দরুদে লাখী । আরবি, বাংলা উচ্চারণ, অর্থ, ফজিলত ও পূর্ণ গাইড

Share this post

রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রতি দরুদ পাঠ করা ইমানদারের অন্যতম বিশেষ আমল। দরুদে লাখী এমন একটি দরুদ, যা বিশেষ করে বরকত, রহমত ও মাগফিরাত লাভের উদ্দেশ্যে পাঠ করা হয়। এর নামের মধ্যেই এর গুরুত্ব লুকিয়ে আছে— “লাখী” শব্দটি ইঙ্গিত দেয় বিপুল সংখ্যক দরুদ পাঠের দিকে, অর্থাৎ বহুবার দরুদ পাঠের ফজিলত অর্জনের আশা।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, দরুদে লাখী বিভিন্ন আলেম ও আউলিয়ার আমলে বহুল প্রচলিত ছিল। তাঁরা এটিকে আত্মিক প্রশান্তি ও দুনিয়াবি সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য পাঠ করতেন। আজও অনেক মানুষ এটি নিয়মিত পড়ে আল্লাহর রহমত কামনা করেন এবং রাসূল ﷺ-এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেন।

দরুদে লাখীর পাঠের মাধ্যমে আমরা রাসূল ﷺ-এর শাফাআত লাভের আশা করতে পারি এবং আমাদের আমলকে অধিক গ্রহণযোগ্য করতে পারি। এটি একদিকে যেমন যিকির, তেমনি দোয়া।

🕌 দরুদে লাখীর আরবি

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ عَبْدِكَ وَرَسُولِكَ النَّبِيِّ الْأُمِّيِّ وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ وَسَلِّمْ تَسْلِيمًا بِعَدَدِ كُلِّ ذَرَّةٍ مِائَةَ أَلْفِ أَلْفِ مَرَّةٍ

📖 বাংলা উচ্চারণ (Transliteration) : আল্লাহুম্মা সাল্লি ‘আলা সাইয়্যিদিনা মুহাম্মাদিন আবদিকা ওয়া রাসূলিকা আন্-নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি, ওয়া ‘আলা আলিহি ওয়া সাহ্বিহি ওয়া সাল্লিম তাসলীমান বি‘আদাদি কুল্লি যাররাতিন মিআতা আলফি আলফি মররাহ।

📝 দরুদে লাখীর অর্থ : “হে আল্লাহ! আমাদের নেতা মুহাম্মাদ ﷺ-এর উপর রহমত প্রেরণ করুন—যিনি আপনার বান্দা ও রাসূল, নিরক্ষর নবী। তাঁর পরিবার ও সাহাবাদের উপরও রহমত প্রেরণ করুন। এমন সংখ্যায় সালাম প্রেরণ করুন, যা প্রতিটি কণিকার সংখ্যার সমান, এক লক্ষ গুণিতক বার।”

দরুদে লাখী আরবি ও বাংলা উচ্চারণ
দরুদে লাখী আরবি ও বাংলা উচ্চারণ

🌸 দরুদে লাখীর ফজিলত ও গুরুত্ব

দরুদে লাখীকে বহু আলেম এমন এক দরুদ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যা অসীম সওয়াবের আশ্বাস দেয়। এর কিছু বিশেষ ফজিলত:

  • অপরিমেয় সওয়াবের প্রতিশ্রুতি: “লাখী” শব্দের অর্থই হচ্ছে “লক্ষ লক্ষ বার”। এই দরুদে সংখ্যার মাধ্যমে অগণিত দরুদ পড়ার সমান সওয়াব লাভের আশা করা যায়।
  • বরকত ও রহমত লাভ: নিয়মিত পড়লে দুনিয়াবি ও আখিরাতি কাজে বরকত আসে।
  • গুনাহ মাফের কারণ: হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি রাসূল ﷺ-এর প্রতি দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার দশটি গুনাহ ক্ষমা করে দেন এবং দশটি নেকি দান করেন।
  • হৃদয়ে প্রশান্তি: দরুদে লাখী হৃদয়কে নরম করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ-এর প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি করে।
  • শাফাআতের আশা: বেশি বেশি দরুদ পাঠকারী কিয়ামতের দিন রাসূল ﷺ-এর সুপারিশের যোগ্য হন।

🔢 দরুদে লাখী কতবার পড়া যায়

দরুদে লাখী নির্দিষ্ট সংখ্যার সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়। তবে যেহেতু এতে “লাখ” সংখ্যার ইঙ্গিত আছে, অনেকে আমল হিসেবে নির্দিষ্ট সংখ্যায় পড়েন:

  • ১১ বার বা ২১ বার – সাধারণ আমল হিসেবে।
  • ১০০ বার বা ৩১৩ বার – বিশেষ প্রয়োজন বা সমস্যা সমাধানের জন্য।
  • হাজার বা একাধিক হাজার বার – নিয়মিত যিকির হিসেবে বড় আমল করতে চাইলে।

📌 মূল কথা: যত বেশি পড়া যায়, ততই ভালো। দরুদ পড়ার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই।

🕰️ কিভাবে ও কখন পড়া উত্তম

দরুদে লাখী পড়ার উত্তম সময়গুলো হলো—

  1. ফজরের পর ও মাগরিবের পর – সকাল-সন্ধ্যার যিকিরের অংশ হিসেবে।
  2. শুক্রবার – বিশেষভাবে সুপারিশকৃত সময়, কারণ হাদিসে শুক্রবারে বেশি দরুদ পাঠের তাগিদ এসেছে।
  3. মুসিবত বা সমস্যা এলে – রিজিকের কষ্ট, অসুস্থতা বা দুঃশ্চিন্তায় পড়লে।
  4. নামাজের পরে – পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ শেষে নিয়মিত দরুদে লাখী পড়লে আমল বরকতময় হয়।
  5. রাতের নির্জনে – তাহাজ্জুদ বা নফল নামাজের পর পড়লে আত্মিক প্রশান্তি আসে।

