অজু ভঙ্গের কারণ । ৩ টি না কি ১২ টি? হাদিসের ভিত্তিতে উত্তর

পোস্টটি শেয়ার করুন

অজু ভঙ্গের কারণ, অর্থাৎ যেসব বিষয় অজুর হুকুম বাতিল করে, সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলো বিষয়ে ইজমা (সর্বসম্মত মত) রয়েছে এবং কিছু বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।

হানাফিদের মতে অজু ভঙ্গকারী বিষয় ও অন্যান্য মাযহাবে মতভেদ রয়েছে। তবে আমরা এখানে কেবল হানাফি মাযহাবের কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করব।

অজু ভঙ্গের কারণ ৩ টি

ওযু ভঙ্গের কারণ মূলত ৩ টি। আমরা ওযু ভঙ্গের সকল কারণকে ৩ টি ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি।

  • দুই নির্গমনপথ (মলদ্বার ও মূত্রদ্বার) দিয়ে কোনো কিছু বের হওয়া।
  • দুই নির্গমনপথ ব্যতীত অন্য কোনো স্থান দিয়ে শরীরের ভেতর থেকে নাপাক কোনো কিছু বের হওয়া।
  • দুই নির্গমনপথ (মলদ্বার ও মূত্রদ্বার) দিয়ে কোনো কিছু বের হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়া।

প্রথম ক্যাটাগরি : ‍দুই নির্গমনপথ (مخرجان: مخرج البول والغائط) দিয়ে কিছু বের হওয়া

মলদ্বার ও মূত্রদ্বার ( যৌনাঙ্গ ) দিয়ে যে কোনো কিছু বের হলে ওজু ভেঙে যাবে। সেটা স্বাভাবিক (معتاد) বস্তু হোক অথবা অস্বাভাবিক (غير معتاد) কোনো বস্তু হোক, অজু ভাঙার ক্ষেত্রে কোনো তফাত সৃষ্টি করে না।

স্বাভাবিকভাবে (معتادًا) বের হওয়া বস্তু

  • মূত্র (بول)
  • মল (غائط)
  • বায়ু (ريح)
  • মযী (مذي) — উত্তেজনার সময় তরল বের হওয়া।
  • মনি (مني) — বীর্য।
  • ওদী (ودي) — পেশাবের পর বের হওয়া সাদা তরল।
  • পেটের অসুস্থতার কারণে কোনো তরল বের হওয়া।
  • হায়েজ – মহিলাদের মাসিক ঋতুস্রাব।
  • নেফাস – সন্তান প্রসব পরবর্তী স্রাব।

নোট : কোনো বিশেষ কারণে যদি নেফাসের রক্ত দেখা ছাড়াই সন্তানের জন্ম হয় যেমন, মৃত্যুপূর্ব শিশুর কৃত্রিম প্রসব ইত্যাদি তাহলেও ওযু ভেঙে যাবে। যদিও ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদের মতে—এমন অবস্থায় এই নারীর উপর নেফাসের বিধান প্রযোজ্য হবে না, কারণ নেফাসের বিধান রক্তের সাথেই সম্পর্কিত, আর এখানে রক্ত দেখা যায়নি।

যে সকল অস্বাভাবিক (غير معتاد) বস্তু বের হলে ওজু ভাঙে

  • রক্ত – মলদ্বার বা মূত্রদ্বার, উভয় পথেই হতে পারে।
  • কৃমি বা পোকা (دود) – উভয় পথেই দেখা যায়।
  • পুঁজ বা ইনফেকশনের তরল – উভয় পথ থেকেই হতে পারে।
  • পাথর (حصى) – মলদ্বারে ঠেসা মল বা মূত্রদ্বারে কিডনি স্টোন।
  • অপারেশন বা ডাক্তারি পরীক্ষায় ব্যবহৃত বস্তু – যেমন ক্যাথেটার, টিউব ইত্যাদি।
  • ঔষধ বা পরীক্ষার পর নিঃসৃত পদার্থ – বিশেষ করে মূত্রনালী থেকে।
  • টিস্যু, ঝিল্লি বা অন্য অজানা উপাদান – অপারেশনের পর বের হওয়া বস্তু।
  • টিউমার বা মাংসপিণ্ড – ভেতর থেকে সরে আসা অস্বাভাবিক জিনিস।

