একসাথে তিন তালাক দিলে কি তালাক হবে? গবেষণা-ভিত্তিক উত্তর

শেয়ার করুন

তালাক একটি স্পর্শকাতর বিষয়। শরিয়ত কেবল দাম্পত্যকহলের অসহনীয় পর্যায় থেকে মুক্তি লাভের পন্থা হিসেবে তালাক ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই তালাক প্রদান করা ও তালাক পতিত হওয়ার ফতোয়া দেওয়া উভয় ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকা জরুরি। তালাকের ব্যপারে শরিয়তের অবস্থানকে বিবেচনায় রেখে ও দলিলের শক্তিমত্তা যাচাই করে ফতোয়া দেওয়া অপরিহার্য একটি কাজ। এই নিরিখে আমরা আলোচ্য মাসআলাটি নিয়ে আলোচনা করছি। মাসআলাটি সঠিক ও সুস্পষ্টভাবে বুঝার জন্য আমরা নিন্মের শিরোনামগুলোর অধীনে পুরো আলোচনা পরিবেশন করছি।

একসাথে তিন তালাক দিলে কি তালাক হবে? সংক্ষিপ্ত উত্তর

হ্যা, একসাথে তিন তালাক দিলে তালাক হবে। কিন্তু একসাথে তিন তালাক দিলে কয়টি তালাক হবে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। চার মাযহাবের বিশিষ্ট চার ইমাম – ইমাম আবু হানিফ, ইমাম মালিক, ইমাম শাফি, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুমুল্লাহসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিকাহবিদ একসাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাক পতিত হয়ে যাবে বলে মতামত দিয়েছেন। এর বিপরীত অনেক সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালিহিন বিশেষভাবে ইমাম ইবনু তাইমিয়া, ইমাম ইবনুল কায়্যিম, ইমাম শাওকানি প্রমুখ থেকে একসাথে তিন তালাক দিলে এক তালাক পতিত হওয়ার অভিমতও রয়েছে। তবে এই মতবিরোধ কেবল সে তালাকের ক্ষেত্রে যেখানে আলাদা আলাদা বাক্য ব্যবহার করে তিন তালাক দেওয়া হয়। যেমন তুমি তালক, তুমি তালাক, তুমি তালাক। কেউ যদি কেবল একটি বাক্য ব্যবহার করে তিন তালাক দেয়, যেমন তোমাকে তিন তালাক তাহলে সকলের মতেই এক তালাক হবে। বিস্তারিত জানতে পুরো আর্টিকেলটি পড়া আবশ্যক।

একসাথে তিন তালাক : একটি পর্যালোচনা

  • তালাকের শরয়ি পন্থা।
  • শরয়ি পন্থা বহির্ভূত তালাকের ব্যপারে ইমামদের অবস্থান।
  • একসাথে তিন তালাকের তিনটি রূপ।
  • নববি যুগে একসাথে তিন তালাক।
  • সাহাবা যুগে একসাথে তিন তালাক ও মতপার্থক্যের উৎস।
  • তাবেয়ি ও আইম্মায়ে মুজতাহিদিনের যুগে একসাথে তিন তালাক।
  • দালায়িল ও পর্যালোচনা।
  • গ্রহণযোগ্য অভিমত।

তালাকের শরয়ি পন্থা

শরিয়ত তিন তুহুরে ( মাসিক স্রাব থেকে মুক্ত সময়ে) তিন বার তালাক দেওয়াকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। শুরু হবে এমন তুহুরে যে তুহুরে সহবাস হয়নি। প্রথম ও দ্বিতীয় বার তালাক দেওয়ার পর রাজয়াত ( প্রত্যাবর্তন ) করার সুযোগ থাকবে। কিন্তু তৃতীয় বার তালাক দেওয়ার পর আর রাজয়াতের সুযোগ থাকবে না।

পবিত্র কুরআনে সুরা বাকারার দুইশত উনত্রিশ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

‘(রাজয়ি) তালাক দুইবার (দেওয়া যাবে)। অতপর (রাখতে চাইলে) উত্তম পন্থায় রাখবে অথবা ন্যায় সংগতভাবে বিদায় করে দিবে। …( দুইবার তালাক দেওয়ার পর) যদি তৃতীয়বার তালাক দিয়ে দেয় তাহলে এই স্ত্রী আর তার জন্য হালাল হবে না যতক্ষণ না অন্য কোন স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে।’

আর এই তিন তালাক কখন কীভাবে দিতে হবে তার বর্ণনা এসেছে সুরা তালাকের প্রথম আয়াতে,

হে নবি, তোমরা স্ত্রীলোকদের তালাক দিলে তাদেরকে তাদের ইদ্দতের জন্য তালাক দাও এবং ইদ্দতের সময়টা ঠিকমত গণনা করো।’

সহিহ বুখারি শরিফে রাসূল (সা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে এই আয়াতটির ব্যাখ্যা এসেছে স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে। ইবনে উমর (রাদি.) তাঁর স্ত্রীকে হায়েজ অবস্থায় তালাক দেওয়ার পর উমর (রাদি.) রাসূল (সা.)কে এই কথাটি অবগত করলে রাসূল (সা.) বললেন,

‘তুমি তাকে নির্দেশ দাও সে যেন তার স্ত্রীকে রাজয়াত করে নেয়। অতপর সেই মহিলা (চলমান হায়েজ অতিবাহিত করে ) তুহুরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। অতপর মহিলা দ্বিতীয় হায়েজ অতিবাহিত করে তুহুরে পৌঁছে গেলে চাইলে স্পর্শ কারার আগে তালাক দিয়ে দিতে পারে। এটাই হলো ইদ্দত যার নির্দেশ আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন।(বুখারি,৫২৫১)

উক্ত আয়াতের তাফসিরে আল্লামা ইবনুল কাসির (রাহ.) বলেন, ‘এখান থেকে ফুকাহায়ে কেরাম তালাককে সুন্নাহ ও বিদআহ দুই ভাগে ভাগ করেছেন। তালাকে সুন্নাহ হলো মহিলাকে এমন তুহুরে তালাক দেওয়া যে তুহুরে তার সাথে স্বামী সহবাস করেনি। অথবা মহিলার গর্ভ স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর তালাক দেওয়া। আর তালাকে বিদআহ হলো কোন মহিলাকে তার হায়েজ চলাকালীন সময়ে বা এমন তুহুরে তালাক দেওয়া যে তুহুরে সহবাস করেছে, এমতাবস্থায় যে, মহিলা গর্ভবতী কি-না তা জানা যায় না। আর (একসাথে) তিন তালাক দেওয়া এটা সুন্নত বা বিদআত কোনটিই নয়।’

উল্লেখিত দুটি আয়াত ও হাদিস থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, একজন স্বামী তার স্ত্রীকে তিনবার তালাক দেওয়ার অধিকার রাখে। যার পদ্ধতি হলো প্রত্যেক তুহুরে (যে তুহুরে সহবাস হয়নি) একবার করে তালাক দেওয়া। প্রথম দু’বার তালাক দেওয়ার পর রাজয়াতের সুযোগ আছে কিন্তু তৃতীয় বার তালাক দিয়ে দিলে তখন আর রাজয়াতের সুযোগ নেই।

আর এর বাহিরে যে পদ্ধতিতেই তালাক দেওয়া হোক সেটা শরিয়ত সম্মত পদ্ধতি নয়। চাই হায়েজ অবস্থায় তালাক দেওয়া হোক বা এক তুহুরে তিন তালাক দেওয়া হোক। এজন্যই রাসূল (সা.) কে যখন জানানো হয় এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে একসাথে তিন তালাক দিয়ে ফেলেছে তখন তিনি বলেছিলেন,‘ আমি তোমাদের মধ্যে বর্তমান থাকতে আল্লাহর কিতাব নিয়ে খেলা হচ্ছে ?’ ( নাসাঈ,৩৪০১)।

তবে শরিয়ত বহির্ভূত পন্থায় তালাক দিলে তালাক পতিত হবে কি-না বা কয় তালাক পতিত হবে সে ব্যপারে কুরআনে স্পষ্ট বক্তব্য নেই। এই আলোচনা থেকে কেবল আমাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে যে, একসাথে তিন তালাক দেওয়া বা হায়েজ অবস্থায় তালাক দেওয়া শরিয়া বর্হিভূত একটি কাজ।

