশ সরকার ফাজিল ডিগ্রিকে স্নাতক পর্যায়ের ডিগ্রি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
- ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের (২০১৩) মাধ্যমে ফাজিল-কামিল স্তরকে আধুনিক শিক্ষা কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
- বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে ফাজিল ডিগ্রি গ্রহণযোগ্য (যেমন বিসিএস, ব্যাংক, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি)।
✅ উচ্চশিক্ষার সুযোগ:
- ফাজিল ডিগ্রিধারীরা ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা অন্যান্য অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে কামিল (স্নাতকোত্তর) কোর্সে ভর্তি হতে পারেন।
- অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে (যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) ফাজিল পাসদের জন্য আরবি/ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তির সুযোগ রয়েছে।
ফাজিল ডিগ্রিধারীদের কর্মক্ষেত্র
🕌 ১. ইসলামিক ধর্মীয় সেক্টর
- ইমাম, খতিব, মুফতি, মাদরাসা শিক্ষক, হিফজ ও ক্বিরাত প্রশিক্ষক।
- দাওয়াতি ও তাবলিগী কর্মকাণ্ডে নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা।
🏫 ২. শিক্ষাক্ষেত্র
- দাখিল/আলিম স্তরের শিক্ষকতা (নিয়োগ বোর্ড/নিবন্ধন পরীক্ষার মাধ্যমে)।
- ইসলামি ফাউন্ডেশন, মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত হওয়া।
🏢 ৩. সরকারি-বেসরকারি চাকরি:
- বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা/আরবি/ধর্মবিষয়ক ক্যাডার),
- পুলিশ, ব্যাংক, এনজিও, ইসলামিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।
🌐 ৪. অনলাইন ও মিডিয়ায়
- ইসলামিক কনটেন্ট নির্মাতা, ব্লগার, ইউটিউবার, অনুবাদক।
- ইসলামিক বই ও ফতোয়ার গবেষক ও সম্পাদক।
💼 ৫. ব্যবসা ও উদ্যোক্তা কার্যক্রম
- ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা,
- ইসলামি লাইব্রেরি, কোচিং সেন্টার, ইসলামি সফটওয়্যার/অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট।
বাস্তব উদাহরণ
বাংলাদেশে বহু প্রখ্যাত আলেম ও গবেষক—যাঁরা আজ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় মসজিদ বা আন্তর্জাতিক সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন—তাঁদের পথচলা শুরু হয়েছিল ফাজিল ডিগ্রি থেকেই।
বিভাগভিত্তিক বিষয় তালিকা (সিলেবাসের ধারণা)
নিচে “ফাজিল ডিগ্রির বিভাগভিত্তিক বিষয় তালিকা ও সিলেবাসের ধারণা” দেওয়া হলো, যা ব্লগপোস্টে যুক্ত করলে শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হবে:
ফাজিল ডিগ্রির বিভাগভিত্তিক বিষয় তালিকা (সিলেবাসের সংক্ষিপ্ত ধারণা)
বাংলাদেশে ফাজিল ডিগ্রি কোর্স সাধারণত তিন বছর মেয়াদি (১ম, ২য়, ৩য় বর্ষ) এবং এটি ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। এখানে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষায়িত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। নিচে প্রধান বিভাগগুলো এবং প্রতিটি বিভাগের প্রধান বিষয়গুলোর ধারণা তুলে ধরা হলো।
🔹 ১. তাফসির বিভাগ (تفسير)
কেন্দ্রীয় বিষয়সমূহ:
- উলুমুল কুরআন (কুরআনের ব্যাখ্যা ও সূত্র)
- কুরআনের নির্দিষ্ট সূরার তাফসির (তাফসিরে জালালাইন, তাফসিরে বায়যাবি)
- আরবি ভাষার ব্যাকরণ (নাহু-সরফ)
- কুরআন সম্পর্কিত ইতিহাস ও কালানুক্রম
🎯 উদ্দেশ্য: ছাত্রকে কুরআনের গভীর ব্যাখ্যা ও ভাষাগত বিশ্লেষণে দক্ষ করা।
🔹 ২. হাদিস বিভাগ (حديث)
কেন্দ্রীয় বিষয়সমূহ:
- উলুমুল হাদিস (হাদিসের পরিভাষা ও শ্রেণিবিন্যাস)
