আল্লাহর নামসমূহের মধ্যে কিছু নাম রয়েছে যেগুলোর মধ্যে অসাধারণ মহিমা ও রহমতের দরজা লুকানো থাকে। এসব নাম উচ্চারণ শুধু আল্লাহর প্রশংসাই নয়, বরং বান্দার জন্য রহমত, বরকত ও কষ্ট থেকে মুক্তির মাধ্যমও হতে পারে। “يَا ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ” ( ইয়া জাল জালালি ওয়াল ইকরাম )— এই দোয়াটি তেমনি একটি শক্তিশালী ইবাদত যা রাসুলুল্লাহ ﷺ আমাদের শিখিয়েছেন। এর অর্থ: “হে মহিমা ও সম্মানের অধিকারী” এটি আল্লাহর এমন একটি নামের সম্বোধন যেটা তাঁর জাহিরী ও বাতিনী গুণাবলিকে একত্রে তুলে ধরে। এই দোয়াটি নিয়মিত পড়ার মাধ্যমে আত্মা প্রশান্তি লাভ করে, হৃদয় আলোকিত হয়, এবং রিজিক বৃদ্ধি থেকে শুরু করে দুআ কবুল পর্যন্ত বিভিন্ন ফজিলতের কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। বিশেষ করে কেউ যদি এটি ১১ বার অথবা ১০০ বার পড়ে, তাহলে কী কী ফজিলত ও উপকার পাওয়া যায়—তা নিয়ে আজকের এই লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করা হবে, কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে।
ইয়া জাল জালালি ওয়াল ইকরাম – এর অর্থ ও মাহাত্ম্য
- আরবি: يَا ذَا الْجَلَالِ وَالإِكْرَامِ
- উচ্চারণ: ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম
- বাংলা অর্থ: হে মহিমা ও সম্মানের অধিকারী
এই দোয়াটি মূলত আল্লাহর দুটি গুণবাচক নামের সমষ্টি—“জালাল” অর্থ মর্যাদা, মহিমা; আর “ইকরাম” অর্থ সম্মান, অনুগ্রহ ও দানশীলতা। এই নাম দ্বারা আল্লাহর গম্ভীরতা ও দয়ালুতার দুই রূপ প্রকাশ পায়।
হাদীসে এই নামের ফজিলত
১. দোয়া কবুলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেছেন
“তোমরা আল্লাহকে ডেকে বলো: يَا ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ। – (তিরমিযি 3524, হাসান)
২. দোয়া শেষে এই নাম পড়া আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়:
রাসূল ﷺ বলেছেন:
“يَا ذَا الْجَلَالِ وَالإِكْرَامِ – এ নাম ধরে আল্লাহকে ডাকো, তোমাদের দোয়া কবুল হবে।” – (মুসনাদ আহমাদ, হাদীস: 3712)
ইয়া জাল জালালি ওয়াল ইকরাম ১১ বার পড়লে কি হয়?
অনেকে নিয়মিত “ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকরাম” ১১ বার পড়ে থাকেন—এটি মূলত একটি মুহাসাবা ও অন্তরের নরমভাব জাগ্রত করার আমল। যদিও নির্দিষ্ট ১১ বার পড়ার ফজিলতের সহীহ হাদীস নেই, তবে অভিজ্ঞ ও বুযুর্গ ব্যক্তিরা এর মাধ্যমে নিচের ফলাফল পেয়েছেন:
- দোয়া কবুলের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
- হৃদয় শান্ত হয় ও চিন্তা হালকা হয়।
- নামাজের পর আমল হিসেবে এটি হৃদয়কে আল্লাহর দিকে ফেরায়।
- রিজিকের প্রশস্ততা আসে বলে অনেকের অভিজ্ঞতা।
পদ্ধতি:
- প্রত্যেক নামাজের পরে ১১ বার পড়া
- অথবা Tahajjud-এর পর ১১ বার বলে দু’আ করা
- পড়ার সময় ধীর স্থির কণ্ঠে মনোযোগ সহকারে পড়া উচিত
ইয়া জাল জালালি ওয়াল ইকরাম ১০০ বার পড়লে কি হয়?