শরয়ি পন্থা বহির্ভূত তালাকের ব্যাপারে ইমামদের অবস্থান

পূর্বেকার আলোচনা থেকে আমার জেনেছি শরিয়া বহির্ভূত তালাক তিন ভাবে হতে পারে।

  • হায়েজ ( মাসিক ) চলাকালীন সময়ে তালাক দেওয়া।
  • সহবাসকৃত তুহুর ( মাসিক বন্ধ ) অবস্থায় তালাক দেওয়া।
  • একসাথে তিন তালাক দেওয়া।

সংখ্যাগরিষ্ঠ ইমামদের মতে যেমনি শরিয়া সম্মত পন্থায় তালাক পতিত হবে তেমনি শরিয়া বহির্ভূত পন্থায়ও তালাক পতিত হয়ে যাবে। তবে আরেক জামাত মুহাক্কিক উলামা শরিয়া বহির্ভূত পন্থায় তালাক পতিত হবে না বলে অভিমত পেশ করেছেন। আমাদের আলোচ্য বিষয় যেহেতু এটা নয় তাই আমরা এখানে বিস্তারিত আলোচনা না করে কেবল সংক্ষেপে দ্বিতীয় পক্ষের দালায়িল নিয়ে কিছু কথা বলছি।

দ্বিতীয় পক্ষের প্রথম দলিল

আবুয যুবাইর সংবাদ দেন যে, তিনি আব্দুর রাহমান ইবনে আইমানকে ইবনে উমর রাদি. কাছে প্রশ্ন করতে শুনেছেন সেই ব্যক্তি সম্পর্কে যে হায়েজ অবস্থায় নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে। তখন ইবনে উমর রাদি. বলেন আব্দুল্লাহ ইবনে উমর তার স্ত্রীকে রাসুল (সা.) এর যুগে হায়েজ অবস্থায় তালাক দিয়েছিলো। তখন উমর রাদি. রাসুল (সা.) কে বললেন আব্দুল্লাহ ইবনে উমর তার স্ত্রীকে হায়েজ অবস্থায় তালাক দিয়ে ফেলেছে। ইবনে উমর বলেন অতপর রাসুল সা. (একথা শুনে বুঝেও) আমার স্ত্রীকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। রাসুল (সা.) এই তালাককে কাযর্কর কোন কিছুই মনে করেননি। অতপর তিনি বললেন সেই মহিলা হায়েজ থেকে পবিত্র হয়ে গেলে সে যেন তাকে রাখে বা ছেড়ে দেয়।

ইবনে উমর (রাদি.) বলেন তখন রাসুল (সা.) কুরআনের এই আয়াত পাঠ করেন,

‘হে নবি! তোমরা স্ত্রীলোকদের তালাক দিলে তাদেরকে তাদের ইদ্দতের জন্য তালাক দাও এবং ইদ্দতের সময়টা ঠিকমত গণনা করো। (আবু দাউদ শরিফ, ২১৮৫)

দ্বিতীয় দলিল

সূরা তালাকের প্রথম আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন-

‘হে নবি! তোমরা স্ত্রীলোকদের তালাক দিলে তাদেরকে তাদের ইদ্দতের জন্য তালাক দাও এবং ইদ্দতের সময়টা ঠিকমত গণনা করো।’

সুতরাং হায়জ অবস্থায় বা সহবাসকৃত তুহুরে বা একসাথে তিন তালাক প্রদানকারী ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা ইদ্দতে তালাক দেওয়ার যে নির্দেশ দিয়েছেন সেই নির্দেশ মানেনি। একটি প্রসিদ্ধ উসুল হলো কোন বিষয়ে আদেশ দেওয়ার মানে হচ্ছে তার বিপরীত থেকে নিষেধ করা। আর প্রত্যেক নিষেধকৃত বিষয় ফাসাদের দাবি করে। এবং ফাসাদ হুকুম সাবিত করতে পারে না। সুতরাং শরিয়া বহির্ভূত পন্থায় দেওয়া তালাকও হুকুম সাবিত করতে পারে না। ( নায়ইলুল আওতার,….)

তৃতীয় দলিল

রাসুল (সা.) বলেছেন,

‘যে ব্যক্তি আমাদের নির্দেশ বহির্ভূত কাজ করবে তা প্রত্যাখ্যাত হবে।’( বুখারি ২৫৫০)

তাই এই হাদিসের ব্যপকতায় শরিয়া বহির্ভূত তালাকও প্রত্যাখ্যাত হয়ে যাবে।

চতুর্থ দলিল

যে সব আকদ হালাল ও হারামের অবকাশ রাখে, তা যখন হারাম হয় তখন বাতিল বলে গণ্য হয় যেমন বিবাহ ইত্যাদি। আর তালাকও তেমনি হলাল ও হারামের অবকাশ রাখে তাই হারাম অবস্থায় বাতিল বলে গণ্য হবে।
এভাবে আরো কিছু দালায়িল দিয়ে তারা এই প্রকার তালাক পতিত না হওয়ার মতকে শক্তিশালী করেন। সুতরাং তালাক পতিত না হওয়ার এই মতটি জুমহুরের খেলাফ হলেও দালায়িল বিবেচনায় নিতান্ত দূর্বল নয়।

একসাথে তিন তালাকের তিনটি রূপ

  • প্রথম রূপ: একই শব্দে তিন তালাক দেওয়া, যেমন সে বলল, আমি তোমাকে তিন তালাক দিলাম।
  • দ্বিতীয় রূপ: এক মজলিসে ভিন্ন-ভিন্ন শব্দে তিন তালাক দেওয়া যেমন, তোমাকে এক তালাক, তোমাকে দুই তালাক, তোমাকে তিন তালাক।
  • তৃতীয় রূপ: একই তুহুরে ভিন্ন ভিন্ন মজলিসে তিন তালাক দেওয়া।

উক্ত তিনটি রূপের মধ্য থেকে প্রথম রূপটি ( একই শব্দে তিন তালাকের ) ব্যপারে কিছু আহলে ইলিমের বক্তব্য হলো এই সুরতে এক তালাক পতিত হওয়ার উপর সাহাবাযুগ থেকে ইজমা চলে আসছে।

কেননা পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-‘ (রাজয়ি) তালাক দুইবার দেওয়া যাবে।’ অর্থ্যাৎ একবার শব্দ উচ্চারণের পর দ্বিতীয়বার আলাদা করে শব্দ বলতে হবে। এখন যদি একই শব্দে তিন তালাক বা দশ তালাক ( যেমন তোমাকে তিন বা দশ তালাক দিলাম) বলে ফেলে তাহলে এক তালাকই গণ্য হবে, যেহেতু সে শব্দ উচ্চারণ করেছে কেবল একটি।

যেমন কাউকে সুবহানাল্লাহ এক‘শো বার পড়তে বলা হলে সে যদি বলে ‘সুবহানাল্লাহ এক‘শো বার’ তাহলে তাকে এক‘শো বার সুবহানাল্লাহ পাঠাকারী বলা হবে না বরং সে একবার সুবহানাল্লাহ পাঠ করেছে বলে গণ্য হবে। তেনমিভাবে ‘ তোমাকে তিন তালাক’ বলার দ্বারা তিন তালাক হয়ে গেছে বলা যাবে না বরং সে এক তালাক দাতা বলে গণ্য হবে।

তাছাড়া রাসুল (সা.) বা সাহাবাযুগে একই শব্দে তিন তালাক দিলে তিন তালাক গণ্য হতো বলে কোন দলিল নেই। তার উল্টো তিন শব্দে তিন তালাক দিলে এক তালাক গণ্য করা হতো বলে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।

যেমন আবুস সাহবা (রাহ.) ইবনে আব্বাস (রাদি.) কে বললেন- ‘

আপনি কি জানেন রাসুল (সা.) আবু বকর (রাদি.) ও উমর (রাদি.)‘র শাসন আমলের প্রথম তিন বছর পর্যন্ত তিন তালাককে এক তালাক গণনা করা হতো? ইবনে আব্বাস (রাদি.) বললেন হ্যা? (মুসলিম,৩৭৪৭)

