ইসলাম আমাদের জীবনকে নূরের পথে পরিচালিত করার জন্য অসংখ্য দোয়া ও যিকির শিখিয়েছে। এসব দোয়া শুধু মুখের শব্দ নয়; বরং হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করার, আল্লাহর নৈকট্য লাভের এবং আত্মাকে শান্ত করার মাধ্যম। দোয়ায়ে নূর এমনই একটি দোয়া, যার অর্থই হলো “আলোর দোয়া”। এটি আমাদের জীবনকে অন্ধকার থেকে মুক্ত করে আলোর পথে নিয়ে যাওয়ার প্রতীক।
এই দোয়া পড়ার মাধ্যমে মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে নূর প্রার্থনা করে—চোখে, কানে, হৃদয়ে এবং সমগ্র জীবনে নূরের বরকত লাভের জন্য। এটি এমন এক আধ্যাত্মিক অনুরোধ যা মানুষের ভেতরকার অন্ধকার (পাপ, শির্ক, হতাশা) দূর করে ঈমানের আলো জ্বালিয়ে দেয়।
দোয়ায়ে নূর কী?
দোয়া নূর এমন একটি দোয়া যেখানে বান্দা আল্লাহর কাছে নিজের পুরো অস্তিত্বকে নূরে ভরে দেওয়ার প্রার্থনা করে। এটি মূলত রাসূল ﷺ-এর একটি দোয়া, যেখানে তিনি আল্লাহর কাছে তাঁর দেহের প্রত্যেকটি অংশ, পথচলা, দিকনির্দেশনা এবং আশপাশকে নূরে পরিপূর্ণ করার জন্য দোয়া করেছেন। এই দোয়া মুমিনের হৃদয়ে ঈমানের আলো জ্বালিয়ে দেয় এবং আধ্যাত্মিক শক্তি বাড়ায়।
দোয়ায়ে নূর আরবি
اللَّهُمَّ اجعل في قلبي نورًا، وفي لساني نورًا، واجعل في سمعي نورًا، واجعل في بصري نورًا، واجعل من خلفي نورًا، ومن أمامي نورًا، واجعل من فوقي نورًا، ومن تحتي نورًا، اللَّهُمَّ أعطني نورًا
বাংলা উচ্চারণ
আল্লাহুম্মাজ‘আল ফি ক্বালবি নূরান, ওয়া ফি লিসানি নূরান, ওয়াজ‘আল ফি সাম‘ই নূরান, ওয়াজ‘আল ফি বসারি নূরান, ওয়াজ‘আল মিন খালফি নূরান, ওয়া মিন আমামি নূরান, ওয়াজ‘আল মিন ফাউকি নূরান, ওয়া মিন তাহতি নূরান, আল্লাহুম্মা আ‘ত্বিনি নূরান।
দোয়ায়ে নূরের অর্থ (বাংলা অনুবাদ)
“হে আল্লাহ, আমার হৃদয়ে নূর দান করো, আমার জিহ্বায় নূর দান করো, আমার শ্রবণে নূর দান করো, আমার দৃষ্টিতে নূর দান করো। আমার পিছনে নূর দান করো, আমার সামনে নূর দান করো, আমার ওপরে নূর দান করো, আমার নিচে নূর দান করো। হে আল্লাহ! আমাকে নূর দান করো।”

দোয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড / ইতিহাস
দোয়ায়ে নূর রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর একটি বিখ্যাত দোয়া। হাদিসে এসেছে—
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ: بَاتَ عِنْدَ مَيْمُونَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا رَسُولُ اللَّهِ ﷺ، فَقَامَ النَّبِيُّ ﷺ يُصَلِّي مِنَ اللَّيْلِ، فَجَعَلَ يَدْعُو فَجَعَلَ يَقُولُ: «اللَّهُمَّ اجْعَلْ فِي قَلْبِي نُورًا …»
অর্থাৎ, ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন—একবার আমি রাসূল ﷺ-এর খালা মাইমুনাহ (রাঃ)-এর বাড়িতে রাত কাটালাম। সেই রাতে রাসূল ﷺ তাহাজ্জুদের জন্য দাঁড়ালেন এবং এই দোয়া পড়লেন। (সহীহ মুসলিম, হাদিস: 763)