📖 দলিল

আল্লাহ তায়ালা বলেন:

{أو جاء أحد منكم من الغائط}

“অথবা তোমাদের কেউ (পেশাব) পায়খানার কাজ সেরে এলো…” (সূরা মায়িদা: ৬)

হাদীসে রাসূল (ﷺ) বলেন:

لا يقبل الله صلاة أحدكم إذا أحدث حتى يتوضأ، فقال رجل من أهل حضرموت: ما الحدث يا أبا هريرة؟ قال: فُسَاء أو ضراط

“তোমাদের কেউ হাদাস সংঘটিত করলে ওযু না করা পর্যন্ত আল্লাহ তার নামাজ কবুল করেন না, তখন হাযরামাউতের এক ব্যক্তি আবু হুরাইরা (রা.) কে জিজ্ঞাসা করলেন: ‘হাদাস বলতে আপনি কী বোঝান? তিনি বললেন: “ফুসা (হালকা বাতাস) অথবা দুরাত (দমকা বাতাস)।” (মুসলিম)

আরেক হাদীসে রাসূল (ﷺ) বলেন:

لا وضوء إلا من صوت أو ريح

“শব্দ বা গন্ধ না হলে অজু ভঙ্গ হয় না।” (সুনানু তিরিমিযি)

➤ মল-মূত্রের রাস্তা দিয়ে অস্বাভাবিক কিছু বের হলে যেহেতু এসবের সঙ্গে নাপাক তরল বা আর্দ্রতা থাকে, তাই মযীর মতো অজু ভঙ্গকারী হবে।

দ্বিতীয় ক্যাটাগরি : দুই নির্গমনপথ ছাড়া অন্য কোনো স্থান থেকে নাপাক কিছু বের হওয়া

দুই নির্গমনপথ ছাড়া অন্য স্থান থেকে কোনো নাপাক বের হলে ওযু ভেঙ্গে যাবে।

➤ এখানে অন্তর্ভুক্ত

  • বমি করা (إذا كان ملء الفم )
  • শরীরের কোনো স্থান দিয়ে রক্ত বের হওয়া (دم خارج)
  • শরীরের কোনো স্থানে পুঁজ বের হওয়া (صديد خارج)
  • শরীর ফাটলে বা কাটা স্থানে নাপাক পদার্থ বের হওয়া

রক্ত, পুঁজ ইত্যাদির ক্ষেত্রে শর্ত হলো – সেটা তার বের হওয়ার স্থান থেকে বের হয়ে শরীরের এমন স্থানে গড়াতে হবে, যার উপর পবিত্রতার বিধান আরোপিত হয়।

গড়ানো মানে হলো: নাপাক তার বের হওয়ার স্থান থেকে নিচে নামতে থাকা বা ছড়িয়ে পড়া।

আর বমির ক্ষেত্রে শর্ত হলো মুখভরে হতে হবে। অর্থাৎ এমন পরিমাণ বমি, যা মুখের ভেতর ধরে রাখা কষ্টকর হয়। বমির ধরন যাই হোক না কেন—খাবার, পানি, জমাট বাধা রক্ত কিংবা পিত্ত সবই অজু ভঙ্গকারী।

নোট:

  • শরীরের বাইরের সাধারণ ঘাম বা থুতু ইত্যাদি এখানে আসবে না।
  • শুধু ভেতর থেকে যদি নাপাক বস্তু বের হয় বা শুধু প্রকাশ পায় কিন্তু সেটা গড়িয়ে পড়ে না, তাহলে ওজু ভাঙবে না।
  • এক ফোঁটা বা দুই ফোঁটা রক্তের কারণে অজু ভাঙবে না।
  • কোনো কিছুকে কামড়ে ধরার কারণে বা মিসওয়াক করার ফলে রক্ত বের হলে তার জন্যও অজু ভাঙবে না।
  • যেসব স্থানে পবিত্রতার বিধান প্রযোজ্য হয় না—যেমন: চোখ, কান, স্তন বা নাভির ভেতরের কোনো ক্ষত ইত্যাদি থেকে বের হয়ে রক্ত পাশে গড়িয়ে পড়লেও অজু ভাঙবে না।

