ইসলামে দরুদ শরীফ পাঠ করা এক বিশেষ ইবাদত, যা আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ ﷺ-এর প্রতি ভালোবাসা, সম্মান ও আনুগত্য প্রকাশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ নিজেই আমাদেরকে নবীজীর উপর দরুদ পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন। দরুদে ফুতুহাত এমনই একটি বিশেষ দরুদ, যার মধ্যে রয়েছে রহমত, বরকত, ফাতেহা (সাফল্যের দরজা) ও সাহায্য প্রার্থনার গভীর আবেদন।
দরুদে ফুতুহাতকে আলেমরা আধ্যাত্মিক মুক্তি, বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা এবং রিযিকের প্রশস্ততার জন্য অত্যন্ত কার্যকর হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এর শব্দগুলোতে আছে ফুতুহাতের (অর্থাৎ বিজয় ও উন্মোচন) আবেদন—যা মুমিনের হৃদয়কে আল্লাহর কাছে আরও বেশি নিকটবর্তী করে এবং জীবনের কঠিন সময়গুলোতে আশার আলো দেখায়।
এই ব্লগে আমরা আলোচনা করব দরুদে ফুতুহাতের আরবি পাঠ, বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ, এর ফজিলত, কবে এবং কীভাবে এটি পড়তে হয়, এবং কুরআন-হাদিসের দলিলসহ এর ফিকহি দৃষ্টিকোণ।
দরুদে ফুতুহাত কী
এই দরুদে ফুতুহাত একটি বিশেষ দরুদ শরীফ, যেখানে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা হয় যেন নবী মুহাম্মাদ ﷺ-এর উপর রহমত ও দরুদ বর্ষিত হয় এবং এর মাধ্যমে আমাদের জন্য ‘ফুতুহাত’ (উন্মোচন, সাফল্য, বিজয়, রহমতের দরজা খোলা) হয়। “ফুতুহাত” শব্দটি এসেছে আরবি فتح (ফাতহ) ধাতু থেকে, যার অর্থ খোলা, উন্মোচন, জয়, সাফল্য। অর্থাৎ, এই দরুদটি মূলত আল্লাহর কাছে দোয়া, যাতে তিনি আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য কল্যাণের দরজা খুলে দেন।
দরুদে ফুতুহাত – আরবি । বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ صَلَاةً تُفَتَّحُ بِهَا أَبْوَابُ الرَّحْمَةِ وَالتَّوْفِيقِ وَالنَّصْرِ وَالْفَلَاحِ
বাংলা উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা সাল্লি আলা সাইয়্যিদিনা মুহাম্মাদিন সালা-তান তুফাত্তাহু বিহা আবওয়াবুর রহমাতি ওয়াত্তাওফীকি ওয়ান্নাসরি ওয়ালফালাহ।
অর্থ: হে আল্লাহ, আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ ﷺ-এর উপর এমন দরুদ বর্ষণ করুন, যার মাধ্যমে রহমতের দরজা, তাওফিকের দরজা, সাহায্যের দরজা এবং মুক্তি ও সাফল্যের দরজা খুলে যায়।

কেন পড়া হয়?