📌 সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
- স্থান: মদিনা শরীফ
- সময়: রাতের সালাত (কিয়ামুল লাইল / তাহাজ্জুদ)
- প্রসঙ্গ: রাসূল ﷺ নিজের জন্য হিদায়াত ও আলোকিত জীবন প্রার্থনা করেছেন।
দোয়ার বিশ্লেষণ (Word-by-Word Tafsir)
আরবি শব্দ | উচ্চারণ | অর্থ |
---|---|---|
اللَّهُمَّ | আল্লাহুম্মা | হে আল্লাহ |
اجعل | ইজ‘আল | বানিয়ে দাও / দান করো |
في | ফি | মধ্যে / ভিতরে |
قلبي | ক্বালবি | আমার হৃদয় |
نورًا | নূরান | আলো / হিদায়াত |
لساني | লিসানি | আমার জিহ্বা |
سمعي | সাম‘ই | আমার শ্রবণ |
بصري | বসারি | আমার দৃষ্টি |
خلفي | খালফি | আমার পেছনে |
أمامي | আমামি | আমার সামনে |
فوقي | ফাওকি | আমার ওপরে |
تحتي | তাহতি | আমার নিচে |
أعطني | আ‘ত্বিনি | আমাকে দাও |
نورًا | নূরান | আলো |
এভাবে দোয়া পড়লে প্রতিটি শব্দের অর্থ মনে রেখে মনোযোগসহ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা যায়।
দোয়ার আধ্যাত্মিক দিক
“নূর” শব্দটি কেবল আলো নয়। ইসলামী আধ্যাত্মিকতায় নূরের অর্থ—
- হিদায়াত: সঠিক পথের আলো
- ঈমান: হৃদয়ের আলো যা গুনাহকে অপছন্দ করায়
- রহমত: আল্লাহর দয়া ও প্রশান্তি
- আত্মবিশ্বাস ও স্থিরতা: সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার শক্তি
দোয়ায়ে নূর মূলত একজন মুমিনের সম্পূর্ণ জীবনকে আল্লাহর নূর দ্বারা আচ্ছাদিত করার প্রার্থনা। এটি হৃদয়, দৃষ্টি, শ্রবণ, জিহ্বা ও চলার পথকে গুনাহের অন্ধকার থেকে সুরক্ষিত রাখে।
লাইফ অ্যাপ্লিকেশন
দোয়ায়ে নূর কেবল একটি আমল নয়; এটি জীবনের একটি দিকনির্দেশনা—
- দৈনন্দিন জীবনে: ফজরের পরে বা ঘুমানোর আগে পড়লে সারাদিনের জন্য হিদায়াতের শক্তি পাওয়া যায়।
- কঠিন সিদ্ধান্তে: যখন সঠিক ও ভুলের মাঝে বিভ্রান্তি থাকে, তখন এই দোয়া মনকে আলোকিত করে।
- আধ্যাত্মিক উন্নতিতে: নিয়মিত পড়লে চোখ, কান, জিহ্বা গুনাহ থেকে বাঁচে।
- মানসিক প্রশান্তি: দুশ্চিন্তা, হতাশা ও মানসিক অন্ধকার দূর হয়।
দোয়ায়ে নূরের ফজিলত ও উপকারিতা
দোয়া নূর এমন এক দোয়া যা মানুষের অন্তরে ঈমানের আলো জ্বালিয়ে দেয় এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হিদায়াতের পথ খুলে দেয়। এর ফজিলতগুলো হলো—
- হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করে: গুনাহের অন্ধকার দূর করে এবং অন্তরে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা জাগিয়ে তোলে।
- দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তির সঠিক ব্যবহার: চোখ, কান এবং জিহ্বা নূরের মাধ্যমে গুনাহ থেকে সুরক্ষিত থাকে।
- হিদায়াতের পথ সুগম করে: জীবনের সব দিকেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