- নির্দিষ্ট কিতাব পাঠ (যেমন: মিশকাতুল মাসাবিহ, বোখারী শরিফ)
- রাবি ও সাবি বিশ্লেষণ
- হাদিস ও কুরআনের তুলনামূলক বিশ্লেষণ
🎯 উদ্দেশ্য: সহীহ হাদিস বুঝে তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারা।
🔹 ৩. ফিকহ বিভাগ (الفقه)
কেন্দ্রীয় বিষয়সমূহ:
- ইসলামী আইনশাস্ত্র (হানাফি ফিকহ)
- ফিকহি মাসআলা ও ফতোয়ার পদ্ধতি
- কিতাব পাঠ (নূরুল ইদাহ, হিদায়া)
- কিয়াস, ইজমা, ইস্তিহসান ইত্যাদি
🎯 উদ্দেশ্য: শরিয়াহ ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী তৈরি করা।
🔹 ৪. আরবি সাহিত্য বিভাগ (الأدب العربي)
কেন্দ্রীয় বিষয়সমূহ:
- আরবি ভাষার ইতিহাস ও সাহিত্য ধারা
- আরবি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ
- আরবি ব্যাকরণ (নাহু-সরফ) ও অলঙ্কার বিদ্যা
- কাব্য বিশ্লেষণ
🎯 উদ্দেশ্য: ছাত্রকে ভাষাগতভাবে শুদ্ধ আরবি লিখন ও বক্তৃতায় পারদর্শী করা।
🔹 ৫. ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
কেন্দ্রীয় বিষয়সমূহ:
- ইসলামি ইতিহাস (রাসুল সা. থেকে শুরু করে খেলাফতের যুগ)
- মুসলিম বিশ্বে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ
- প্রাচীন ও আধুনিক কালের ইতিহাস
- বাংলাদেশে ইসলাম আগমন ও প্রভাব
🎯 উদ্দেশ্য: মুসলিম ইতিহাস সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন।
📝 অন্যান্য সাধারণ বিষয়সমূহ (প্রায় সকল বিভাগে)
- বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
- ইংরেজি ভাষা
- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT)
- ইসলামি চিন্তাধারা
- গবেষণা পদ্ধতি (তৃতীয় বর্ষে)
🧭 মূল্যায়ন পদ্ধতি:
- লিখিত পরীক্ষা (বিভাগভিত্তিক)
- মৌখিক পরীক্ষা (আরবি উচ্চারণ, কিতাব পাঠ)
- কিছু বিষয়ে ব্যবহারিক/গবেষণাধর্মী প্রকল্প (বিশেষ করে ICT)
আরো পড়ুন:
বিভ্রান্তি ও সংশোধনী
নিচে “বিভ্রান্তি ও সংশোধনী” অংশটি ব্লগপোস্টে যুক্ত করার জন্য প্রস্তুত করে দেওয়া হলো। এতে সাধারণ মানুষের মাঝে ‘ফাজিল’ শব্দ ও ডিগ্রি নিয়ে যেসব ভুল ধারণা রয়েছে, তা সংশোধনের চেষ্টা করা হয়েছে।
বিভ্রান্তি ও সংশোধনী
‘ফাজিল’ শব্দটি যেমন অর্থবহ, তেমনই সম্মানজনক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে অনেক সময় এই শব্দ নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি দেখা যায়। এসব ভুল ধারণা ও মনোভাব শুধুমাত্র অজ্ঞতা থেকেই জন্ম নেয়। নিচে কয়েকটি প্রচলিত বিভ্রান্তি এবং তার যৌক্তিক জবাব উপস্থাপন করা হলো।
❌ বিভ্রান্তি ১:
“ফাজিল মানেই অল্পবিদ্বান বা গোঁড়া আলেম।”
✅ সংশোধন: ‘ফাজিল’ শব্দের মূল অর্থ হলো “গুণসম্পন্ন”, “মহৎ” বা “গৌরবান্বিত ব্যক্তি”। এটি একটি ইতিবাচক আরবি শব্দ, যার সঙ্গে অল্পজ্ঞান বা সংকীর্ণতার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং একজন ফাজিল ডিগ্রিধারী হলেন একজন স্বীকৃত ইসলামি স্কলার, যিনি কুরআন-হাদিস ও আরবি সাহিত্যসহ একাধিক বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখেন।
❌ বিভ্রান্তি ২:
“ফাজিল পড়লে শুধুই ইমাম হওয়া যায়, আর কিছু না।”
✅ সংশোধন: এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। ফাজিল ডিগ্রিধারীরা শুধু ইমাম নয়, বরং শিক্ষক, গবেষক, অনুবাদক, এনজিও কর্মকর্তা, সরকারি চাকরিজীবী এমনকি ইউটিউবার বা কনটেন্ট নির্মাতা হিসেবেও কাজ করছেন। অনেকেই কামিল শেষ করে মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যন্ত এগিয়ে যাচ্ছেন।
❌ বিভ্রান্তি ৩
“ফাজিল ডিগ্রি আধুনিক যুগে অপ্রাসঙ্গিক।”
