ওজু ও গোসলের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করা হলেও বিশেষ ক্ষেত্রে তায়াম্মুম করাও বৈধ রয়েছে। তায়াম্মুম শব্দের অর্থ। শরীয়তের পরিভাষায় তায়াম্মুম কাকে বলে? এটি ওজু ও গোসলের মতো নামাজ এবং অন্যান্য ইবাদতের জন্য পবিত্রতার শর্ত পূরণ করে কিনা? এটি কুরআন ও সুন্নাহ আলোকে আমরা এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করছি।
তায়াম্মুম ( এর ভাষাগত ) অর্থ
তায়াম্মুম অর্থ হলো ইচ্ছা করা। বলা হয়,
تيممت فلانًا ويممته وتأممته وأممته، أي: قصدته
“তাইয়াম্মাতু ফুলানান, ওয়া ইয়াম্মাতুহু, ওয়া তা’আম্মামতুহু, ওয়া আম্মাতুহু” অর্থাৎ, আমি তার ইচ্ছা করেছি।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
{وَلاَ تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنفِقُونَ}
“তোমরা নিকৃষ্ট জিনিস দান করার ইচ্ছা করো না।” (সুরা বাকারা – ২৬৭)
তায়াম্মুম কাকে বলে? শরয়ি পরিভাষা
شرعًا: القصد إلى الصعيد (وجه الأرض) للتطهير لاستباحة ما يبيحه الوضوء والغسل
পবিত্রতা অর্জনের জন্য (পৃথিবীর পৃষ্ঠের) মাটি (ব্যবহারের) ইচ্ছা করা, যাতে ওজু ও গোসলের মাধ্যমে আদায় করা যায় এমন ইবাদাতগুলো বৈধ করা যায়।
তায়াম্মুমের বৈধতা
তায়াম্মুমের বৈধতা কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমার মাধ্যমে প্রমাণিত:
১. কুরআন থেকে:
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
{فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيدًا طَيِّبًا}
“যদি তোমরা পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করো।” ( সুরা মায়িদা : ৬)
২. সুন্নাহ থেকে:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
جعلت الأرض كلها لي ولأمتي مسجدًا وطهورًا، فأينما أدركت رجلاً من أمتي الصلاة، فعنده مسجده وعنده طهوره
“পুরো পৃথিবীকে আমার এবং আমার উম্মতের জন্য মসজিদ ও পবিত্রতার উপকরণ বানানো হয়েছে। তাই আমার উম্মতের যার সামনে সালাতের সময় আসবে, তার মসজিদ এবং তার পবিত্রতার উপায় তার সাথেই রয়েছে।” ( মুসনাদু আহমদ: ২/২২২)
আরেকটি হাদিসে এসেছে, ইমরান ইবনে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন:
একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাত আদায় করলেন, এরপর দেখলেন এক ব্যক্তি দূরে সরে দাঁড়িয়ে আছে এবং জামাতে অংশগ্রহণ করেনি।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন:
يا فلان، ما منعك ألا تصلي مع القوم؟
“হে অমুক, তোমাকে জামাতে সালাত আদায় থেকে কী বাধা দিয়েছে?”
সে বলল: “হে আল্লাহর রাসুল, আমি অপবিত্র অবস্থায় ছিলাম এবং আমার কাছে পানি ছিল না।” রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন:
«عليك بالصعيد فإنه يكفيك»
“তোমার জন্য মাটি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন ওয়াজিব, এটিই তোমার জন্য যথেষ্ট।”
পরে যখন পানি পাওয়া গেল, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে একটি পাত্রে পানি দিলেন এবং বললেন:
«اغتسل به»
“এটা দিয়ে গোসল করে নাও।” (সহিহ বুখারি:৩৪৮)
৩. ইজমা থেকে:
ইমাম ইবনে কুদামাহ বলেন:
«وأما الإجماع، فأجمعت الأمة على جواز التيمم في الجملة»
“পুরো উম্মত তায়াম্মুমের বৈধতা সম্পর্কে একমত হয়েছেন।” (আল মুগনি : ১/১৪৮)
তায়াম্মুম কি কি ক্ষেত্রে যথেষ্ট হয়?
