নামাজের নিয়ত । প্রচলিত ভুল এবং বিশুদ্ধ উপায়

Share this post

নামাজের নিয়ত নিয়ে আমাদের সমাজে একটি শক্তিশালী ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। সেই ভুলই যুগযুগ থেকে চলে আসছে। এতো ব্যাপকভাবে ভুলটা প্রচারিত হয়েছে যে, এখন সেটাই সঠিক জ্ঞান বলে গ্রহণ করা হচ্ছে। অথচ প্রকৃত কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী নামাজের নিয়ত নিয়ে এই প্রচলিত ধারণাগুলো সঠিক নয়। আসুন, বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করি।

ভুল নিয়তের চাক্ষুষ প্রমাণ

ভুল তথ্য বা কথা যে বেশি প্রচার পেলে সত্য বলে গণ্য হতে পারে, তার একটি স্পষ্ট উদাহরণ হলো – নামাজের নিয়ত। আমাদের দেশে নামাজের নিয়ত হিসেবে কিছু নির্দিষ্ট আরবি বাক্য শেখানো হয়, যা প্রকৃতপক্ষে অনর্থক এবং ক্ষেত্র বিশেষে বিদআত। কিন্তু এই সত্যটা খুব বেশি প্রচার পায়নি।

গুগলে “নামাজের নিয়ত” লিখে সার্চ করলে প্রথম দিকের রেজাল্টগুলোতে সকল ওয়েবসাইট পাওয়া যায়, তারাও নামাজের সেই ভুল নিয়ত শিখাচ্ছে। এসব লেখক হয়তো জানেনই না কোনটা ভুল আর কোনটা সঠিক। তারা সমাজে প্রচলিত কথাগুলোকেই একটু নিজের মত করে লিখে পোস্টগুলো পাবলিশ করেছেন।

শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পাঠ্যবই, যেমন – দাখিল ৭ম শ্রেণির কুরআন ও আকাইদ বইতেও একই ভুল শেখানো হয়েছে। এমনকি মক্তবগুলোতেও শিশুদের এই আরবি বাক্যগুলো মুখস্থ করতে বাধ্য করা হয়। এটা মোটেও ইসেলামে নামাজ শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

নামাজের নিয়তের বিশুদ্ধ উপায়

নিয়ত আরবি শব্দ, যার অর্থ হলো ইচ্ছা করা। এই ইচ্ছা বা সংকল্প হৃদয়ের অভ্যন্তরে জন্ম নেয়। একটি কাজ সম্পাদনের চিত্র অন্তরে জাগ্রত থাকা ও সেই কাজটি কোন লক্ষ্যে করা হচ্ছে তার সার্বিক প্রক্রিয়াই নিয়ত। সেটা মনে মনে স্থির করাই যথেষ্ট।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো নামাজের আগে নির্দিষ্ট কোনো আরবি বাক্য মুখে উচ্চারণ করেননি। সাহাবায়ে কেরাম ও পরবর্তী যুগের ইমামরাও এই পদ্ধতি অনুসরণ করেননি। সুতরাং নামাজের জন্য আরবি কোনো বাক্য উচ্চারণ করা অনর্থক এবং ক্ষেত্র বিশেষে বিদআতের শামিল হতে পারে।

ইমামদের অভিমত

শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহিমাহুল্লাহ বলেছেন:

“এই ( নিয়তের বাক্য মুখে উচ্চারণ না করার) মতটাই সবচেয়ে সঠিক। আসলে নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা বুদ্ধিমত্তা ও দ্বীনের দিক থেকে অপূর্ণতার পরিচায়ক:

  • দ্বীনের দিক থেকে: কারণ এটি বিদআত, যা রাসুলুল্লাহ সা. শিক্ষা থেকে প্রমাণিত নয়।
  • বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে: কারণ এটা এমন, যেন কেউ খাবার খাওয়ার আগে এভাবে বলে, ‘আমি ইচ্ছা করছি যে, আমার হাত এই পাত্রে রাখব, তারপর এখান থেকে এক লোকমা তুলে মুখে দেব, এরপর সেটাকে চিবিয়ে গিলব, যাতে আমার ক্ষুধা মিটে যায়।’

এভাবে বলাটা যেমন হাস্যকর ও অযথা জটিলতা সৃষ্টি করা, তেমনই নামাজের জন্য মুখে নিয়ত উচ্চারণ করাও অপ্রয়োজনীয় এবং বুদ্ধিহীনতার পরিচায়ক। কেননা, নিয়ত মূলত অন্তরের ইচ্ছা, যা মুখে বলার প্রয়োজন নেই।”

ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহিমাহুল্লাহ তার বিখ্যাত গ্রন্থ যাদুল মা’আদ-এ বলেছেন:

নামাজের নিয়ত বিষয়ে ইমামদের মতামত
নামাজের নিয়ত বিষয়ে ইমামদের মতামত

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতেন, তখন ‘আল্লাহু আকবার’ বলতেন এবং এর আগে কিছুই বলতেন না। তিনি কখনোই নিয়ত মুখে উচ্চারণ করতেন না, যেমন – ‘আমি আল্লাহর জন্য এই নামাজ আদায় করছি, কিবলামুখী হয়ে, চার রাকাত, ইমাম হিসাবে অথবা মুকতাদি হিসাবে, আদায় বা কাজা, সময়ের ফরজ’ – এ ধরনের কিছুই বলতেন না।

এই ধরনের বাক্যগুলো মোট দশটি বিদআত, যেগুলোর মধ্যে একটিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোনো সহীহ, দুর্বল বা মুরসাল সনদে প্রমাণিত হয়নি। এমনকি তার কোনো সাহাবীর পক্ষ থেকেও এ ধরনের কিছু বলা প্রমাণিত নয়। তাবেয়ী, ইমামদের মধ্যে কেউও এগুলোকে পছন্দ করেননি, বরং পরবর্তীকালে কিছু মানুষ ভুল বোঝার কারণে এগুলো প্রচলিত করেছে।

এই উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, নামাজের আগে মুখে নিয়ত উচ্চারণ করার পদ্ধতি বিদআত এবং তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবীগণ, তাবেয়ী, বা ইমামদের কারো থেকেই প্রমাণিত নয়।

ভুল নিয়তের প্রচার হওয়ার কারণ

ইমাম শাফিয়ি রহিমাহুল্লাহ এর বক্তব্য ভুল ব্যাখ্যা

ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহিমাহুল্লাহ তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘যাদুল মা’আদ’– আরোও বলেন:

কিছু পরবর্তী যুগের মানুষ ইমাম শাফেয়ী (রহিমাহুল্লাহ)-এর একটি বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করার কারণে এই বিদআতগুলো প্রচলিত হয়েছে। ইমাম শাফেয়ী (রহিমাহুল্লাহ) বলেছিলেন, ‘নামাজ সিয়ামের মতো নয়, বরং এতে (নামাজে) জিকির ছাড়া প্রবেশ করা যায় না।’ অনেকে ভেবেছেন যে, এই জিকির বলতে নিয়তের বাক্য মুখে উচ্চারণ করা বুঝানো হয়েছে, অথচ ইমাম শাফেয়ী (রহিমাহুল্লাহ) এখানে ‘জিকির’ বলতে শুধু তাকবিরে তাহরীমা (আল্লাহু আকবার) -কেই বুঝিয়েছেন, এর বাইরে কিছু নয়… ।

কিছু মানুষের নিজস্ব যুক্তি

বিশেষ করে বাংলাদেশ বা ভারত উপমহাদেশে ইলামের মূল উৎস কুরআন ও হাদিসের সাথে মানুষের সম্পর্ক অতীতে কম ছিল। তার কারণ হলো ভালোভাবে আরবি জানেন ও কুরআন-সুন্নাহ বুঝেন এমন মানুষের সংখ্যা কম ছিলো। এর বিপরীতে মুসলিম জনসংখ্যা ছিলো বেশি। তাদের মধ্যে ধর্মীয় আবেগ ছিলো। বিশাল একটি এলাকায় এমন একজন আলেম পাওয়াও দুষ্কর ছিলো যিনি ইসলামকে মূল উৎস থেকে ব্যাখ্যা করতে পারেন।

এ ফলে সুফি সাধক ও অল্প সল্প কিতাব পত্র পাঠ করে যারা কিছুটা ইসলাম বুঝতেন তারা নিজেদের যুক্তিকে ইসলামের কিছু কিছু বিধানে যুক্ত করে দিতেন। এ রকমই একটা হলো বিষয় হলো নামাজের নিয়ত। যদিও তাদের উদ্দেশ্য ছিলো ভালো। তারা মনে করতেন মুখ দ্বারা নিয়তের বাক্য উচ্চারণ করলে অন্তেরর সাথে মুখের মিল হবে। এতে নামাজে একাগ্রতা আসবে। কিন্তু তাদের ‍চিন্তা ভুল হওয়ার কারণ হলো শরিয়তের মূল উৎস রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা সাহাবায়ে কেরাম নামাজে একাগ্রতা আনতে এ রকম কাজের প্রচলন করেননি।

নিয়তের বাক্যগুলো উচ্চারণ করার ক্ষতি

বিদআত

সুওয়াবের লক্ষ্যে এমন কোনো আমল চালু করা যা রাসূল (সা.) ও সাহাবীগণ করেননি, তাকে বিদআত বলা হয়। তাই মুখে নিয়তের বাক্য বলা বিদআতের মধ্যে পড়ে, যা স্পষ্টতই পরিত্যাজ্য। এটা আমাদের বুঝা উচিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শিখানো নিয়ম পরিহার করাটা আমাদের জন্য নানাবিদ ক্ষতি নিয়ে আসে।