📜 দলিল ও প্রমাণ

দরুদে লাখীর নির্দিষ্ট কোনো হাদিস নেই, তবে রাসূল ﷺ-এর উপর দরুদ পাঠের ব্যাপারে সাধারণ বহু দলিল আছে—

📖 কুরআন থেকে

إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ ۚ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا

“নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা নবীর উপর রহমত প্রেরণ করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর উপর দরুদ ও সালাম পাঠ কর।” — (সূরা আহযাব ৩৩:৫৬)

🤲 হাদিস থেকে

রাসূল ﷺ বলেছেন:

مَنْ صَلَّى عَلَيَّ وَاحِدَةً صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ عَشْرًا

“যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার উপর দশবার রহমত প্রেরণ করেন।”
— (সহীহ মুসলিম ৩৮৪)

🧕 আলেমদের মতামত

  • ইমাম নববী (রহ.): তিনি দরুদকে সবচেয়ে উত্তম যিকিরগুলোর একটি বলেছেন।
  • ইবনে কাইয়্যিম (রহ.): দরুদকে দোয়া কবুলের চাবি বলেছেন।
  • বুজুর্গ আউলিয়া: দরুদে লাখীর মতো সংখ্যাসহ দরুদ পড়াকে তারা আত্মার প্রশান্তি ও রূহানিয়াত বৃদ্ধির জন্য বিশেষ আমল হিসেবে সুপারিশ করেছেন।

🛠️ দরুদে লাখীর আমল ও ব্যবহারিক দিক

  1. দৈনন্দিন রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করুন – সকাল-সন্ধ্যা অন্তত ১১ বা ২১ বার পড়ুন।
  2. তাওয়াজ্জুহ (মনোযোগ) রেখে পড়ুন – শুধু মুখে নয়, হৃদয় দিয়ে পড়লে প্রভাব বেশি হয়।
  3. মুসিবতে আমল করুন – দুঃখ, কষ্ট, আর্থিক সমস্যা বা রোগ-ব্যাধির সময় ধারাবাহিকভাবে পড়ুন।
  4. সদকা ও দোয়ার সঙ্গে মিলিয়ে পড়ুন – দরুদে লাখী শেষে দোয়া করলে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
  5. শিশুদের শেখান – পরিবারের সবাই মিলে পড়লে ঘরে বরকত নেমে আসে।

আরো পড়ুন:

কিছু প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১: দরুদে লাখী কি কুরআন বা সহীহ হাদিস থেকে এসেছে?

উত্তর: না, দরুদে লাখীর নির্দিষ্ট আরবি পাঠ সহীহ হাদিসে নেই। তবে রাসূল ﷺ-এর উপর দরুদ পাঠের সাধারণ নির্দেশনা কুরআন ও বহু সহীহ হাদিসে এসেছে। তাই এটিও জায়েয ও কল্যাণকর আমল।

প্রশ্ন ২: দরুদে লাখী পড়ার নির্দিষ্ট সংখ্যা কি আছে?

উত্তর: নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। কিন্তু ধারাবাহিকতার জন্য অনেকে ১১, ২১, ১০০ বা ৩১৩ বার পড়েন। বেশি পড়লে সওয়াবও বেশি।

প্রশ্ন ৩: শুধু দরুদে লাখী পড়লেই কি সব সমস্যা দূর হবে?

উত্তর: দরুদ পড়া অবশ্যই বরকতের কারণ, তবে এর সঙ্গে দোয়া, আমল ও চেষ্টা থাকা জরুরি। দরুদে লাখী হলো রহমত টানার একটি মাধ্যম।

প্রশ্ন ৪: মহিলারা মাসিক অবস্থায় দরুদে লাখী পড়তে পারবেন?

উত্তর: হ্যাঁ, কারণ দরুদ পড়া যিকিরের অন্তর্ভুক্ত, যা হায়েজ অবস্থায়ও জায়েয।

প্রশ্ন ৫: দরুদে লাখী কি নির্দিষ্ট সময়েই পড়তে হবে?

উত্তর: না, যেকোনো সময় পড়া যায়। তবে শুক্রবার ও নামাজের পর পড়া উত্তম।

🏁 উপসংহার

দরুদে লাখী শুধু একটি আমল নয়, এটি একপ্রকার ভালোবাসা ও সংযোগ। আমরা যখন এটি পড়ি—

  • আমরা আল্লাহর হুকুম পালন করি (সূরা আহযাব ৩৩:৫৬)।
  • রাসূল ﷺ-এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করি।
  • নিজের জীবনে বরকত ও রহমত কামনা করি।
  • আমাদের গুনাহ মাফ হওয়ার এবং শাফাআত পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।

আজকের ব্যস্ত জীবনে যেখানে দুঃশ্চিন্তা, টেনশন আর কষ্ট আমাদের গ্রাস করে রাখে, সেখানে দরুদে লাখী হৃদয়ে প্রশান্তি আনে, দোয়া কবুলের দরজা খুলে দেয়, এবং আমাদের আত্মিকভাবে শক্তিশালী করে। তাই নিয়মিত দরুদে লাখী পড়া শুধু ইবাদাত নয়, বরং আমাদের আত্মার জন্য একপ্রকার সঞ্জীবনী।


Share this post
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x