এই হাদিসের একাধিক ব্যাখ্যাকার তখনকার তিন তালাকের পদ্ধতি বলতে গিয়ে বলেছেন তা ছিলো ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ( তুমি তালাক, তুমি তালাক ,তুমি তালাক) হিসেবে।

এখান থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় উমর রাদি তিন তালাকের যে ফয়সালা করেছিলেন তা ছিলো ভিন্ন-ভিন্ন শব্দে ( তুমি তালাক, তুমি তালাক, তুমি তালাক) তিন তালাক দেওয়ার ব্যপারে। একই শব্দে তিন তালাক ( তোমাকে তিন তালাক) এই ব্যপারে নয়। আবু দাউদ শরিফে বর্ণিত ইবনে আব্বাস (রাদি.)র একটি উক্তিও এই কথাটিকে শক্তভাবে সমর্থন করে। তিনি বলেন,

‘যখন কোন ব্যক্তি একই শব্দে তুমি তিন তালাক বলে তাহলে সেই মহিলার উপর এক তালাক পতিত হবে।’ ( আবু দাউদ, ২১৯৯)

আল্লামা আশবাল (রাহি.) বলেন, ‘আমারা মনে করি যে ব্যক্তি ( তুমি তিন তালাক) বলে একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করে, সে কেবল একটি তালাক প্রদান করলো। আর তার এই কথাটি সাহাবা বা অন্যান্য করোই এখতেলাফের লক্ষ্যস্থল হতে পারে না। তারা তো এখতেলাফ করেছেন কেবল সেই ব্যক্তির ব্যপারে, যে এক মজলিসে বা একাধিক মজলিসে ভিন্ন-ভিন্ন শব্দ ( তুমি তালাক, তুমি তালাক, তুমি তালাক) বলে তিন তালাক দিয়েছে। উমর (রাদি.)‘র সিদ্ধান্ত ছিলো এই প্রকারের তালাকের ব্যপারে। (সহিহু ফিকহিস সুন্নাহ,৩/২৮৬)

এই বিশ্লেষণকে যদি আমরা গ্রহণ করে নেই তাহলে আমাদের আলোচনা থেকে একসাথে তিন তালাকের প্রথম রূপ অর্থ্যাৎ একই শব্দে তিন তালাক বের হয়ে যাবে। আলোচ্য বিষয় হিসেবে থাকবে কেবল দ্বিতীয় ও তৃতীয় রূপ।

নববি যুগে একসাথে তিন তালাক

এমন একটি প্রমাণও নেই যেখানে রাসুল (সা.) একসাথে দেওয়া তিন তালাককে কার্যকর করেছেন। এর বিপরীত যথেষ্ট সহীহ সরীহ দলিল রয়েছে যেখানে রাসুল (সা.) এর যুগে তিন তালাককে এক তালাক হিসেবে গণ্য করা হতো।

একসাথে তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করার প্রথম দলিল

আবুস সাহবা (রাহ.) ইবনে আব্বাস (রাদি.) কে বললেন-

আপনি কি জানেন রাসূল (সা.) আবু বকর রাদি. ও উমর (রাদি.)‘র শাসন আমলের প্রথম তিন বছর পর্যন্ত তিন তালাককে এক তালাক গণনা করা হতো? ইবনে আব্বাস (রাদি.) বললেন হ্যা? (মুসলিম,৩৭৪৭)

একসাথে তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করার দ্বিতীয় দলিল

রুকানা ইবনে ইয়াজিদ তাঁর স্ত্রীকে একই মজলিসে তিন তালাক দেওয়ার পর (তাকে রাখার আগ্রহে) খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন,

তখন রাসূল (সা.) তাকে প্রশ্ন করলেন কীভাবে তাকে তালাক দিয়েছো? রুকানা বললেন আমি তাকে তিন তালাক দিয়েছি। রাসূল (সা.) বললেন একই মজলিসে? রুকানা বললেন হ্যাঁ। রাসূল (সা.) বললেন এটা কেবল এক তালাক হয়েছে। তুমি চাইলে তাকে রাজয়াত করে নাও। (মুসনাদে আহমদ,২৩৮৭/ আবু ইয়ালা,২৫০০ সহিহ)

একসাথে তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করার তৃতীয় দলিল

রাসূল (সা.) কে সংবাদ দেওয়া হলে এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে একসাথে তিন তালাক দিয়ে দিয়েছে। তখন তিনি খুব রাগান্বিত হয়ে দাঁড়ালেন। অতপর বললেন, ‘আমি তোমাদের মধ্যে বর্তমান থাকতে আল্লাহর কিতাব নিয়ে তামাশা করা হচ্ছে?’ তখন একজন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললো, হে আল্লাহর রাসূল আমি কি এই লোককে হত্যা করবো? ( নাসাঈ,৩৪০১)

এটা কীভাবে সম্ভব যে আল্লাহর রাসূল (সা.) একটি কাজকে আল্লাহর কিতাব নিয়ে তামাশা বলবেন। আবার এই কাজকে কাযর্কর বলে স্বীকৃতি দেবেন ?

চতুর্থ দলিল : রাসূল (সা.) বলেছেন,‘যে ব্যক্তি আমাদের নির্দেশ বহির্ভূত কাজ করবে তা প্রত্যাখ্যাত হবে।’ ( বুখারি,২৫৫০)

একসাথে তিন তালাক কার্যকর করে দেওয়া যেহেতু শরিয়া বহির্ভূত কাজ (যা আমারা পূর্বে আলোচনা করে এসেছি) তাই তা প্রত্যাখ্যাত হবে। কিন্তু যেহেতু এক তালাক কাযর্কর করতে কোন অসুবিধা নেই, তাই এটা কার্যকর করা হবে।

মোটকথা রাসূল (সা.) একাসাথে তিন তালাক কাযর্কর করেছেন এর ন্যূনতম প্রমাণ নেই। রবং নববিযুগে তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা ছিলো সর্বসিদ্ধ ব্যপার। যার ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে অন্য পথ অবলম্বন করার সামান্যতম অবকাশ নেই।

সাহাবা যুগে একসাথে তিন তালাক ও মতপার্থক্যের উৎস

রাসুল (সা.) এর মৃত্যুর পর থেকেই সূচনা হয় সাহাবাযুগের। প্রথম খলিফা আবু বকর (রাদি.) খেলাফতে আসীন হওয়ার পর তিন তালাককে নববিযুগের মতো এক তালাক গণ্য করা হতো। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কোন ধরণের মতপার্থক্য ছাড়াই এই রীতি চালু ছিলো উমর (রাদি.) খেলাফতের দুই বছর পর্যন্ত। উমর (রাদি.) যখন দেখলেন একসাথে তিন তালাকের মতো শরিয়া বহির্ভূত একটি জগণ্য কাজকে মানুষ মামুলি বিষয় ভাবতে শুরু করে দিয়েছে তখন তিনি একসাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাক কাযর্কর করা হবে বলে রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়ন করেন।

মুসলিম শরিফে ইবনে আব্বাস (রাদি.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে এ কথাকেই সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রাদি.) বলেন,

রাসূল (সা.) আবু বকর (রাদি.) ও উমর (রাদি.)‘র শাসনকালের প্রথম দুই বছর পর্যন্ত তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হতো। অতপর উমর (রাদি.) বললেন মানুষ এমন একটি বিষয়ে বাড়াবাড়ি করছে যার মধ্যে তাদের জন্য ছাড় ছিলো। যদি আমরা বিষয়টি আইনের আওতায় নিয়ে আসি (তাহলে মানুষ তিন তালাক দেওয়ার পর এক তালাক পতিত হওয়ার অবকাশ থাকার কারণে শরিয়া বহির্ভূত পন্থায় যেভাবে রাতারাতি জড়িয়ে পড়ছে তা থেকে বিরত থাকতে পারে)। তাই তিনি তিন তালাক দিলে তিন তালাকই কাযর্কর হবে মর্মে আইন করলেন। (মুসলিম, ৩৭৪৬)

আর উমর (রাদি.) খলিফা হিসেবে যেহেতু এই আইন করেছিলেন তাই অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম তাঁর বিরোধিতা করেন নি। কেননা খলিফা রাষ্ট্রের স্বার্থে এমন আইন করা তাদের মধ্যে অভিনব কিছু ছিলো না। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আমরা একটু পরে করব ইনশাআল্লাহ।