মানুষের জন্য বুঝা

অনারবি জনসাধারণের কাছে আরবি বাক্যগুলো পাহাড়সম ভারি। তারা জানেন না নামাজের ফরজ কী? বা ওয়াজিব বা সুন্নাহ কী? তারা নামাজের সকল কর্মক্রিয়া ও প্রসেসকে মনে করেন নামাজেরই অংশ। তাই কোনো ব্যক্তি নিয়তের বাক্য না পাড়লে তিনি নামাজ পড়ার জন্যই মসজিদে আসেন না। তিনি ভাবেন এভাবে নিয়ত করতে না পারলে নামাজেই হবে না।

আবার এমনও অনেক মানুষ আছেন যিনি একটু বিলম্বে জামাতে শরিক হলেও রুকুতে ইমামের সাথে শরিক হওয়ার দ্বারা তাকবিরে উলাসহ নামাজ আদায় করার সুযোগ ছিলো। কিন্তু তিনি নিয়তের আরবি বাক্যগুলো পড়তে পড়তে ইমাম সাহেব রুকু শেষ করে ফেলেন। এই সমস্যাটাও হয় এই ভুল পন্থায় নিয়ত শিখানোর কারণে।

নামাজের নিয়ত নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর

প্রশ্ন: নামাজের আগে মুখে আরবি বাক্য না বললে কি নামাজ হবে না?

উত্তর: অবশ্যই হবে। কারণ নিয়ত অন্তরের কাজ এবং এটিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শিক্ষা। তিনি কখনো মুখে নিয়তের বাক্য উচ্চারণ করেননি।

প্রশ্ন: তাহলে নিয়ত কীভাবে করতে হবে?

উত্তর: নামাজের উদ্দেশ্য অন্তরে স্থির করাই যথেষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, মনে মনে স্থির করা যে, আমি ফজরের দুই রাকাত ফরজ নামাজ আদায় করছি।

প্রশ্ন: নিয়তের আরবি বাক্য মুখস্থ করার প্রয়োজন আছে কি?

উত্তর: না, কোনো আরবি বাক্য মুখস্থ করার প্রয়োজন নেই। নিয়ত মূলত অন্তরের সংকল্প, যা মুখে উচ্চারণ করার প্রয়োজন নেই।

প্রশ্ন: ইমাম শাফেয়ী (রহিমাহুল্লাহ) কি মুখে নিয়ত করার কথা বলেছেন?

উত্তর: না, ইমাম শাফেয়ী (রহিমাহুল্লাহ) মুখে নিয়তের কথা বলেননি। তার একটি বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যার কারণে মুখে নিয়ত করার প্রথা প্রচলিত হয়েছে। তিনি তাকবিরে তাহরীমাকে ‘জিকির’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, নিয়তের আরবি বাক্য নয়।

প্রশ্ন: নামাজের আগে নিয়ত উচ্চারণ বিদআত কেন?

উত্তর: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ী এবং চার ইমামের কেউই নামাজের আগে মুখে নিয়ত উচ্চারণ করেননি। অতএব, তাদের না করা কোনো ইবাদতের পদ্ধতি চালু করা বিদআত হিসেবে গণ্য হয়।

প্রশ্ন: নিয়ত কি তাকবিরের (আল্লাহু আকবার) আগে করতে হবে?

উত্তর: হ্যাঁ, নিয়ত তাকবিরের (আল্লাহু আকবার) আগে অন্তরে স্থির করতে হবে। তাকবিরের মাধ্যমে নামাজ শুরু হয়, তাই এর আগে আপনার মনে স্থির থাকতে হবে আপনি কোন নামাজ পড়ছেন।

প্রশ্ন: যদি নিয়ত মনে স্থির না থাকে তাহলে কি নামাজ হবে?

উত্তর: না, নিয়ত ছাড়া কোনো ইবাদত হয় না। কিন্তু নিয়ত মানে মনে মনে সেই কাজের ইচ্ছা করা, মুখে উচ্চারণ করা নয়। তাই নামাজের আগে মনে স্থির করলেই যথেষ্ট, মুখে বলার প্রয়োজন নেই।

উপসংহার

নামাজের নিয়ত নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো শুধরে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করাই আমাদের কর্তব্য। নিয়ত হলো অন্তরের সংকল্প, যা মুখে উচ্চারণ করার প্রয়োজন নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম এবং চার ইমামের কেউই মুখে নিয়তের আরবি বাক্য উচ্চারণ করেননি। বরং এটি একটি বিদআত, যা এড়িয়ে চলা প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব।

আসুন, আমরা আমাদের ইবাদতগুলোকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ অনুযায়ী বিশুদ্ধ করি এবং ভ্রান্তি থেকে মুক্ত হই। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন!


Share this post
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x