রাব্বানা লা তুযিগ কুলুবানা । পূর্ণ দোয়া । আরবি উচ্চারণ ও বাংলা অর্থ

Share this post

আমাদের হৃদয়—এই ছোট্ট অদৃশ্য অঙ্গটি—মানুষের ঈমান, ভালোবাসা, ভয়, আশা এবং পথভ্রষ্টতার কেন্দ্রবিন্দু। হৃদয়ের স্থিরতা ছাড়া কোনো আমলেই পরিপূর্ণতা আসে না। আর হৃদয়ের স্থিরতা আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। কুরআনের এক প্রাঞ্জল ও গভীর আবেদনময় দোয়ায় আমরা শিখি – রাব্বানা লা তুযিগ কুলুবানা:

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا

“হে আমাদের প্রভু! তুমি যখন আমাদের সঠিক পথ দেখিয়েছ, তার পরে আমাদের অন্তরকে বিপথে পরিচালিত কোরো না।” (সূরা আলে ইমরান: ৮)

এই আয়াত কেবল একটি দোয়া নয়; এটি একজন মুমিনের গভীর ভয় ও একান্ত চাওয়ার বহিঃপ্রকাশ। কেননা, হেদায়াত পাওয়ার পর পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়া—এ এক মারাত্মক আশঙ্কা। এই দোয়ায় রয়েছে সেই ভয় এবং আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসার নিদর্শন। এই আয়াতের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহর পথ পাওয়াটাই শেষ নয়—বরং সেটিতে টিকে থাকা আরও কঠিন, এবং তার জন্য চাই আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত।

এই লেখায় আমরা অন্বেষণ করব:

  • এই আয়াতের পটভূমি ও তাৎপর্য,
  • হৃদয়ের বিপথগামিতার কারণ,
  • এই দোয়ার গুরুত্ব এবং
  • আমাদের জীবনে এর প্রাসঙ্গিকতা।

আসুন, এই আয়াতের আলোয় আমরা নিজেদের হৃদয়কে পরীক্ষা করি এবং সেই আলোতে আল্লাহর দিকে ফিরে যাই—হৃদয় গলিয়ে দোয়া করি, যেন তিনি আমাদের অন্তরকে সোজা পথে রাখেন, আজীবন।

আয়াতের বিশ্লেষণ ও শব্দগত ব্যাখ্যা

رَبَّنَا — হে আমাদের রব!
لَا تُزِغْ — তুমি বক্র করে দিও না, মোড় ঘুরিয়ে দিও না।
قُلُوبَنَا — আমাদের অন্তরগুলো।
بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا — তুমি যখন আমাদের সৎপথে পরিচালিত করেছ, তার পরে।
وَهَبْ لَنَا — এবং আমাদের দান করো।
مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً — তোমার পক্ষ থেকে এক বিশেষ রহমত।
إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ — নিশ্চয়ই তুমি পরম দানশীল।

এখানে “تزغ” শব্দটি এসেছে “زَيْغ” থেকে, যার অর্থ হলো পথভ্রষ্টতা বা সত্য থেকে সরে যাওয়া। আর “وَهَّاب” হলো অতিশয় দানশীল—যিনি বিনা কারণে বারবার দান করেন।

আয়াতের তাফসির ও তাৎপর্য

এই আয়াতের প্রেক্ষাপটে তাফসিরকারগণ বলেন, এটি হযরতদের একটি দোয়া, বিশেষ করে আলেম ও মুত্তাকিদের, যারা হেদায়াত পাওয়ার পরও নিজের ওপর ভরসা না করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেন।

ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন:

“এই আয়াত মুমিনদের দোয়া, যারা আল্লাহর পথ পেয়েও দুশ্চিন্তায় থাকে, যদি আল্লাহ অন্তরকে সরিয়ে দেন?”

ইমাম রাগিব ইসফাহানি (রহ.) বলেন:

“যে যত বেশি আল্লাহকে চিনে, সে তত বেশি ভয় করে পথভ্রষ্ট হওয়ার।”

এই আয়াত আমাদের শেখায়—

  • হেদায়াত পাওয়াটাই চূড়ান্ত গন্তব্য নয়।
  • অন্তর সবসময় পরিবর্তনশীল।
  • আল্লাহর রহমত ছাড়া কেউ স্থির থাকতে পারে না।

কেন অন্তর বিপথে যায়?