দলিল

আবু দরদা (রাঃ) হতে বর্ণিত

أن النبي صلّى الله عليه وسلم قاء، فتوضأ، فلقيت ثوبانَ في مسجد دمشق، فذكرت له ذلك، فقال: صدق، أنا صببت له وَضُوءه

“নবী (সা.) একবার বমি করলেন, অতঃপর অজু করলেন। এরপর আমি (রাবী) দামেশকের মসজিদে হযরত ছওবান (রাঃ)- এর সাথে সাক্ষাত করলে, তাকে এই ঘটনা জানালাম, তিনি বললেন: ‘তুমি ঠিক বলেছো। আমিই তার অজুর পানি ঢেলে দিয়েছিলাম।’ ( তিরমিজি : ৮৭, সহিহ )

ফাতিমা বিনতে আবু হুবাইশ (رضي الله عنها) থেকে বর্ণিত হাদিস

قالَ النبيُّ صلَّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ لفاطمةَ بنتِ أبي حُبيشٍ: “إنَّما ذلكِ عِرقٌ، وليسَ بحَيضةٍ، فإذا أقبَلَتِ الحيضةُ، فدَعي الصلاةَ، وإذا أدبَرَتْ، فاغسِلي عنكِ الدمَ، ثمَّ صلِّي، ثُمَّ تَوضَّئي لِكُلِّ صلاةٍ، حتَّى يَجيءَ ذلكَ الوقتُ.

অনুবাদ: রাসূলুল্লাহ ﷺ ফাতিমা বিনতে আবু হুবাইশ (رضي الله عنها)-কে বললেন: “এটা তো রক্তনালী থেকে আসা রক্ত, এটি হায়েজ নয়। যখন হায়েজ শুরু হবে, তখন সালাত ত্যাগ করো। আর যখন তা শেষ হবে, তখন তোমার থেকে রক্ত ধুয়ে ফেলো এবং সালাত আদায় করো। তারপর প্রত্যেক নামাযের জন্য অজু করো, যতক্ষণ না আবার ঐ নির্দিষ্ট সময় আসে।” ( বুখারি ২২৮ ও মুসলিম ৩৩৩)

রাসূল (ﷺ) এই হাদিসে স্পষ্টভাবে রক্তনালী থেকে আসা রক্ত প্রবাহিত হওয়ার কারণে ওজু করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই রক্তনালী থেকে রক্ত বের হলেই ওযু করতে হবে, সেটা শরীরের যে কোনো স্থান থেকেই হোক না কেন।

তৃতীয় ক্যাটাগরি : দুই নির্গমনপথ দিয়ে কিছু বের হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়া

শরীরের এমন কোনো অবস্থা সৃষ্টি হলে, যেখানে মলদ্বার বা মূত্রদ্বার দিয়ে নাপাক কিছু বের হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে — তখন ওযু ভেঙে যায়, চাই আসলে কিছু বের হোক বা না হোক। কারণ, এই অবস্থায় শরীরের নিয়ন্ত্রণ থাকে না, ফলে মল বা মূত্র বের হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।

অজু ভঙ্গের কারণ
অজু ভঙ্গের কারণ

➤ : এই ক্যাটাগরির অন্তর্ভুক্ত অবস্থা

  • গভীর ঘুম (নিদ্রা),
  • অজ্ঞান হয়ে যাওয়া (إغماء)
  • পাগল হয়ে যাওয়া (جنون)
  • মূর্ছা যাওয়া বা অচেতন হওয়া
  • নেশাগ্রস্ত হওয়া (سكران)

ঘুম: শায়িত অবস্থায় ঘুমানো (মানে শুয়ে ঘুমানো)। এটি অল্প হোক বা বেশি হোক, অজু ভঙ্গ করে — চার ইমাম এই ব্যাপারে একমত। এবাবে বসেবসে কেউ যদি কোনো বস্তুর উপর হেলে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায, সেই অবস্থায় এই বস্তুটি সরিয়ে ফেললে সে পড়ে যাবে, তখনও ওযু ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু কেউ যদি নামাজের কোনো অবস্থার মতো যেমন দাঁড়িয়ে, রুকুতে, সিজদায় বা বসে ঘুমায়, তার ওজু ভঙ্গ হবে না। সেটা নামাজের ভিতরে হোক অথবা বাহিরে হোক কোনো তফাত নেই।