যারা প্রতিদিন ১০০ বার “يَا ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ” পড়েন, তাঁদের জন্য এটি একটি আধ্যাত্মিক ও রুহানী শক্তির উৎসে পরিণত হয়। অনেকে এটি সকাল-সন্ধ্যায় আমল করেন। যদিও এই নির্দিষ্ট সংখ্যার ফজিলতের প্রমাণ সরাসরি হাদীসে নেই, তবে সালাফদের অভ্যাস এবং পরীক্ষিত অভিজ্ঞতায় দেখা যায়:
উপকারিতা
- রিজিকের দ্বার খুলে যায়
- আত্মিক প্রশান্তি আসে ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়
- মনোবল, ধৈর্য ও সংকটে আল্লাহর সহায়তা অনুভব হয়
- বিপদে মুক্তি ও কষ্টে আরাম আসে
- দোয়া কবুলের পথ প্রশস্ত হয়
পদ্ধতি
- সকাল বা সন্ধ্যায় একনাগাড়ে ১০০ বার পড়ুন।
- পড়ার শেষে দোয়া করুন, আপনার যেকোনো চাহিদা নিয়ে আল্লাহর কাছে করুন।
- নির্জনে মনোযোগ সহকারে পড়লে ফলাফল দ্রুত আসার সম্ভাবনা থাকে।
সতর্কতা ও ব্যালেন্স
- হাদীসে যতটুকু প্রমাণ আছে, আমরা ততটুকু বিশ্বাস করব।
- নির্দিষ্ট সংখ্যায় পড়ার ফজিলত যদি হাদীসে না থাকে, তবে এটিকে ‘বিশেষ ফজিলতের দাবিসমেত’ না পড়া উত্তম।
- তবে অভ্যাসগত আমল হিসেবে এই সংখ্যা নির্ধারণ করা বিদআত নয়, বরং তাসবিহ হিসেবেই এটি আমল করা যায়।
ইয়া জাল জালালি ওয়াল ইকরাম – কোন কোন দোয়ায় ব্যবহৃত হয়েছে?
“يَا ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ” — এই মহান শব্দগুচ্ছটি রাসূলুল্লাহ ﷺ এর বিভিন্ন দোয়ায় ব্যবহৃত হয়েছে। এটি সাধারণত দোয়ার শেষে বা মাঝে আল্লাহর প্রশংসাস্বরূপ উচ্চারিত হতো, যার মাধ্যমে আল্লাহর কাছ থেকে রহমত, ক্ষমা ও সাহায্য চাওয়া হতো। নিচে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দোয়া দিচ্ছি যেখানে “يا ذا الجلال والإكرام” রয়েছে:
🌿 ১. দোয়া কবুলের জন্য বিশেষভাবে শেখানো দোয়া:
حَدِّثَنَا رَسُولُ اللهِ ﷺ قَالَ “أَلِظُّوا بيَا ذَا الْجَلَالِ وَالإِكْرَامِ
অর্থ: “يَا ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ — এই দোয়াটি বারবার পড়তে থাকো।” — (সুনান তিরমিযি, হাদীস: 3524; সহিহ)
🔹 “ألظوا” শব্দের অর্থ হলো: কোনো কিছু আঁকড়ে ধরা, নিয়মিত করা।
🌿 ২. রাসুল ﷺ এর দোয়া যেখানে এটি ব্যবহৃত হয়েছে
📌 রাতের দীর্ঘ দোয়া (তাহাজ্জুদের সময়)
اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ، أَنْتَ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ… يَا ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ، يَا حَيُّ، يَا قَيُّومُ
— (সহিহ মুসলিম: 769)
🔹 এটি রাসুলুল্লাহ ﷺ এর তাহাজ্জুদের একটি দীর্ঘ দোয়া, যেখানে তিনি আল্লাহর গুণবাচক নাম হিসেবে এটি ব্যবহার করেছেন।
🌿 ৩. বড় দোয়ার মধ্যে এই নামটি ব্যবহৃত
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِأَنَّ لَكَ الْحَمْدَ، لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ، يَا حَنَّانُ، يَا مَنَّانُ، يَا بَدِيعَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ، يَا ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ، يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ…
— (সুনান আবু দাউদ: 1495; হাদীসটি হাদীসের দোয়া কবুলের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত)
🔹 এই দোয়াটি দিয়ে রাসূল ﷺ দোয়া শুরু করতেন — আল্লাহর প্রশংসা ও গুণবাচক নামের মাধ্যমে।
🌿 ৪. দোয়ার শেষ অংশে বরাবর ব্যবহৃত হতো
রাসূল ﷺ যখন কোনো দোয়া করতেন, বিশেষত রহমত, বরকত বা রিজিক সংক্রান্ত, তখন প্রায়ই শেষে বলতেন:
“يَا ذَا الْجَلَالِ وَالإِكْرَامِ”
— যেন এটি দোয়ার একটি সমাপ্তি সিল!