উল্লেখ্য: উমর (রাদি.) এই আইন করার পর অন্য সাহাবারা বিরোধিতা করেননি ঠিক কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে তারা সকলে এটা মনে নিয়েছিলেন এবং সাহাবাযুগে এই মাসআলার উপর ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলো কথাটি বলা নিতান্ত আত্মতুষ্টি ছাড়া কিছুই নয়। কেননা সাহাবাযুগে এই মাসআলার উপর ইজমা না হওয়ার ব্যপারে যথেষ্ট শক্তিশালী প্রমাণ রয়েছে।

প্রথম প্রমাণ : হাফিজ ইবনুল কাইয়্যুম (রাহ.) বলেন, সকল সাহাবি নববিযুগ থেকে নিয়ে উমর (রাদি.)‘র যুগের প্রথম দুই বছর পর্যন্ত তিন তালাক দিলে এক তালাক হওয়ার উপর একমত ছিলেন। হয়তো ফতোয়া দিয়ে বা স্বীকার করে বা নীরব থেকে। এনমকি কেউ কেউ তিন তালাকে এক তালাক হওয়ার উপর সাহাবাদের ইজমায়ে কাদিম দাবি করে বসেছেন। (আওনুল মাউদ আলা শারহি আবি দাউদ, ৪/৩০৩)

লক্ষণীয় বিষয় হলো সাহাবাদের মধ্যে দীর্ঘ তিনযুগ থেকে চলে আসা একটি বিষয় কেবল উমর (রাদি.)‘র এক সিদ্ধান্তের কারণে আমূল পরিবর্তন হয়ে যাবে এবং তারা এর বিপরীত মতের উপর একমত হয়ে যাবেন তা মানা কখনই সম্ভব নয়।

দ্বিতীয় প্রমাণ: আকাবির সাহাবাদের মধ্য থেকে আলি ইবনে আব্বাস ইবনে মাসউদ, যুবাইর ইবনু আওয়াম, আব্দুর রাহমন ইবনে আউফ (রাদিাল্লাহু আনহুম) প্রমুখ তিন তালাকে এক তালাকে পতিত হওয়ার ফতোয়া দিতেন। যদিও তাদের কারো কারো থেকে বিপরীত মতও পাওয়া যায়। (আওনুল মাউদ আলা শারহি আবি দাউদ,৪/৩০৪/ সহিহু ফিকহিস সুন্নাহ,৩/২৮৫)

তৃতীয় প্রমাণ: আবু দাউদ শরিফে বর্ণিত ইবনে আব্বাস (রাদি.)র একটি উক্তিও এই কথাটিকে শক্তভাবে সমর্থন করে। তিনি বলেন,

‘যখন কোন ব্যক্তি একই শব্দে তুমি তিন তালাক বলে তাহলে সেই মহিলার উপর এক তালাক পতিত হবে।’ ( আবু দাউদ, ২১৯৯)

চতুর্থ প্রমাণ : ইবনে হিশাম বলেন আল মুগিস বলেছেন, তালাক দু’ভাগে বিভক্ত তালাকে সুন্নাহ ও তালাকে বিদআহ। …. তালাকে সুন্নহ পতিত হওয়ার ব্যপারে কোন এখতেলাফ নেই। কিন্তু তালাকে বিদআহ এক শব্দে যদি তিন দিয়ে দেয় তাহলে কয় তালাক পতিত হবে এ ব্যপারে আহলে ইলমের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। আলি (রাদি.) ও ইবনে মাসউদ (রাদি.) বলেন এক তালাক হবে। (ইগাসাতুল লাহফান,১/৩২৮)

পঞ্চম প্রমাণ : এক সাথে তিন তালাক দেওয়া (শরিয়ত প্রত্যাখাত) একটি হারাম কাজ যা আমরা পূর্বে আলোচনা করে এসেছি। আর একটি হারাম কাজ কাযর্কর হওয়ার উপর উম্মাহর শ্রেষ্ঠ মনিষীরা একমত হয়ে যাবেন তা কল্পনা করাও দুষ্কর। (আওনুল মাউদ আলা শারহি আবি দাউদ, ৪/ ৩০৩)

মোট কথা সাহাবাযুগে এসে উমর (রাদি.) এর একটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো একসাথে তিন তালাক কাযর্কর করার উপর। তাঁর এই সিদ্ধান্তকে বেশ থেকে এখতেলাফের উৎস বা ভিত্তি বলা যেতে পারে। এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে সে সময় ইজমা গড়ে ওঠেছিল এমন দাবি কেন আহলে ইলম করতে পারেন না।

তাবিইন ও আইম্মায়ে মুজতাহিদিনের যুগে একসাথে তিন তালাক

আমারা জেনে এসেছি আলোচ্য মাসআলাটিতে এখতেলাফের উৎস সৃষ্টি হয়েছিলো ওমর (রাদি.)‘র যুগে। অতপর উম্মাহর পর্বতী আলেমগণ যুগেযুগে একে কেন্দ্র করেই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে আসছেন। তাবেইন ও তাবয়ে তাবিইনের অনেক মুহাদ্দিস- ফকিহ এমনকি প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের ইমামগণের প্রসিদ্ধ মত তিন তালাকে তিন তালাক পতিত হওয়ার পক্ষে হলেও উম্মাহর বিরাট এক জামাত মুহাদ্দিস ইমাম চার মাযহাবের অনেক মুহাক্কিক আলেম তিন তালাকে এক তালাক পতিত হওয়ার পক্ষে মতামত দিয়ে আসছেন। নিম্নে এমন কয়েকটি উপমা পেশ করা হলো।

  • এক: আব্দুর রাজ্জাক বর্ণনা করেন প্রসিদ্ধ তাবিই তাউস তালাক ও ইদ্দতের শরয়ি পন্থা বহির্ভূত অবস্থায় তালাক পতিত হয় বলে মনে করতেন না। ( মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, ১০৯২৫)
  • দুই : ইবনু আবি শাইবা বলেন তাউস আতা ইবনু আবি রিবাহ ও জাবের ইবনু জায়েদ তারা প্রত্যেকেই বলতেন যদি কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে সহবাসের পূর্বে তিন তালাক দিয়ে দেয় তাহলে সেই স্ত্রীর উপর এক তালাক পতিত হবে। (মুসান্নাফে ইবনু আবি শাইবা, ১৮১৭৯)
  • তিন : ইসহাক ইবনে রাহওয়াই বলেন কুমারী মেয়েকে তিন তালাক দিলে এক তালাক পতিত হবে। ( ইগাসুতুল লাহফান,১/৩২৪)
  • চার : বিশিষ্ট তাবিই হাসান বসরি দীর্ঘদিন পর্যন্ত তিন তালাকে তিন তালাক পতিত হবে বলে ফতোয়া দিতেন কিন্তু কাতাদা হুমাইদ ও ইউনুস বলেন হাসান বসরি তার জীনের শেষ দিকে এই মাসআলা থেকে রুজু করে ( তিন তালাক দিলে) এক তালাকে বায়েনাহ পতিত হবে বলে ফতোয়া দিতেন। ( ইগাসাতুল লাহফান, ১ /৩২৫)
    কাতাদা বলেন আমি হাসান বসরিকে প্রশ্ন করলাম এমন ব্যক্তি সম্পর্কে যে তার কুমারী স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছে। তখন হাসান বললেন তিন পর্যন্ত হবে। এটাই তিনি দীর্ঘদিন ফতোয়া দিয়েছেন। অতপর তিনি তা থেকে রুজু করেন এবং বলেন এক তালাকই তাকে বিচ্ছেদ করে দিবে। এটাই তিনি তাঁর পরবর্তী জীবনভর বলেছেন। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, ১১০৬৭)
  • পাঁচ : তিন তালাকে এক তালাক হবে এটা ইমাম মালিক (রাহ)‘র একটি অভিমত। এই মতটি ইমাম মালিক (রাহ.) থেকে তিলমিসানিসহ এক জামাত মালিকি মাযহাবের অনুসারী বর্ণনা করেছেন। ( ইগাসাতুল লাহফান,১/৩২৬)
  • ছয় : ইবনে হিশাম বলেন আল মুগিস বলেছেন, তালাক দু’ভাগে বিভক্ত তালাকে সুন্নাহ ও তালাকে বিদআহ। …. তালাকে সুন্নহ পতিত হওয়ার ব্যপারে কোন এখতেলাফ নেই। কিন্তু তালাকে বিদআহ এক শব্দে যদি তিন দিয়ে দেয় তাহলে কয় তালাক পতিত হবে এ ব্যপারে আহলে ইলমের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। আলি (রাদি.) ও ইবনে মাসউদ (রাদি.) বলেন এক তালাক হবে। (ইগাসাতুল লাহফান,১/৩২৮)
    আরো বেশকিছু আছার রয়েছে যেথায় তিন তালাকে এক তালাক হবে এটা বিভিন্ন তাবেই ও মুহাদ্দিসের মাযহাব বলে উল্লেখ করেছেন। যা আলোচনা লম্বা হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা উল্লেক করছি না।