দরুদে ফুতুহাত পড়ার মূল উদ্দেশ্য হলো—
- আল্লাহর রহমত ও বরকতের দরজা উন্মুক্ত হওয়া।
- দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা অর্জন।
- সমস্যার সমাধান, বিপদ থেকে মুক্তি ও মনোবল বৃদ্ধি।
- আল্লাহর সাহায্য (নসর) লাভ করা।
- অন্তরের প্রশান্তি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি।
এটি বিশেষ করে তাদের জন্য পড়া হয় যারা জীবনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন, কোনো সমস্যার সমাধান খুঁজছেন, বা রিযিক, স্বাস্থ্যের উন্নতি ও মানসিক শান্তি কামনা করছেন।
ফজিলত
দরুদ পাঠের সাধারণ ফজিলত কুরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট। দরুদে ফুতুহাতের বিশেষ ফজিলত হলো—
- দোয়া কবুলের মাধ্যম – নবী ﷺ বলেছেন,
“যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার উপর দশবার রহমত বর্ষণ করেন।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস ৩৮৪)
- কষ্ট দূর হওয়া – দরুদ পাঠকারী মানুষের অন্তরে প্রশান্তি আসে, বিপদ-আপদ দূর হয়।
- রিযিকের প্রশস্ততা – অনেক আলেমের মতে, দরুদে ফুতুহাত রিযিক বৃদ্ধি, জীবনের দরজা খোলা এবং কাজের সাফল্যের জন্য বিশেষ কার্যকর।
- আধ্যাত্মিক উন্নতি – এই দরুদ মনকে পরিশুদ্ধ করে, আল্লাহর কাছে নৈকট্য বাড়ায় এবং ঈমান মজবুত করে।
- বিজয় ও সফলতা – ‘ফুতুহাত’ শব্দের অর্থই হলো বিজয় বা সফলতা। তাই এটি পড়লে আল্লাহর সাহায্য লাভের আশা করা যায়।
🔹 দরুদে ফুতুহাতের উৎস ও ইতিহাস
দরুদে ফুতুহাত মূলত তাসাউফ ও আধ্যাত্মিক ইলমের জগতে পরিচিত একটি দরুদ। অনেক মুজাররাব (অভিজ্ঞতা-সিদ্ধ) আমল ও দরুদ যেভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আলেম ও আউলিয়ার মাধ্যমে এসেছে, দরুদে ফুতুহাতও সেভাবে প্রচলিত হয়েছে।
- কে প্রথম পড়তেন: বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ আছে যে প্রাচীন সুফি শায়েখগণ (বিশেষত শায়খ আবদুল কাদির জিলানি রহ. ও তার সিলসিলার মাশায়েখ) এ দরুদটি আমল করতেন। তারা এটিকে “দরওয়াজা খুলে দেওয়ার দরুদ” হিসেবে বর্ণনা করতেন।
- তাসাউফ শায়েখদের মাধ্যমে প্রচলন: চিশতিয়া, কাদিরিয়া, শাধিলিয়া প্রভৃতি তরিকার মুরিদগণ বিশেষ করে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করার আগে বা সমস্যার সমাধানের জন্য দরুদে ফুতুহাত পড়তেন। তাদের মতে, এর মাধ্যমে আল্লাহর রহমত ও সাহায্য দ্রুত নাজিল হয়।
- আজকের দিনে প্রচলন: বর্তমানে এটি ইসলামি বই, ওয়াজ-মাহফিল ও অনলাইনে ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হয় এবং বহু মুসলিম এটি ব্যক্তিগত দোয়া হিসেবে পড়ে থাকেন।
🔹 দরুদে ফুতুহাতের শব্দ বিশ্লেষণ
শব্দ | আরবি মূল | অর্থ | আধ্যাত্মিক গুরুত্ব |
---|---|---|---|
فُتُوحَات (ফুতুহাত) | فتح (ফাতহ) | উন্মুক্তকরণ, জয়, সাফল্য | আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা হয় যেন জীবনের সমস্যাগুলো সহজ হয় এবং কল্যাণের দরজা খুলে যায়। |
رَحْمَة (রহমাহ) | رحم | দয়া, করুণা | মানুষের জন্য আল্লাহর রহমত সবচেয়ে বড় নিয়ামত। দরুদে রহমাহ চাওয়া মানে আল্লাহর পক্ষ থেকে দয়া লাভের আবেদন। |