কুরআন ও হাদীস অনুসারে অন্তর বক্র হওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো:

১. পাপের উপর স্থায়ী হয়ে যাওয়া:
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন, যখন কেউ পাপ করে, তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে। দাগ বাড়তে বাড়তে পুরো হৃদয় ঢেকে ফেলে। (তিরমিজি)

২. আল্লাহর জিকির থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা:
“যে ব্যক্তি আমার জিকির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার জন্য কঠিন জীবন হবে।” (সূরা তাহা: ১২৪)

৩. হাসাদ, গিবত, অহংকার, রিয়া ইত্যাদি অন্তরজনিত রোগ।

৪. নিয়মিত কুরআন ও হিদায়াত থেকে দূরে থাকা।

আমাদের করণীয়: কিভাবে অন্তরকে সোজা রাখা যায়

নিয়মিত এই দোয়া করা:
এই আয়াতের দোয়া প্রতিদিন সালাতের পর, তাহাজ্জুদের সময় কিংবা ইবাদতের মধ্যে অন্তর দিয়ে করা উচিত।

হৃদয় পরিশুদ্ধ রাখা:
হিংসা, অহংকার, গিবত থেকে বেঁচে থাকা।

হেদায়াতের পথে থাকার চেষ্টা:
একবার হেদায়াত পেলে তাতে টিকে থাকার চেষ্টা করা জরুরি।

আল্লাহর রহমতের আশা:

“وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً”

আমরা তাঁর পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত চাই।

নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত, জিকির ও ভালো সঙ্গ

অন্তর যত আল্লাহর সাথে যুক্ত থাকবে, তত সে সোজা থাকবে।

শেষ কথা

এই দোয়াটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আমরা কখনোই নিজেদের ঈমান নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারি না। অন্তর বড়ই অস্থির ও পরিবর্তনশীল। হেদায়াত পাওয়ার পরও আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কেউ টিকে থাকতে পারে না।

আসুন, আমরা প্রত্যেকে এই আয়াতের দোয়াটি হৃদয় দিয়ে শিখি, বুঝি এবং অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তা আল্লাহর দরবারে পেশ করি:

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً ۚ إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ

🟩 প্রসঙ্গভিত্তিক সংযোগ: রাব্বানা লা তুযিগ কুলুবানা — এই আয়াতটি এসেছে কোথায়, কেন?

এই দোয়াটি এসেছে সূরা আলে ইমরানের ৮ নম্বর আয়াতে:

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً ۚ إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ

অর্থ: “হে আমাদের রব! তুমি যখন আমাদের সৎপথে পরিচালিত করেছ, তখন এরপর আমাদের অন্তরগুলোকে বক্র (পথচ্যুত) করে দিও না। আর আমাদেরকে তোমার পক্ষ থেকে রহমত দান করো। নিশ্চয়ই তুমি বহু দানশীল।”

🔍 আয়াতটি এসেছে কোন প্রসঙ্গে?

এই আয়াতের ঠিক আগে (আয়াত ৭-এ) আল্লাহ বলেছেন:

“তিনিই তোমার প্রতি কিতাব (কুরআন) নাযিল করেছেন, যাতে আছে স্পষ্ট আয়াতসমূহ… এবং কিছু আয়াত আছে মুতা’শাবিহ (অর্থে দ্ব্যর্থতা রয়েছে)।”

এরপর বলা হয়েছে:

“যারা অন্তরে বক্রতা পোষণ করে, তারা ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং অপব্যাখ্যার আশায় এই মুতা’শাবিহ আয়াতগুলোর পেছনে পড়ে থাকে…”

এখানে একেবারে পরিষ্কারভাবে এমন এক দলের কথা এসেছে যারা আল্লাহর কিতাব নিয়ে খেলা করে, ব্যাখ্যার নামে বিভ্রান্তি ছড়ায়, অন্তরে যাদের “জায়গা” নেই।

এমন বক্তব্যের পরই মুমিনদের দোয়া এসেছিল—

➡️ যাতে তারা এই বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা পায়।

🎯 এখান থেকে মূল শিক্ষা কী?

১. সত্য জানার পরও বিপথগামী হওয়া সম্ভব।

– তাই শুধু জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, আল্লাহর সাহায্য ছাড়া অন্তর সোজা রাখা যায় না।

২. তাফসিরে বিভ্রান্তির আশঙ্কা সব যুগেই ছিল।

– আজকের দিনে যেমন ইউটিউব, সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই আয়াত ব্যাখ্যা করে বিপথে ঠেলে দেয়; তেমনি সাহাবিদের যুগেও কিছু লোক কুরআনের মুতা’শাবিহ আয়াতকে ভিত্তি করে ফিতনা ছড়াতো (যেমন: খারিজিরা)।

৩. সঠিক নিয়ত ছাড়া ‘দ্বীনি আলোচনা’ও বিপদ ডেকে আনতে পারে।

– কেউ কেউ আয়াত ব্যাখ্যার নামে মানুষের মাঝে বিভাজন করে, নিজের মতাদর্শ চাপায়। এদেরই জন্য দোয়া: “হে আল্লাহ! আমাদের অন্তর বক্র করো না!”