একসাথে তিন তালাক সম্পর্কিদ দালায়িল ও পর্যালোচনা

প্রথম দলিল

ইমাম বুখারি (রাহ.) তাঁর কিতাবে ‘যারা তিন তালাকের অনুমতি দেন’ নামক বাবের অধীনে পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার দুইশত উনত্রিশ নাম্বার আয়াত ‘(রাজয়ি) তালাক দুই বার দেওয়া যাবে। অতপর সে চাইলে উত্তম পন্থায় স্ত্রীকে রাখবে অথবা ন্যায়সঙ্গত ভাবে ছেড়ে দিবে।’ এনেছেন।

এখান থেকে অনেকে ধারণা করে বসেছেন ইমাম বুখারি (রাহ.) এই আয়াতটি একসাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাক পতিত হয়ে যাওয়ার দলিল হিসেবে এনেছেন। কিন্তু হাফিজ ইবনে হাজার (রাহ.) বলেন এই আয়াত দিয়ে আলোচ্য মাসআলাটির উপর দলিল প্রয়োগ করা একটি জটিল ব্যপার মনে হচ্ছে আমার কাছে। তার’চেয়ে বরং যারা এই আয়াতটি দিয়ে তিন তালাকে এক তালাক পতিত হওয়ার উপর দলিল দেন তাদের রদ করা হয়েছে বলাটা আমি মনে করি শক্তিশালী হবে। যেহেতু আয়াতের বাহ্যিক বিবরণ বলছে শরিয়ত স্বীকৃত তালাক একসাথে তিন তালাক দেওয়া নয় বরং উল্লেখিত ধারাবহিকতা বজায় রেখে তালাক দেওয়াটাই শরিয়তের কাছে গ্রহণযোগ্য তালাক।

তাই ইমাম বুখারি এই আয়াত এনে এদিকে ইঙ্গিত করেছেন যে, যদিও উক্ত আয়াতে তালাকের শরিয়ত স্বীকৃত পন্থার কথা বলা হয়েছে কিন্তু তার বহির্ভূত পন্থায় একসাথে তিন তালাক দিলে সেটা যে কাযর্কর হবে না, এই কথার উপর আয়াতটি দলিল হচ্ছেনা। কেননা আয়াতের সিয়াক – সাবাকে ( পর্ব ও পরে ) এমন কিছুই নেই যা তাদের দাবিকে সমর্থন করে।

অতপর হাফিজ (রাহ) এই আয়াতর মাধ্যমে আল্লামা কিরমানি (রাহ) পেশকৃত দলিলের জবাব দেন। কিরমানি বলেন উক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন ‘তালাক দুইবার দেওয়া যাবে।’ এই কথাটি দুই তালাক একত্রে কার্যকর হওয়ার উপর দলালত করছে। কাজেই একসাথে দুই তালাক যেহেতু বৈধ হচ্ছে তাই একসাথে তিন তালাকও বৈধ হবে।

হাফিজ (রাহ.) বলেন কিরমানির এই কিয়াসটি কিয়াস মায়াল ফারিক হয়ে গেছে। কেননা দিই তালাক একত্র করা তিন তালাক – যা বায়েনায়ে কুবরা – কে লাজিম করে না। যেহেতু দুই তালাকের পর রাজয়াতের সুযোগ থাকে অথচ তিন তালাকের পর সেই সুযোগ আর থাকে না। (ফাতহুল বারি,৯/৩১৭)

সুতরাং আমরা আয়াতটিকে তিন তালাকে তিন তালাক পতিত হবে বা এক তালাক পতিত হবে কোন পক্ষেরই দলিল বানাতে পারছিনা। যেহেতু আয়াতটি সুস্পষ্টভাবে কোন পক্ষেরই দলিল হচ্ছে না।

দ্বিতীয় দলিল

ইবনে আব্বাস (রাদি.) বলেন রাসুল (সা.) আবু বকর( রাদি.) ও উমর (রাদি.)‘র শাসনকালের প্রথম দুই বছর পর্যন্ত তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হতো। অতপর উমর (রাদি.) বললেন মানুষ এমন একটি বিষয়ে বাড়াবাড়ি করছে যার মধ্যে তাদের জন্য ছাড় ছিলো। যদি আমরা বিষয়টি আইনের আওতায় নিয়ে আসি ( তাহলে মানুষ তিন তালাক দেওয়ার পর এক তালাক পতিত হওয়ার অবকাশ থাকার কারণে শরিয়া বহির্ভূত পন্থায় যেভাবে রাতারাতি জড়িয়ে পড়ছে তা থেকে বিরত থাকতে পারে)। তাই তিনি তিন তালাক দিলে তিন তালাকই কাযর্কর হবে মর্মে আইন করলেন। (মুসলিম, ৩৭৪৬)

এই হাদিসটির প্রথম অংশ স্পষ্টভাবে দলিল হচ্ছে তিন তালাকে এক তালাক পতিত হওয়ার উপর। কিন্তু যারা তিন তালাকে তিন তালাক পতিত হওয়ার মতামত দেন তারা হাদিসটির বিভিন্ন জাবাব দিয়ে মুক্তি খুঁজেন। এমন কিছু জবাব ও তার প্রতিউত্তর নিম্নে দেওয়া হলো।

এক : রাসূল (সা.)‘র যুগে মূলত তিন তালাক দেওয়া হতো না বরং এক তালাকই দেওয়া হতো আর এই এক তালাককে দৃঢ় করার জন্য আরো দুবার তালাক শব্দ উচ্চারণ করা হতো। কিন্তু উমর (রাদি.)‘র যুগে যেহেতু মানুষের মধ্যে আল্লাহ ভীতি কমে আসে তাই আশঙ্কা দেখা দেয় কেউ হয়তো বাস্তবে তিন তালক দিয়ে বলবে সে এক তালাক দিয়েছে। তাই তিনি এই পথ বন্ধ করতে গিয়ে বলেছেন তিনবার তালাক শব্দ উচ্চারণ করলে তিন তালাতই গণ্য করা হবে।

প্রতিউত্তর : আল্লাম শাওকানি বলেন একথা সর্বস্বীকৃত যে যদি কেউ এমন শব্দ উচ্চারণ করে, যা তার কথাকে দূঢ় করার অবকাশ রাখে এবং সে দাবি করে এই শব্দের মাধ্যমে তার কথাকে দূঢ় করারই নিয়ত করেছে তাহলে তার দাবিকে গ্রহণ করা হবে। যদিও সে শেষ জামানায় এমন করুক না কেন। সুতরাং কীভাবে এই বিষয়টিকে খাইরুল কুরুন বা নববি ও সাহাবাযুগের সাথে নির্দিষ্ট করে দিয়ে পর্বতীযুগে এমন অবকাশ রহিত করে দেওয়া হবে? আর যদি সে এমন শব্দ উচ্চারণ করে, যা তাকিদের অবকাশ রাখে না তাহলে তার দাবিকে কোন যুগেই গ্রহণ করা যাবে না। (নাইলুল আওতার, ৬/৬২২)

দুই : ইমাম আহমদ (রাহ.) ইবনে আব্বাসের ছাত্রদের মধ্য থেকে কেবল তাউস এই বর্ণনা করেছেন অথচ তাঁর অন্য ছাত্ররা এই বণর্নার মুখালিফ বর্ণনা করেছেন।