পানি না পাওয়া গেলে বা পানি ব্যবহার অসম্ভব হয়ে পড়লে, তখন পানির বিকল্প হবে মাটি আর অজু ও গোসলের বিকল্প হবে তায়াম্মুম।
ইমাম নববী বলেছেন: “এটি আমাদের মাজহাব এবং সাহাবি, তাবেঈন ও পরবর্তী সমস্ত আলেমের মত। তবে উমর ইবনুল খাত্তাব, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ এবং তাবেঈ ইবরাহিম আন-নাখাঈ তা (অর্থাৎ, বড় অপবিত্রতা দূর করতে বা ফরজ গোসলের বিকল্প হিসাবে তায়াম্মুম) অনুমোদন করেননি। তবে ইবনে সাব্বাগ ও অন্যদের মতে, উমর এবং আব্দুল্লাহ পরে তাদের মত থেকে ফিরে এসেছিলেন।”
আমাদের মাজহাব এবং অধিকাংশ আলেমগণের দলিল হলো আল্লাহ তায়ালার বাণী:
{إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلاةِ فاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ}
“যখন তোমরা নামাজে দাঁড়াবে, তখন তোমাদের মুখমণ্ডল ধুয়ে নাও”
{وَإِن كُنتُمْ جُنُباً فَاطَّهَّرُوا}
“আর যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তবে পবিত্র হয়ে নাও।”
এরপর আল্লাহ বলেন:
{فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا}
“যদি তোমরা পানি না পাও, তবে তায়াম্মুম করো।”
এই আয়াতটি পবিত্রতা অর্জন করা এবং গোসল উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ( আল মাজমুউ: ২/২৪০)
বড় অপবিত্রতা দূর করার ক্ষেত্রে তায়াম্মুম বৈধ হওয়ার আরেকটি দলিল হলো আল্লাহর এই বাণী:
{أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مَّنكُم مِّنَ الْغَائِطِ أَوْ لاَمَسْتُمُ النِّسَاءَ فَلَمْ تَجِدُوا مَاءً فَتَيَمَّمُوا صَعِيداً طَيِّباً}
“অথবা তোমাদের কেউ যদি প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে আসে বা তোমরা নারীদের সঙ্গে মিলিত হও এবং পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করো।” ( সুরা নিসা: ৪৩)
এই আয়াতে “নারীদের স্পর্শ করা” বলতে কিছু আলেমের মতে সহবাস বোঝানো হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা)।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এমন বর্ণনাও প্রমাণিত হয়েছে, যা জানায় যে তায়াম্মুম গোসলের বিকল্প হতে পারে। ইমরান ইবনে হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর পূর্বে উল্লেখিত হাদিস। তাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে, যিনি অপবিত্র ছিলেন, বলেছিলেন:
«عليك بالصعيد فإنه يكفيك»
“তোমার জন্য মাটি যথেষ্ট; এটি তোমার জন্য পবিত্রতার বিকল্প হবে।” (সহিহ বুখারি:৩৪৮)
২. আম্মার ইবনে ইয়াসিরের হাদিস:
তিনি বলেন, “আমি অপবিত্র হয়ে গিয়েছিলাম এবং মাটিতে গড়াগড়ি করেছিলাম। পরে আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ কথা জানালাম। তিনি বললেন:
إنما كان يكفيك هكذا: وضرب يديه على الأرض، ومسح وجهه وكفيه
‘তোমার জন্য তো এটা যথেষ্ট ছিল।’ এরপর তিনি তাঁর হাত দু’টি মাটিতে আঘাত করলেন এবং মুখমণ্ডল ও হাতের তালু মুছলেন।” ( আল-মুহাল্লা : ২/১৫৮)
মৃত ব্যক্তির তায়াম্মুম কাকে বলে?
মৃত ব্যক্তির তায়াম্মুম মানে হল – কোনো মানুষ মারা গেলে তাকে গোসল করানো জীবিতদের উপর ফরজ। কিন্তু সে সময় যদি পানি পাওয়া না যায়, তাহলে মৃত ব্যক্তিকে তায়াম্মুম করানোর ব্যাপারটা জীবিত ব্যক্তির মতোই, সেটা তখন বৈধ। পানি অনুপস্থিত থাকলে মাটি পবিত্রতার মাধ্যম হিসেবে যথেষ্ট, এবং এটি প্রতিটি ফরজ পবিত্রতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।