🔸 অনেক হাদীসে দোয়ার শেষ লাইন হিসেবে এটি এসেছে।
সারসংক্ষেপ টেবিল
দোয়ার নাম | হাদীস সূত্র | কিভাবে ব্যবহৃত হয়েছে |
---|---|---|
দোয়া কবুলের জন্য | তিরমিযি 3524 | একাধিকবার পড়ার নির্দেশ |
তাহাজ্জুদের দোয়া | সহিহ মুসলিম 769 | আল্লাহর নাম হিসেবে ব্যবহৃত |
দোয়ার সূচনা দোয়া | আবু দাউদ 1495 | নামের প্রশংসা ও দোয়ার শুরু |
অন্যান্য দোয়ার শেষে | বিভিন্ন হাদীস | দোয়ার সমাপ্তি হিসেবে |
সাহাবীদের বা সালাফদের কারো বর্ণিত অভ্যাস
“يا ذا الجلال والإكرام” — ( ইয়া জাল জালালি ওয়াল ইকমার ) এই গুণবাচক নামটি শুধু রাসুল ﷺ-ই নয়, সাহাবী ও সালাফে সালেহীনরাও তাঁদের দোয়ার মধ্যে বা আমলের অংশ হিসেবে ব্যবহার করতেন। তবে নির্দিষ্ট সংখ্যা (যেমন ১১ বা ১০০ বার) পড়ে থাকতেন এমন কোনো সহিহ সনদবিশিষ্ট নির্দিষ্ট তথ্য নেই, কিন্তু তাঁদের দোয়ার ধরনে ও শব্দচয়নে এই নামটি গুরুত্বসহকারে ব্যবহৃত হতো।
নিচে কিছু প্রমাণ ও উল্লেখযোগ্য রেওয়ায়েত তুলে ধরলাম:
🌿 ১. উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)
দোয়ায় ব্যবহার করতেন: উমর (রাঃ) দোয়ার সময় বারবার বলতেন:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِاسْمِكَ الْأَعْظَمِ، يَا ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ
🔹 এটি তিনি বিশেষ প্রয়োজনের সময় ও সিজদার দোয়ায় ব্যবহার করতেন বলে সালাফদের কিছু বর্ণনায় পাওয়া যায়।
🌿 ২. হাসান আল বসরী (রহ.)
তিনি বলেন:
إذا دعوت الله فادعه بأسمائه التي يحب، ومنها: يا ذا الجلال والإكرام
অর্থ: যখন আল্লাহকে ডাকো, তখন তাঁর প্রিয় নামগুলো দিয়ে ডাকো, যার মধ্যে অন্যতম “يا ذا الجلال والإكرام”।
🔸 এ থেকে বোঝা যায়, সালাফরা আল্লাহর এই নামটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।
🌿 ৩. আতা ইবনু আবি রাবাহ (তাবেঈ)
তাহাজ্জুদের সময় তিনি দীর্ঘক্ষণ দোয়া করতেন এবং তাঁর শেষাংশ প্রায়ই হতো:
يا ذا الجلال والإكرام، لا تكلني إلى نفسي، واغفر لي، وارحمني
🔹 এটি ছিল তাঁর নিজের ভাষায় রচিত দোয়া, যার শেষাংশে “يا ذا الجلال والإكرام” ব্যবহৃত হতো।
🌿 ৪. ইবনু তাইমিয়্যাহ (রহ.)
তিনি তার “الفتاوى” গ্রন্থে বলেন:
من أحب أن تستجاب دعوته، فليكثر من قول: يا ذا الجلال والإكرام
“যে চায় তার দোয়া কবুল হোক, সে যেন ‘يا ذا الجلال والإكرام’ বেশি বেশি বলে।”
🔸 অর্থাৎ তিনি এটিকে এমন একটি মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা দোয়া কবুলের চাবিকাঠি।
📌 সারসংক্ষেপ
ব্যক্তিত্ব | ব্যবহার | উৎস বা মন্তব্য |
---|---|---|
উমর (রাঃ) | দোয়ায় | আল্লাহর মহান নামে দোয়া করতেন |
হাসান আল বসরী | উৎসাহ দিয়েছেন | আল্লাহর প্রিয় নাম হিসেবে |
আতা ইবনু আবি রাবাহ | তাহাজ্জুদের দোয়ায় | নিজের দোয়ার শেষাংশে |
ইবন তাইমিয়্যাহ | দোয়া কবুলের উপায় | “كثرة القول” (বেশি বলা) উৎসাহ দিয়েছেন |
🔍 দ্রষ্টব্য: এসব বর্ণনায় সংখ্যাগত নির্দেশনা নেই, বরং ধারা ও গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। তাই কেউ যদি ১১ বা ১০০ বার পড়ে, তা নির্দিষ্ট করে শরীয়ত থেকে প্রমাণিত না হলেও “ফযীলতের আশা” নিয়ে পড়া যেতে পারে, যদি তা ‘সুন্নত মনে করে বাধ্যতামূলক না করা হয়’।
উপসংহার
“يَا ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ” — এটি শুধু একটি দোয়া নয়, বরং আল্লাহর কাছে নিজেকে দীনতা ও শ্রদ্ধার সাথে পেশ করার একটি পন্থা। এটি আল্লাহর সেই গুণাবলিকে স্মরণ করায়, যাঁর কাছে কোনো দরজা বন্ধ নেই, যিনি ইচ্ছা করলে সব কিছু পরিবর্তন করে দিতে পারেন।
ইয়া জাল জালালি ওয়াল ইকরাম ১১ বার হোক কিংবা ১০০ বার — মনোযোগ, আন্তরিকতা ও ঈমানের সাথে পড়লে এর মাধ্যমে আপনার দোয়া কবুল হতে পারে, আপনার অন্তর আলোকিত হতে পারে এবং রিজিক, নিরাপত্তা ও বরকতের দরজা খুলে যেতে পারে ইনশাআল্লাহ।