প্রতিউত্তর : যারা ইবনে আব্বাস থেকে তাউসের মুখালিফ বর্ণনা করেছেন তাঁরা কেবল ইবনে আব্বাসের নিজস্ব মতকে বর্ণনা করেছেন। আর তাউসের বর্ণনা হলো ইবনে আব্বাসের রেওয়াত। তাই উভয়ের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। (নাইলুল আওতার, ৬/৬২২)

তিন : তিন তালাকে এক তালাক হওয়ার বর্ণনাটি সহবাস করা হয়নি এমন স্ত্রীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। আবু দাউদ শরিফে ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত একটি হাদিস একাথাকেই সমর্থন করে।

প্রতিউত্তর : একটি বর্ণনায় গায়রে মাদখুল বিহা (সহবাস হয়নি এমন মহিলা) উল্লেখ্য থাকার কারণে অন্য সহিহ হাদিসের ব্যপকতাকে সীমাবদ্ধ করা যাবে না। তাছাড়া আবু দাউদের হাদিসটি দূর্বলও (জাইফ) বটে। (আওনুল মাউদ আলা শারহি আবি দাউদ,৪/৩০৩)

এভাবে আরো কিছু উত্তর দেওয়া হয় যার সম্পর্কে আল্লামা শাওকানি বলেন যারা তিন তলাকে তিন তালাক পতিত হওয়ার পক্ষে মতামত দেন তারা ইবনে আব্বাস (রাদি.) হাদিসটির বিভিন্ন জবাব দেন। কিন্তু তাদের এসব জবাব কোনটিই বাড়াবাড়ি থেকে মুক্ত নয়। অথচ সত্যই হচ্ছে গ্রহণ করার অধিক উপযুক্ত। তাদের এমন কাজ যদি আসলাফের মাযহার রক্ষার প্রেরণা থেকে হয়, তাহলে তা প্রতিষ্ঠিত সুন্নতের উপর নূন্যতম প্রভাব ফেলতে পারে না। আর তা যদি হয় উমর (রাদি.) কর্তৃত ফতোয়া জারি করার কারণে, তাহলে এমন কোন মুসলিম আছে, যে একজন সাহাবির কথাকে রাসূলের কথার উপর গুরুত্ব দিয়ে নিজের জ্ঞান ও বিবেককে নিরাপদ মনে করতে পারে? (নাইলুল আওতার, ৬/ ৬২৩)

উমর (রা.) একসাথে তিন তালাককে তিন তালাক কার্যকর করার বৈধতা

নোট: এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায় রাসূল (সা.) যখন তিন তালাককে এক তালাক কার্যকর করতেন তাহলে উমর (রাদি.) কীভাবে তিন তালাকে তিন তালাক কাযর্কর করার মতো দুঃসাহস দেখালেন?

এই প্রশ্নের উত্তর বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে এখানে উমর (রাদি.) কি কোন হারামকে হালালা করেছেন বা কোন হালালকে হারাম করেছেন? মোটেও না। বরাং তিনি তাঁর যুগে মানুষ যে ভাবে শরিয়া নিষিদ্ধ তালাক পন্থায় জড়িয়ে পড়ছিলো তা থেকে মানুষকে বিরত রাখার জন্য ভয় দেখানো ও শাস্তি হিসেবে এই আইন করেছিলেন।

আর একজন আমিরুল মুমিনিন হিসেব মানুষের কল্যাণার্থে তিনি তা করতেই পারেন। যেহেতু যুগ ও প্রজন্মের পরিবর্তেনের কারণে কিছু আইন ও শাস্তির বিধান পরিবর্তন করার দায়িত্ব আমিরুল মুমিনেরই হয়ে থাকে। যেমন মদ পানের শাস্তি আশি বেত্রাঘাতের পাশাপাশি মাথামুণ্ডণ করা বা কিছু দিনের জন্য দেশান্তর করে দেওয়ার অধিকার খলিফার থাকে। আর তাবুক যুদ্ধে তিনজন সাহাবির অংশ গ্রহণ না করার ফলে স্ত্রীদের থেকে দূরে থাকার যে নির্দেশ রাসূল (সা.) দিয়েছিলেন তা এই প্রকারেরই ছিলো। (মাজমুউ ফাতাওয়া শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া,৩৩/১৬)

তৃতীয় দলিল

ইমাম আহমদ (রাহ.) তাঁর মুসনাদে বর্ণনা করেন ইবনে আব্বাস (রাদি.) বলেন, রুকানা ইবনে আবদে ইয়াজিদ তাঁর স্ত্রীকে একই মজলিসে তিন তালাক দিয়ে দিলেন। অতপর তিনি (সেই স্ত্রীকে রাখার আগ্রহে) খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তখন রাসূল (সা.) রুকানাকে বললেন তুমি কীভাবে তাকে তালাক দিয়েছো? রুকানা বললেন একই মজলিসে তিন তালাক দিয়ে ফেলেছি। রাসূল (সা.) বললেন এটা কেবল এক তালাক হবে। তুমি চাইলে তাকে রাজয়াত করে নাও। অতপর রুকানা তাকে রাজয়াত করে নেন। (হাদিসটি বণর্না করেছেন ইমাম আহমদ ও আবু ইয়ালা এবং মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের সূত্রেকে সহিহ বলেছে)

এই হাদিসটি কোন ধরণের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়াই একসাথে তিন তালাক দিলে এক তালাক পতিত হওয়ার উপর দলিল হচ্ছে। কাজেই হাদিসটিকে প্রত্যাখ্যান করে ভিন্নমত গ্রহণ করা কখনই নিরাপদ নয়। তবুও যারা তিন তালাক পতিত হওয়ার পক্ষে মতামত দেন তারা হাদিসটির উপর কয়েকটি প্রশ্ন উত্তাপন করেন। সেই প্রশ্ন ও তার জবাব আমরা নিম্নে আলোচনা করছি।

একসাথে তিন তালাকে দিলে এক তালাক হওয়ার দলিলে উপর প্রশ্ন ও উত্তর

প্রশ্ন এক: মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ও তাঁর শায়খের সেকাহ সম্পর্কে ইখতেলাফ রয়েছে।

উত্তর: যারা মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাককে মুখতালাফ ফিহি রাবি বলে হাদিসটিকে অগ্রহণযোগ্য বলছেন তারাই হুবহু সনদের অনেক হাদিসকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেন। এমন একটি হাদিস হলো রাসূল (সা.) তাঁর মেয়ে জয়নাবকে প্রথম বিবহি বহাল রেখেই আব্লু আস ইবনুর রাবির কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় কথা হলো প্রত্যেক মুখতালাফ ফিহি রাবি-ই অগ্রহণযোগ্য নয়।

প্রশ্ন দুই: এই হাদিসটি খোদ তার রাবি ইবনে আব্বাসের ফতোয়ার বিপরীত। তাই এটা বলা যাবে না যে ইবনে আব্বাসের কাছে এই হাদিস থাকার পরও তিনি হাদিসটি গ্রহণ না করে নিজের মনমত ফতোয়া দিয়ে ফেলেছেন। বরং অবশ্যই তাঁর কাছে এমন কোন দলিল ছিলো যে দলিলকে হাদিসের উপর প্রধান্য দিয়ে তিন তালাক পতিত হওয়া ফতোয়া দিয়েছেন।

উত্তর: রাবির রেওয়াত ও ফতোয়ার মধ্য এতেলাফ দেখা দিলে রেওয়াতকেই গ্রহণ করা হয়। তাছাড়া প্রধান্যদানকরী কোন দলিলের সম্ভাবনার উপর ভিত্তি করে একটি মরফু হাদিসকে ছেড়ে দেওয়া আহলে ইলিমের কাজ নয়।