আরো পড়ুন:

🕌 দোয়াটিকে আমলযোগ্য করে উপস্থাপন

📌 ১. আরবি, বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ

আরবি:

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً ۚ إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ

উচ্চারণ: রাব্বানা লা তুযিগ কুলুবানা ا বা’দা ইয্ হাদাইতানা ওয়া হাব্ লানা মিল্লাদুনকা রাহমাহ, ইন্নাকা আনতাল ওয়াহহাব।

অর্থ: “হে আমাদের রব! তুমি যখন আমাদের হিদায়াত দিয়েছ, তখন এরপর আমাদের অন্তরকে বক্র করে দিও না। আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য রহমত দান করো। নিশ্চয়ই তুমি অতিশয় দানশীল।”

⏰ ২. এই দোয়া কখন ও কোথায় পড়া যায়?

সময় / অবস্থাপ্রস্তাবিত আমল
📿 নামাজের সিজদায়কোনো সুন্নত বা নফল নামাজের সিজদায় একান্তভাবে
✋ তাওবার পরযখন কোনো গুনাহ থেকে ফিরে আসেন
🧎 ইবাদতের পরকুরআন তিলাওয়াত, দ্বীনি আলোচনা বা ওয়াজের পর
🛌 ঘুমানোর আগেআত্মসমালোচনার সময় অন্তর ঠিক রাখার দোয়া
😢 বিপদেঈমান নিয়ে ভয়, দ্বিধা, চিন্তা হলে
📖 কুরআনের মুতা’শাবিহ আয়াত পড়ার পরযেন ভুল ব্যাখ্যায় না গিয়ে থাকি

💡 ৩. একটি সহজ “দৈনিক অভ্যাস” পদ্ধতি

নিয়ম:
🕋 দিনে মাত্র ৩ বার দোয়াটি পড়ুন।
⏰ সময়:

  • ফজরের পর
  • যোহরের পর
  • ঘুমানোর আগে

টিপস:
📱 মোবাইল ওয়ালপেপার হিসেবে সেট করুন
📌 বাড়ির দেয়ালে বা আয়নার পাশে লিখে টানিয়ে রাখুন
🧠 অর্থসহ মুখস্থ করুন (শুধু আরবি নয়!)

💬 ৪. ছোট রিমাইন্ডার বাক্য হিসেবে মনে রাখুন

“আল্লাহ! হেদায়াতের পর আমার অন্তর যেন পিছলে না পড়ে…”

— এই বাক্যটি বাংলা রূপে মনে রাখলে অটোমেটিকভাবে হৃদয়ে গেঁথে যাবে।

📎 ৫. ফ্ল্যাশকার্ড বা চার্ট আকারে উপস্থাপন (টেক্সট ফরম্যাটে)

╔══════════════════════════════╗
║ 🌿 দোয়া: রَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا ║
╠══════════════════════════════╣
║ 🤲 উদ্দেশ্য: অন্তরকে হেদায়াতে স্থির রাখা ║
║ 📖 উৎস: সূরা আলে ইমরান – আয়াত ৮ ║
║ 🧠 কোথায় পড়বেন? ইবাদতের পর, চিন্তার সময় ║
║ 🕊️ ফলাফল: ঈমানের উপর স্থিরতা, আত্মা প্রশান্ত ║
╚══════════════════════════════╝

🎯 ৬. চ্যালেঞ্জ দিন: “৭ দিনের অন্তর প্রশিক্ষণ”

নিয়ম:

  • ৭ দিন ধরে প্রতিদিন ৩ বার এই দোয়া পড়ুন
  • প্রতিদিন একবার নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন: আজ অন্তরে কোনো বক্রতা (দ্বিধা, অহংকার, সন্দেহ) এসেছিল কি?

🔄 রিফ্লেকশন জার্নাল রাখার পরামর্শ দিন—এই দোয়াটি পড়ার পর অন্তরে কেমন অনুভব করছেন।

🪄 ৭. স্মরণীয় উপসংহার বাক্য

“জ্ঞান আপনাকে ইসলাম চেনাবে, কিন্তু এই দোয়াই আপনাকে ইসলামে স্থির রাখবে।”


Share this post
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x