সংজ্ঞাহীনতা : অজ্ঞান হওয়া, চেতনা লোপ পাওয়া, নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন, পাগলামি, মৃগী রোগ, অথবা ঘুম—এসবের ফলে ওজু ভেঙে যায়। এসব কারণে সাধারণত কোনো না কোনো কিছু শরীর থেকে বের হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এগুলো ওজুভঙ্গের কারণ হিসেবে গণ্য হয়। চেতনা হারানো ব্যক্তি তার অবস্থা টের পায় না; আর পাগলামি বা অজ্ঞানতা ঘুমের চেয়েও বেশি প্রভাব ফেলে।

দলিল:

সফওয়ান ইবনু আস্‌সাল আল-মুরাদী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত — তিনি বলেন:

ان رسول الله ﷺ يأمرنا إذا كنا مسافرين ألا ننزع خفافنا ثلاثة أيام ولياليهن إلا من جنابة ولكن من غائط وبول ونوم

রসূলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে নির্দেশ দিতেন যে, সফরে থাকাকালে তিনদিন তিন রাত মোজা খুলতে না, তবে অপবিত্রতার (জানাবাতের) কারণে খুলতে হবে। আর গোঁ, পেশাব ও ঘুমের কারণে মোজা মাসেহ করে নেওয়া জায়েয হবে (অজু করতে হবে)। ( নাসায়ী ও তিরমিযী )

রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

العينان وكاء السه، فإذا نامت العينان استطلق الوكاء

“চোখ দুইটি পশ্চাদ্বার (মলদ্বারের) রক্ষাকারী। যখন চোখ ঘুমিয়ে পড়ে, তখন রক্ষাকবচ আলগা হয়ে যায়।” — (সুনান আবু দাউদ: ২০৩, সহিহ)

عن ابن عمر أنه كان ينام، وهو جالس، فلا يتوضأ، وإذا نام مضطجعًا أعاد الوضوء.

‘আব্দুর রাজ্জাক তার “আল-মুসান্নাফ” গ্রন্থে ইবনে উমর (রা.) সূত্রে বর্ণনা করেন — তিনি ( ইবনে উমর রা. ) বসা অবস্থায় ঘুমাতেন, তবুও অজু করতেন না। কিন্তু যদি শোয়া অবস্থায় ঘুমাতেন, তখন অজু পুনরায় করতেন। ( ৎমুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক, সনদ সহিহ)

ইবনুল মুনযির (রহ.) বলেছেন: “সমস্ত আলেম ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন যে, অচেতন (অজ্ঞান) ব্যক্তির উপর অজু করা ফরজ। কারণ, এদের অনুভূতি ঘুমন্ত ব্যক্তির অনুভূতির চেয়েও বেশি দুর্বল — তার প্রমাণ হলো, ঘুমন্তরা ডাকলে জাগ্রত হয় কিন্তু তাদের ডেকেও জাগ্রত করা যায় না।

কিছু প্রশ্ন ও উত্তর

সালাতের মধ্যে উচ্চস্বরে হাসলে কী ওযু ভঙ্গ হবে?

না, নামাজে উচ্চস্বরে হাসলে ওযু ভঙ্গ হবে না, এটাই সঠিক অভিমত। শরীয়তে কোনো ইবাদতের অবস্থা অব্যাহত (বাকি ) থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত তা ভঙ্গের কোনো সহিহ ও সুস্পষ্ট দলিল পাওয়া না যায়। ওযু অবস্থায় নামাজে জোরে হাসলে কোনো সহিহ দলিল নেই যা বলে যে ওযু ভেঙে যাবে। সুতরাং মূলনীতি অনুযায়ী ওযু বহাল থাকবে।

উলংগ হলে কি ওযু ভেঙে যায়?

না, শুধু উলংগ হলে ওযু ভাঙে না। ওযু তখনই ভাঙে যখন শরীয়ত নির্ধারিত কোনো কাজ সংঘটিত হয়, যেমন প্রস্রাব, পায়খানা, পায়ুপথ দিয়ে বাতাস নির্গমন ইত্যাদি।


পোস্টটি শেয়ার করুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x