প্রশ্ন তিন : এটি একটি (শাজ) অখ্যাত মাযহাব।

উত্তর : এটি অখ্যাত মাযহাব কথাটি ঠিক নয়। কেননা এই মাযহাবটি ইবনুল মুগিস তার ওসাইক নামক গ্রন্থে ইবনে আব্বাস, ইবনে মাসউদ, আব্দুর রাহমন ইবনে আউফ ও যুবাইর (রাদি.) সহ অনেক সাহবা থেকে বর্ণনা করেছেন। তেমনিভাবে শায়খ আনাজি এই মতটিকে কুরতোবার এক জামাত আলেম থেকে বণর্না করছেন। যেমন মুহাম্মাদ ইবনে তাকি ইবনে মাখলাদ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুস সালাম প্রমুখ। ইবনুল মুনজির এই মতটিকে নকল করেছেন ইবনে আব্বাস (রাদি.) ছাত্র আতা – তাউস আমর ইবনে দিনার প্রমুখ থেকে (ফাতহুল বারি, ৯/৩১৪)

এমনিভাবে মুতাআখ্খিরিনের মধ্য থেকে অনেক মুহাক্কিক ইমাম এই মতটিকে গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ইমাম ইবনুল কাইয়্যুম প্রমুখ।

প্রশ্ন চার : আবু দাউদ রুকানার হাদিসটিকে তালাকে ‘বাত্তা’ বা কেনাই তালাক ছিলো বলে উল্লেখ করেছেন।

উত্তর : হাফিজ ইবনুল কাইয়্যুম বলেন আবু দাউদ ‘বাত্তা’র হাদিসকে ইবনে জুরাইজের হাদিসের উপর প্রধান্য দিয়েছেন। কেননা তিনি ইবনে জুরাইজের হাদিসকে মাজহুল সূত্রে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আবু দাউদ সেই হাদিসটি বর্ণনা করেননি যা ইমাম আহমদ তাঁর মসনদে ইবনে ইসহাকের সূত্রে রুকানা থেকে বর্ণনা করেছেন। অথচ আবু দাউদের বর্ণিত হাদিস ও আহমদের বর্ণিত হাদিসের মধ্য থেকে আহমদের হাদিসটি অধিক বিশুদ্ধ হওয়ার ব্যপারে কোন সংশয় নেই। সে হিসেবে ইবনে জুরাইজের হাদিসটি আহমদের বর্ণনিত হাদিসটির শাহিদ ও শক্তিমত্তা বৃদ্ধিকারী হচ্ছে। অতপর ইবনে আব্বাস থেকে আবুস সাহবার বর্ণিত হাদিসকে ইবনে ইসহাক ও ইবনে জুরাইজের হাদিসের সাথে মিলালে তায়াদ্দুদে তুরুক হয়ে যাচ্ছে যা অবশ্যই ‘বাত্তা’ হাদিস থেকে অধিক শক্তিশালী। ( আওনুল মাউদ আলা শারহি আবি দাউদ, ৪/৩০৫)

চতুর্থ দলিল

আব্দুর রাজ্জাক উবাদা ইবনুস সামিত (রাদি.) থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেন। উবাদা ইবনুস সামিত (রাদি.) বলেন আমার দাদা তাঁর এক স্ত্রীকে এক হজার তালাক দিয়ে ফেলেন। অতপর রাসূল (সা.)‘র কাছে গিয়ে এই তালাকের বিধান জানতে চাইলে রাসূল (সা.) বলেন তোমার দাদা আল্লাহকে ভয় করেনি। সুতরাং তিনটি তালাক তার জন্য কাযর্কর হয়ে যাবে আর বাকি নয়শত সাতানব্বইটি তালাক সীমালঙ্ঘন ও অবিচার হিসেবে বিবেচিত হবে। আল্লাহ চাইলে তাকে শাস্তি দেবেন অথবা ক্ষমা করবেন। (আব্দুর রাজ্জাক,১১৩৩৯)

আল্লামা শাওকানি (রাহ.) বলেন উক্ত হাদিসের রাবিদের মধ্যে ইয়াহইয়া ইবনে আলা নামে একজন রাবি রয়েছেন যিনি জইফ রাবিদের অন্তর্ভুক্ত। আর উবাইদুল্লাহ নামে আরেক জন রাবি অগ্রহণযোগ্য। তাছাড়া ইবরাহিম ইবনে উবাইদুল্লাহ নামে আরেক জন মাজহুল রাবি রয়েছেন। সুতরাং এই হাদিসটি কীভাবে দলিল হতে পারে? (নাইলুল আওতার, ৬/৬২১)এটি একটি বাতিল হাদিস ( সহিহু ফিকহিস সুন্নাহ, ৩/ ২৮২)

পঞ্চম দলিল

উমাইর আল আজলানি ও তাঁর স্ত্রীর লিয়ানের ঘটনার বিবরণ দিয়ে সাহল ইবনে সায়াদ থেকে বুখারি শরিফে বর্ণনিত হাদিস। সেই ঘটনায় সাহল বলেন, অতপর তাঁরা স্বামী-স্ত্রী উভয়ে লিয়ান করেন। আমি অন্যান্য মানুষের সাথে রাসূল (সা.)‘র কাছেই ছিলাম। অতপর যখন তারা লিয়ান কার্য শেষে করে নেয় তখন উমায়ের বলল, হে রাসূলাল্লাহ! যদি আমি তাকে রেখে দেই তাহলে আমি তার উপরে মিথ্যা বলেছি সাব্যস্ত হয়ে যাব। এরপর উমায়ের রাসূল (সা.) নির্দেশ দেওয়ার আগেই তাকে তিন তালাক দিয়ে দেয়। ইবনে শিহাব বলেন এটাই ছিলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে লিয়ান বিধানের প্রথম প্রয়োগ। ( বুখারি, ৫২৫৯)

এই ঘটনায় একসাথে তিন তালাক পতিত হওয়াকে রাসূল (সা.) অস্বীকার করেননি। যদি একসাথে তিন তালাক পতিত না হওয়ারই হতো তাহলে অবশ্যই রাসূল (সা.) উমাইরের তালাককে অস্বীকার করতেন।
প্রতিউত্তর : এই হাদিসটি কিছুতেই আলোচ্য মাসআলায় তিন তালাক একসাথে পতিত হওয়ার পক্ষে দলিল হচ্ছে না। কেননা লিয়ানের পর উক্ত স্ত্রী স্বামীর জন্য চিরতরে হারাম হয়ে যায়। সুতরাং উমায়েরের স্ত্রী যেহেতু লিয়ানের মাধ্যমে হারাম হয়ে গেছে তাই এখানে তালাকের কোনই ভূমিকা নেই। ( সহিহু ফিকহিস সুন্নাহ, ৩/ ২৮১)

আর রাসূল (সা.) এই ঘটনায় একসাথে তিন তালাককে অস্বীকার না করাটা এই প্রকার তালাক পতিত হওয়ার পক্ষে দলিল হচ্ছে না। যেহেতু এখানে লিয়ানের কারণে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছিলো তাই এটা অস্বীকার করার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু যেখানে লিয়ান ছিলো না সেখানে ঠিকই তিনি এই প্রকারের তালাককে অস্বীকার করেছেন। যেমন নাসাঈ ও মুসনাদে আহমদের দুটি হাদিসে আমরা এর প্রমাণ পেয়েছি।

ষষ্ট দলিল

আয়েশা (রাদি.) থেকে বুখারি শরিফে বর্ণনিত হাদিস। এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তিন তালাক দেওয়ার পর এই মহিলা অন্যত্র বিবাহ করেন। অতপর দ্বিতীয় স্বামীও তাকে তালাক দিয়ে দেয়। তখন এই মহিলা রাসূল (সা.)কে জিজ্ঞেস করলো সে কি প্রথম স্বামীর জন্য হালাল হবে? রাসূল (সা.) বললেন, না! যতক্ষণ না দ্বিতীয় স্বামী তার মধু চুষবে যেভাবে প্রথম স্বামী চুষেছে। (বুখারি, ৫২৬১)

সপ্তম দলিল

ফাতেমা বিনতে কায়সকে তার স্বামী আবু হাফস ইবনে মুগিরা তিন তালাক দিয়ে দিয়ে ইয়েমান চলে যায়। অতপর ফাতেমা বিনতে কায়স তার স্বামী থেকে ভরণ পোষণ পাবে কি না জানতে চাইলে রাসূল সা. বলেন, তার জন্য ভরণ পোষণ কিছুই নেই। তবে সে ইদ্দত পারন করবে। ( মুসলিম,১৪৮০)
এই দুটি হাদিসে রাসূল (সা.) তিন তালাককে অস্বীকার করেননি!!!