- আধ্যাত্মিক প্রশান্তি: উদ্বেগ ও হতাশা দূর করে, হৃদয়ে প্রশান্তি ও তৃপ্তি আনে।
- আখিরাতের জন্য প্রস্তুত করে: কিয়ামতের দিনে নূরের আলো নিয়ে পুনরুত্থিত হওয়ার আশা বাড়ায়।
কখন ও কীভাবে দোয়ায়ে নূর পড়তে হয়
- নিয়মিত পড়া: বিশেষ করে ফজরের নামাজের পর বা রাতে তাহাজ্জুদে পড়া উত্তম।
- সালাতের মধ্যে পড়া: অনেক আলেমের মতে, এটি রাসূল ﷺ-এর সেই দোয়া যা তিনি রাতের সালাতে (কিয়ামুল লাইল) পড়তেন।
- কোনো নির্দিষ্ট সমস্যা থাকলে: দিকভ্রান্তি, মনোবেদনা বা সিদ্ধান্তহীনতার সময় পড়লে হৃদয়ে প্রশান্তি আসে।
- আদবসহ পড়া: ওযু অবস্থায়, মনোযোগ দিয়ে এবং অর্থ মনে রেখে পড়া উচিত।
আরো পড়ুন:
দোয়ায়ে নূরের দলিল (কুরআন ও হাদিস থেকে প্রমাণ)
📖 কুরআন থেকে ইঙ্গিত:
আল্লাহ বলেছেন –
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَآمِنُوا بِرَسُولِهِ يُؤْتِكُمْ كِفْلَيْنِ مِنْ رَحْمَتِهِ وَيَجْعَلْ لَكُمْ نُورًا تَمْشُونَ بِهِ
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনো, তিনি তোমাদেরকে দ্বিগুণ রহমত দেবেন এবং এমন এক নূর দেবেন যার দ্বারা তোমরা চলবে।” (সূরা হাদীদ ৫৭:২৮)
📜 হাদিস থেকে প্রমাণ:
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন –
اللَّهُمَّ اجعل في قلبي نورًا… (উপরের দোয়াটি)
ইমাম মুসলিম তাঁর সহীহে এই দোয়াটি বর্ণনা করেছেন (সহীহ মুসলিম, হাদিস: 763)।
এটি প্রমাণ করে যে দোয়ায়ে নূর রাসূল ﷺ-এর সুন্নাহ দোয়া।
ফিকহি দৃষ্টিকোণ
- মুস্তাহাব আমল: আলেমদের মতে এটি একটি মুস্তাহাব দোয়া—পড়লে সওয়াব আছে, না পড়লে গুনাহ নেই।
- নামাজে পড়া বৈধ: রাতের সালাতে পড়া রাসূল ﷺ-এর প্রমাণিত আমল। তাই নামাজে বা নামাজ শেষে পড়া যেতে পারে।
- বিধিবদ্ধ জিকিরের অংশ: যেহেতু এটি সহীহ হাদিসে এসেছে, তাই এটি বিদআত নয়। বরং নিয়মিত পড়া সুন্নাহর অংশ।
- নারী-পুরুষ সবার জন্য: দোয়া হওয়ায় এটির ক্ষেত্রে লিঙ্গভেদ নেই।
দোয়ায়ে নূর পড়ার সময় যেসব ভুল এড়ানো উচিত
দোয়াটি পড়ার সময় কিছু সাধারণ ভুল হয়, সেগুলো এড়ানো জরুরি—
- শব্দ বিকৃতি করা: আরবি শব্দের হরফ ঠিকমতো উচ্চারণ না করলে অর্থ বদলে যেতে পারে। তাই সঠিক উচ্চারণ শিখে পড়া উচিত।
- যান্ত্রিকভাবে পড়া: শুধু মুখে পড়া, কিন্তু অর্থ মনে না রাখা দোয়ার প্রভাব কমিয়ে দেয়।
- অতিরিক্ত সংখ্যা নির্ধারণ করা: শরীয়তে নির্দিষ্ট সংখ্যা না থাকলে নিজের থেকে সংখ্যা বেঁধে নেওয়া উচিত নয়।
- বিদআতি নিয়ম বানানো: এটিকে কোনো বিশেষ দিনে বা বিশেষ পরিস্থিতিতে আবশ্যক বলে মনে করা। এটি মুস্তাহাব আমল, ফরজ নয়।
- তাড়াহুড়ো করে পড়া: দোয়া ধীরে ও মনোযোগ সহকারে পড়া উচিত।
সাধারণ প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১: দোয়ায়ে নূর কি কেবল নামাজের মধ্যে পড়তে হয়?