✅ সংশোধন: বর্তমান সমাজে ইসলামি মূল্যবোধ ও ধর্মীয় জ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাপী ইসলামিক ফিন্যান্স, হালাল ইনভেস্টমেন্ট, শরিয়াহ কমপ্লায়েন্স, ইসলামি কাউন্সেলিং—এসব ক্ষেত্রে ফাজিল-কামিল শিক্ষিতদের চাহিদা বাড়ছে। অতএব, এটি শুধু প্রাসঙ্গিকই নয়, বরং ভবিষ্যতেও দরকারি হবে।
❌ বিভ্রান্তি ৪
“ফাজিল ডিগ্রি অদ্ভুত নাম, মানুষ হাসে।”
✅ সংশোধন: কিছু মানুষ ‘ফাজিল’ শব্দটিকে কৌতুকের ছলে ব্যবহার করে, যা একটি মারাত্মক অপসংস্কৃতি। এটা যেন বলা হয় “অনার্স পাস করছো? মানে তুমি অনার (শ্রদ্ধেয়)?” — এটি যেমন ভুল, তেমনি ‘ফাজিল’ শব্দ নিয়েও এমন কৌতুক অনুচিত। ধর্মীয় ডিগ্রির নাম নিয়ে ব্যঙ্গ করা শুধু অসভ্যতা নয়, বরং এটি একটি শ্রেণিকে অপমান করার সামিল।
❌ বিভ্রান্তি ৫
“মাদরাসার ছাত্ররা শুধু মুখস্থ করে, কাজের কিছু শেখে না।”
✅ সংশোধন: আধুনিক ফাজিল কোর্সে এখন আইসিটি, ইংরেজি, বাংলা, গবেষণা পদ্ধতি এমনকি সমসাময়িক চিন্তাধারা বিষয়েও পাঠ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ফলে একজন মেধাবী মাদরাসা ছাত্র শুধু ধর্মীয় জ্ঞানে নয়, বরং চিন্তা ও বিশ্লেষণেও পারদর্শী হয়ে উঠতে পারে।
ফাজিল সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (FAQ)
❓ ফাজিল কী?
✅ উত্তর: ‘ফাজিল’ একটি আরবি শব্দ, অর্থ “গুণসম্পন্ন” বা “মহৎ ব্যক্তি”। বাংলাদেশে এটি ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় অধীনস্থ একটি সম্মানজনক ডিগ্রি।
❓ ফাজিল কোন শ্রেণির সমমান?
✅ উত্তর: ফাজিল ডিগ্রি বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃতি অনুযায়ী স্নাতক (অনার্স) পর্যায়ের সমমানের।
❓ ফাজিলের মেয়াদ কত বছর?
✅ উত্তর: সাধারণত ফাজিল ডিগ্রি ৩ বছর মেয়াদি। তবে কেউ কেউ কামিল (মাস্টার্স) পর্যায়ে অগ্রসর হন।
❓ ফাজিল ডিগ্রি কোথায় পড়ানো হয়?
✅ উত্তর: বাংলাদেশে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাদরাসা বোর্ডভুক্ত আলিয়া মাদরাসাগুলোতে ফাজিল কোর্স চালু রয়েছে।
❓ ফাজিলে কোন কোন বিভাগ থাকে?
✅ উত্তর: ফাজিলে সাধারণত ৫টি বিভাগ থাকে:
- তাফসির
- হাদিস
- ফিকহ
- আরবি সাহিত্য
- ইসলামি ইতিহাস ও সংস্কৃতি
❓ ফাজিল পড়ে কী চাকরি পাওয়া যায়?
✅ উত্তর: হ্যাঁ। ফাজিল ডিগ্রিধারীরা হতে পারেন:
- আলেম, ইমাম, শিক্ষক
- ইসলামি গবেষক
- অনুবাদক
- এনজিও কর্মী
- সরকারি চাকরিজীবী (বিপিএসসি/মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর)
- ইউটিউবার/ব্লগার (ইসলামিক কনটেন্ট নির্মাতা)
❓ ফাজিলের সিলেবাসে কি আধুনিক বিষয় থাকে?
✅ উত্তর: হ্যাঁ। ফাজিলে আরবি, কুরআন-হাদিস ছাড়াও বাংলা, ইংরেজি, আইসিটি, গবেষণা পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে।
❓ ফাজিল ডিগ্রির স্বীকৃতি কোথায় কোথায় আছে?
✅ উত্তর: বাংলাদেশে এটি সরকার স্বীকৃত। এছাড়া ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এই ডিগ্রির মূল্য রয়েছে।
❓ ফাজিল ও কামিলের পার্থক্য কী?
✅ উত্তর: ফাজিল হলো স্নাতক (অনার্স) পর্যায়ের ডিগ্রি, আর কামিল হলো স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) পর্যায়ের ইসলামি ডিগ্রি।
উপসংহার
‘ফাজিল’ শব্দটির মধ্যে যেমন রয়েছে গভীর আরবি শাব্দিক অর্থ, তাৎপর্য, তেমনি রয়েছে সমাজ ও শিক্ষার বাস্তবিক প্রতিফলন। এটি একাধারে গুণ, জ্ঞান ও মর্যাদার প্রতীক। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘ফাজিল’ একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাগত স্তর, যা শুধু ধর্মীয় জ্ঞান নয়, বরং সামগ্রিক নৈতিকতা ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।