প্রতিউত্তর : দুটি হাদিসে মহিলাকে একসাথে তিন তালাক দেওয়া হয়েছিলো বলে উল্লেখ নেই। বরং তাকে তৃতীয় তালাক দেওয়ার পূর্বেই দুই তালাক দেওয়া ছিলো। যেমন মুসলিমের একটি বর্ণনায় এসেছে ‘(ফাতেমা বিনতে কায়সকে তার স্বামী তালাক দিয়ে ইয়ামান চলে যায়) অতপর সেখান থেকে অবশিষ্ট তালাক দিয়ে দূত পাঠালো।’ তাছাড়া সাহাবায়ে কেরাম তালাক বলতে শরয়ি তালাকই বুঝতেন। তাই তাদের মধ্যকার তালাক সংক্রান্ত মতলক আলোচনা থেকে শরয়ি তালাকই গ্রহণ করতে হবে। (সহিহু ফিকহিস সুন্নাহ,৩/২৮১)

অষ্টম দলিল

রুকানা ইবনে ইয়াজিদ তাঁর স্ত্রীকে তালাকে বাত্তা দেওয়ার পর রাসূল (সা.) কে বলেছিলেন তিনি কেবল এক তালাকের নিয়ত করেছেন। তখন রাসূল (সা.) আবার প্রশ্ন করেন তুমি কি সত্যই এক তালাকের নিয়ত করেছো? রুকানা উত্তরে বলেছিলেন! আল্লাহর কসম! আমি সত্যই এক তালাকের নিয়ত করেছি। অতপর রাসূল (সা.) এক তালাক হয়েছে বলে উক্ত স্ত্রীকে তাঁর কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। (তিরিমিজি,১১৭৭)

রাসূল (সা.) রুকানাকে কয় তালাকের নিয়ত করেছে এই প্রশ্ন করার অর্থই হলো যদি রুকানা একের অধীক তালাকের নিয়ত করতেন তাহলে সবগুলোই কর্যকর করে দিতেন।প্রতিউত্তর : এই হাদিসটি মুজতারাব বিশুদ্ধ নয়। ইমাম আহমদ ইমাম বুখারিসহ অনেকই এটাকে দূষযুক্ত হাদিস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। (সহিহু ফিকহিস সুন্নাহ, ৩/২৮২)

তাছাড়া রুকানার হাদিসের সব থেকে বিশুদ্ধ সনদটি মুসনাদে আহমদের বর্ণনায় এসেছে যা আমরা আলোচনা করে এসেছি। সেই বর্ণনায় এক মজলিসে তিন তালাকের কথা এসেছে। যাকে রাসূল (সা.) এক তালাক বলে গণ্য করেছিলেন। সুতরাং এই ইল্লতযুক্ত হাদিস দিয়ে আহমদের সহিহ হাদিসের মর্মকে ব্যাখা করা যাবে না।

এখানে আমরা আটটি হাদিস নিয়ে আলোচনা করলাম। এই মাআলাটির উপর দলিল হিসেবে আরো কিছু হাদিস ও আসার আনা হয় যা নিতান্ত দূর্বল বা আলোচ্য বিষয়ের দলিল হওয়ার উপর স্পষ্ট নয়। তাই আমরা সেগুলো উল্লেখ করছি না।

গ্রহণযোগ্য অভিমত

আমরা যে কয়েকটি হাদিস নিয়ে আলোচনা করেছি তার মধ্যে তাউসের সূত্রে মুসলিম শরিফে এবং মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের সূত্রে মুসনাদে আহমদে ইবনে আব্বাস (রাদি.) থেকে বর্ণনিত হাদিস দুটি আলোচ্য মাসআলাটির উপর সুস্পষ্ট দলিল হচ্ছে। আর এই হাদিস দুটির উপর যেসব প্রশ্ন উত্তাপিত হয় সেই প্রশ্নলো আদতে কতোটা শক্তিহীন তা পূর্বেকার আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। কিন্তু এর বিপরীত তিন তালাকে তিন তালাক পতিত হওয়ার দলিল হিসেবে যে হাদিসগুলো দলিল হিসেবে পেশ করা হয় তার মধ্যে কিছু হাদিস এমন রয়েছে যা আলোচ্য মাসআলার উপর সরিহ বা সুস্পষ্টভাবে দলালতই করে না। আবার কিছু হাদিস এমন, যা নিতান্ত জইফ হওয়ার দরুন ইবনে আব্বাসের দুটি হাদিসের বিপরীতে দাঁড় করানোই সম্ভব হচ্ছে না।

বাকি থাকে উমর (রাদি.) থেকে তিন তালাকে তিন তালাক কাযর্কর করার কথা। উমর (রাদি.) ছিলেন আমিরুল মুমিনিন। তিনি যদি রাষ্ট্রীয় হুকুম হিসেবে ফতোয়াটি জারি করেন তাহলে এটা ছিলো তাঁর একটি সিয়াসি সিদ্ধান্ত। সুতরাং এক যুগের সিয়াসি সিদ্ধান্ত অন্যযুগের জন্য প্রযোজ্য নয়। আর যদি বলা হয় এটা ছিলো তাঁর নিজস্ব মত তাহলে একজন সাহাবির নিজস্ব মত কীভাবে মরফু হাদিসের মোকাবেলায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে? অধিকন্তু তাঁর মতের বিপরীতে রয়েছে অনেক আকাবির সাহাবার অবস্থান।

তাছাড়া আমরা তালাক সম্পর্কে শরিয়তের অবস্থানের দিকে লক্ষ্য করলে একথা স্পষ্ট বুঝতে পারি শরিয়ত তালাক বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদকে খুবই অপচন্দের চোখে দেখে। শরিয়ত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে রাতারাতি বিচ্ছেদ ঘটুক তা কখনই চায় না। বরং দাম্পত্যকলহ একান্ত অসহ্য পর্যায়ে পৌঁছে গেলে কেবল তখন এ থেকে মুক্তির পন্থা হিসেবে তালাক ব্যবস্থাকে অনুমোদন দিয়েছে। আর দাম্পত্যকলহ অসহ্য পর্যায়ে পৌঁছেছে কি না সেটা বুঝা যাবে শরিয়ত নির্ধারিত পন্থায় যখন তালাক অস্তিত্বে আসবে। কেননা স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে যদি মার্জনীয় সমস্যা থাকে সেটা এক বা দুই তালাকের পর ইদ্দত চলাকালীন সময়ে সমাধান করে রাজয়াত করা সম্ভব। কিন্তু যদি সমস্যাটা অমার্জনীয় হয় তাহলে ইদ্দত চলে গেলেও সেটা আর সমাধান করা সম্ভব হবে না। আর যখন সমাধান সম্ভব হবে না তখনই প্রমাণ হবে দাম্পত্যকলহ ছিলো অসহ্য।

সুতরাং যদি তিন তালাক একসাথে কার্যকর করা হয় দেই তাহলে একদিকে রাতারাতি তালাক বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদেরর পথ খুলবে অন্যদিকে ইদ্দতে রাজয়াত করার সুযোগ না থাকার কারণে বুঝাই যাবে না তাদের সমস্যাটা আসলেই অসহ্য ছিলো কি না। এতে তালাক সম্পর্কে শরিয়তের অবস্থানকে খর্ব করা হবে। যা কিছুতেই কাম্য নয়।

বিশেষ করে আমাদের যুগে যখন একসাথে তিন তালাক দেওয়া একটি বহুল প্রচলিত ব্যপার হয়ে গেছে। অতপর অনেকেই ফতোয়ার তোয়াক্কা না করেই সেই স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা যদি দলিলের দিক দিলে অপেক্ষাকৃত দূর্বল ও শরিয়তের অবস্থানের বিপরিত মতকে গ্রহণ করে ফতোয়া দেই তাহলে কতো বনি আদম বিবাহের মতো একটি পবিত্র বন্ধনে থাকার পরও জিনা লিপ্ত আছে এবং তাদের সন্তান জারজ সন্তান হচ্ছে তার সঠিক হিসেব আল্লাহই ভালো জানেন।

نستعين الله من ذالك


শেয়ার করুন

Leave a Comment