উত্তর: না। যদিও রাসূল ﷺ এটি বেশি পড়তেন কিয়ামুল লাইল (রাতের সালাত)-এ, তবে নামাজের বাইরে যিকির হিসেবেও পড়া যায়। দিনের যেকোনো সময়, বিশেষ করে সকাল-বিকেল, ফজর বা তাহাজ্জুদের পরে পড়া খুবই উপকারী।
প্রশ্ন ২: দোয়ায়ে নূর কি ফরজ নাকি সুন্নাহ?
উত্তর: এটি ফরজ নয়। এটি রাসূল ﷺ-এর প্রমাণিত দোয়া, তাই এটি সুন্নাহ বা মুস্তাহাব আমল। পড়লে সওয়াব পাওয়া যাবে, কিন্তু না পড়লে গুনাহ হবে না।
প্রশ্ন ৩: দোয়ায়ে নূর কি কোনো নির্দিষ্ট সমস্যার জন্য পড়া উচিত?
উত্তর: হ্যাঁ, বিশেষ করে যখন অন্তরে অশান্তি, পথভ্রষ্ট হওয়ার ভয়, বা সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেন, তখন এই দোয়া পড়লে মন শান্ত হয় এবং আল্লাহর দিক থেকে হিদায়াত পাওয়া সহজ হয়।
প্রশ্ন ৪: দোয়ায়ে নূর পড়লে কি জাদু, নজর বা শয়তানের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়?
উত্তর: দোয়ায়ে নূর সরাসরি নজর বা জাদুর দোয়া নয়, তবে আল্লাহর নূর যখন বান্দাকে ঘিরে রাখে তখন তার অন্তর শক্তিশালী হয়, ভয় কমে যায় এবং আল্লাহর সুরক্ষা লাভ করে। এজন্য এটি রুহানীভাবে উপকারী।
প্রশ্ন ৫: দোয়ায়ে নূর পড়তে কি ওযু থাকা জরুরি?
উত্তর: ওযু থাকলে উত্তম। তবে এটি সাধারণ দোয়া হওয়ায় ওযু ছাড়াও পড়া বৈধ। কিন্তু পবিত্র অবস্থায় পড়লে এর প্রভাব বেশি হয়।
প্রশ্ন ৬: দোয়ায়ে নূর কি মহিলারা মাসিক অবস্থায় পড়তে পারেন?
উত্তর: হ্যাঁ, এটি সাধারণ দোয়া হওয়ায় মহিলারা মাসিক অবস্থায়ও পড়তে পারেন। তবে কুরআনের আয়াত পড়লে শুধু তেলাওয়াতের নিয়ত না রেখে দোয়া হিসেবে পড়া উত্তম।
প্রশ্ন ৭: দোয়ায়ে নূর কতবার পড়া উত্তম?
উত্তর: সহীহ হাদিসে নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। তাই ইচ্ছেমতো পড়া যায়। কেউ প্রতিদিন একবার পড়তে পারেন, আবার কেউ সকাল-সন্ধ্যা বা প্রতিটি নামাজের পরে পড়তে পারেন।
প্রশ্ন ৮: দোয়ায়ে নূর পড়লে কি আল্লাহ স্বপ্নে হিদায়াত দেন?
উত্তর: এটি নির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত নয়, তবে নিয়মিত দোয়া ও যিকির করলে হৃদয় পরিশুদ্ধ হয় এবং হিদায়াতের দরজা খুলে যায়। কখনও কখনও স্বপ্নেও আল্লাহ বান্দাকে সুসংবাদ দেন।
উপসংহার । আলোর পথে জীবন যাপন
দোয়ায়ে নূর আমাদের শেখায়—একজন মুমিন শুধু দুনিয়ার সমস্যার সমাধান চায় না, বরং আল্লাহর কাছ থেকে এমন আলো চায় যা তার জীবনের প্রতিটি দিককে আলোকিত করবে। এই আলো ঈমানের আলো, হিদায়াতের আলো, যা তাকে গুনাহের অন্ধকার থেকে বের করে এনে জান্নাতের পথে চালিত করবে।
নিয়মিত দোয়ায়ে নূর পড়া আমাদের অন্তরের রোগ সারায়, জীবনের সিদ্ধান্তে সঠিক পথ দেখায় এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করে। তাই আসুন আমরা সবাই এই দোয়াটি শিখি, বুঝি এবং আমল করি—যেন আমাদের জীবন সত্যিই নূরের জীবন হয়ে ওঠে।