نَصْر (নসর) | نصر | সাহায্য, বিজয় | আল্লাহর নুসরাহ বা সাহায্য ছাড়া কোনো বিজয় সম্ভব নয়। দরুদে নসর চাওয়া মানে আল্লাহর বিশেষ সহায়তা কামনা করা। |
تَوْفِيق (তাওফিক) | وفق | সঠিক কাজের শক্তি পাওয়া | আমল করার ক্ষমতা, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং হিদায়াতের পথে চলার সামর্থ্য চাওয়া। |
فَلَاح (ফালাহ) | فلح | মুক্তি, সফলতা | দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা কামনা। নামাজের আজানে যেমন “হাইয়া আলাল ফালাহ” বলা হয়—এখানেও সেই অর্থেই ব্যবহার। |
এই দরুদ মূলত একটি সমন্বিত দোয়া—যেখানে দুনিয়া ও আখিরাতের সব দরজা খোলার জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন করা হয়।
🔹 দরুদে ফুতুহাত পড়ার সময়
দিনের সময় অনুযায়ী
- সকাল ও সন্ধ্যায়: ফজরের পর ও মাগরিবের পর পড়া আধ্যাত্মিকভাবে খুব উপকারী।
- জুমার দিন: দরুদ পাঠের শ্রেষ্ঠ সময় শুক্রবার। এ দিন দরুদ বেশি বেশি পড়তে উৎসাহিত করা হয়েছে।
- রাতের শেষ প্রহরে: তাহাজ্জুদের সময় এ দরুদ পড়লে মনোযোগ ও একাগ্রতা বাড়ে।
বিশেষ পরিস্থিতি
- কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করার আগে (ব্যবসা, ভ্রমণ, চাকরির ইন্টারভিউ ইত্যাদি)।
- সমস্যা বা দুশ্চিন্তার সময় — পারিবারিক সমস্যা, ঋণ, আর্থিক সংকট।
- ইস্তিখারা করার পর — হৃদয়ের স্থিরতা ও সঠিক পথনির্দেশের জন্য।
- রোগ-ব্যাধির সময় — শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তির জন্য।
- বড় কোনো সিদ্ধান্তের আগে — যেমন বিয়ে, ব্যবসা, চাকরি পরিবর্তন ইত্যাদি।
সংখ্যার দিক থেকে
এটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় পড়া বাধ্যতামূলক নয়। তবে অনেক শায়েখ ১১ বার, ৪১ বার বা ১০০ বার পড়ার পরামর্শ দেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—খুশু ও মনোযোগ দিয়ে পড়া।
🔹 দরুদে ফুতুহাতের আমল
কতবার পড়া যেতে পারে
দরুদে ফুতুহাত পড়ার নির্দিষ্ট কোনো বাধ্যতামূলক সংখ্যা নেই। তবে আধ্যাত্মিক উপকারিতা বাড়ানোর জন্য আলেমরা সাধারণত ১১, ৪১, ১০০ বা ৩১৩ বার পড়ার পরামর্শ দেন। সংখ্যা যতই হোক, মনোযোগ ও খুশু দিয়ে পড়াটাই মুখ্য।
একাকী পড়া বনাম জামাতে পড়া
- একাকী পড়া: সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। ব্যক্তিগত দোয়ার মতো শান্ত পরিবেশে বসে পড়া হয়।
- জামাতে পড়া: কিছু জায়গায় বিশেষ মজলিসে সবাই মিলে একসাথে পড়া হয়। এটি অনুমোদিত, যদি কোনো বিদআত বা হারাম কিছু সংযোজন না করা হয়।
বিশেষ আমল হিসেবে
- কোনো কাজ শুরুর আগে: ১১ বার পড়া যায়।
- সমস্যার সমাধানের জন্য: ৪১ বার পড়া ভালো, এরপর দোয়া করা।
- আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য: নিয়মিত সকাল-সন্ধ্যায় ১০০ বার পড়া অনেক সুফি শায়েখ পরামর্শ দিয়েছেন।
আরো পড়ুন:
🔹 দরুদে ফুতুহাতের প্রমাণ
যদিও দরুদে ফুতুহাতের নির্দিষ্ট শব্দসমষ্টি কোনো সহীহ হাদিসে নেই, তবুও নবী ﷺ-এর উপর দরুদ পাঠ করা কুরআন ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত ইবাদত।
কুরআন থেকে প্রমাণ
إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ ۚ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
“নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর উপর দরুদ পাঠ করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর উপর দরুদ ও সালাম পাঠ কর।” (সূরা আহযাব: ৫৬)
হাদিস থেকে প্রমাণ
নবী ﷺ বলেছেন:
যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার উপর দশবার রহমত বর্ষণ করেন।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস ৩৮৪)
আলেমদের মতামত
ইমাম নববী (রহ.) বলেন—দরুদ পাঠ করা এমন একটি ইবাদত যা দোয়া কবুলের দরজা খুলে দেয়। অনেক আলেম বিশেষ দরুদ (যেমন দরুদে ফুতুহাত) পড়াকে জায়েয বলেছেন, যদি তা শরীয়াহবিরোধী কোনো বাক্য না থাকে।
🔹 দরুদে ফুতুহাত বনাম অন্যান্য দরুদ
দরুদ | বৈশিষ্ট্য | কখন বেশি পড়া ভালো |
---|---|---|
দরুদে ইবরাহিম | নামাজের শেষ বৈঠকে পড়া ফরজ | প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে |
দরুদে তুনাজ্জিনা | বিপদ ও কঠিন সময় থেকে মুক্তির দোয়া | রোগ, বিপদ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় |
দরুদে ফুতুহাত | রহমত, সাফল্য, দরজা খুলে দেওয়ার দরুদ | নতুন কাজ শুরু, রিযিক, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, মানসিক চাপ |
অতএব, দরুদে ফুতুহাত বেশি উপযোগী তখনই যখন আপনি জীবনের কোনো বড় কাজ বা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, অথবা চান আপনার জন্য কল্যাণের দরজা খুলে যাক।
🔹 ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও কাহিনি
অনেক মানুষ জানিয়েছেন, নিয়মিত দরুদে ফুতুহাত পড়ার পর —
- জটিল সমস্যার সমাধান পেয়ে গেছেন।
- দীর্ঘদিনের দুশ্চিন্তা ও ভয় দূর হয়েছে।
- নতুন চাকরি বা ব্যবসায় সাফল্য পেয়েছেন।
- হৃদয়ের প্রশান্তি ও নামাজে মনোযোগ বেড়েছে।
এগুলো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলেও মুমিনের জন্য এগুলো আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা হতে পারে।
🔹 সাধারণ ভুল ধারণা
- জাদুমন্ত্র ভাবা: দরুদে ফুতুহাত কোনো জাদু বা তাবিজ নয়। এটি আল্লাহর কাছে দোয়া করার এক সুন্দর মাধ্যম মাত্র।
- নির্দিষ্ট সংখ্যা বাধ্যতামূলক ভাবা: ৪১ বা ৩১৩ বার পড়ার কথা অনেক বইতে থাকলেও এটি আবশ্যক নয়। মূল উদ্দেশ্য হলো মনোযোগ দিয়ে পড়া এবং আল্লাহর কাছে আন্তরিক দোয়া করা।
- তাৎক্ষণিক ফল আশা করা: কেউ কেউ মনে করেন দরুদ পড়লেই সাথে সাথে সব সমস্যা চলে যাবে। কিন্তু আল্লাহ যখন উত্তম মনে করবেন তখনই তিনি ফল দিবেন।
🔹 প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১: মাসিক চলাকালীন কি দরুদে ফুতুহাত পড়া যাবে?
উত্তর: হ্যাঁ, পড়া যাবে। দরুদ পড়ায় কোনো নিষেধ নেই।
প্রশ্ন ২: দরুদে ফুতুহাত কি ফরজ?
উত্তর: না, এটি নফল ইবাদত। ফরজ হলো নামাজে দরুদে ইবরাহিম পড়া।
প্রশ্ন ৩: কি দাঁড়িয়ে না বসে পড়তে হবে?
উত্তর: যেকোনো অবস্থায় পড়া যায়। তবে খুশু-খুযু বাড়ানোর জন্য শান্তভাবে বসে পড়া উত্তম।
প্রশ্ন ৪: এর ফল কতদিনে পাওয়া যাবে?
উত্তর: এটি নির্ভর করে আল্লাহর ইচ্ছার উপর। কখনো তাৎক্ষণিক, কখনো সময় নিয়ে।