মানব শরীরের অঙ্গ বিক্রি বা দান করা কি জায়েজ?

পোস্টটি শেয়ার করুন

মানব জীবনের মূল্য অপরিসীম। মানুষের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একটি বিশেষ উপহার, যা আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের দিয়েছেন। তবে আধুনিক যুগে প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মানুষ নানা জটিল রোগের চিকিৎসায় অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। এই প্রেক্ষাপটে অঙ্গ দান এবং বিক্রি নিয়ে মানুষের মনে নানা প্রশ্ন জাগে। ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী, মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রয় করা জায়েয নয়। এই পোস্টে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব, কেন মানব শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রয় করা হারাম এবং কী শর্তে অঙ্গ দান করা জায়েয হতে পারে। কুরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখব, যাতে সবার জন্য বিষয়টি স্পষ্ট হয়।

শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রি করার বিধান

মানব শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কোনো অবস্থাতেই বিক্রি করা জায়েয নয়। চাই জীবিত মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হোক বা মৃত মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হোক। তা না জায়েয হওয়ার কারণগুলো নিম্নরূপ:

এক: মানুষের শরীরের অঙ্গ প্রত্যাঙ্গগুলোর মালিক আল্লাহ

মানুষের শরীরের অঙ্গ প্রত্যাঙ্গগুলো মানুষের মালিকানাধীন বস্তু নয়। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যাঙ্গের মালিক হলেন আল্লাহ তা’য়ালা। আর মালিকানাহীন বস্তুর বিক্রয় সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

لا تبع ما ليس عندك

‘যে জিনিস তোমার কাছে নেই তা বিক্রয় করো না।’ (জামে তিরমিজি: ১২৩৩)

এর ভিত্তিতে সকল আহলে ইলম এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেন যে, মানুষ যদি এমন কোনো জিনিস বিক্রয় করে যার মালিক সে নয়, তাহলে এই বিক্রয় বাতিল হয়ে যাবে। তাই জীবিত অবস্থায় কোনো ব্যক্তি তার শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রয় করতে পারবে না। এভাবে ওয়ারিসগণও কোনো মৃত ব্যক্তির শরীরের মালিক হয় না। তাই ওয়ারিসগণও মরদেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রয় করতে পারবে না।

দুই: মানব অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সম্মান

মানুষ ও তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো সম্মানযোগ্য বস্তু। তাই তা বিক্রয় করা তার সম্মানের পরিপন্থি। আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন:

وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَىٰ كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا

‘ধার অবশ্যই আমরা আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি; স্থলে ও সাগরে তাদের চলার বাহন দিয়েছি এবং তাদেরকে উত্তম রিযিক দান করেছি। আর আমরা যাদের সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের উপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।’
(সূরা আল-ইসরা: ৭০)

তিন: কাটা ছেঁড়ার নিষেধাজ্ঞা

মানব শরীরের ব্যাপারে মৌলিক হুকুম হলো তাকে কাটা ছেঁড়া না করা। চাই সে জীবিত হোক মৃত হোক। তাই এই হুকুমের উপর অটল থাকা ওয়াজিব হবে যতোক্ষণ না তা থেকে প্রত্যাবর্তনকারী দালায়িল পাওয়া যাবে। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

كسر عظم الميت ككسره حيا

‘মরদেহের হাড্ডি ভাঙ্গা জীবিত অবস্থায় হাড্ডি ভাঙ্গার মতোই।’ (সুনান আবু দাউদ: ৩২০৭)

চার: অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব

যদি বিক্রয় করা বৈধ হয় তাহলে দেখা যাবে অনেক মানুষ অর্থের সংকটের সময় তার শরীরের মূল্যবান কোনো অঙ্গ বিক্রয় করে দিবে। যা তাকে তিলেতিলে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন:

وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ

‘নিজের হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিও না।’ (সূরা আল-বাকারা: ১৯৫)

শরীরের অঙ্গ দান কার কি জায়েজ?

কিন্তু শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দান করা যাবে কি না সে ব্যাপারে আহলে ইলমদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। সমসাময়িক আলেমদের মধ্য থেকে এক জামাতের মতে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দান করা বৈধ রয়েছে। এটাই গ্রহণযোগ্য অভিমত। তবে তা বৈধ হওয়ার জন্য কিছু শর্তারোপ করা হয়েছে। শর্তগুলো নিম্নরূপ আলোচনা করছি।

সুস্থ সবল ব্যক্তির অঙ্গদান

যদি সুস্থ সবল ব্যক্তি অঙ্গদান করে তাহলে এমন অঙ্গদান করতে হবে যা দান করার পর তার কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। কিন্তু যদি এমন কোনো অঙ্গদান করে যার ফলে তার নিজের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে বৈধ হবে না। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:

لَا ضَرَرَ وَلَا ضِرَارَ

‘কারো ক্ষতি করা বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ইসলামে নেই।’ (ইবনে মাজাহ: ২৩৪০)

মৃত ব্যক্তির অঙ্গদান

যদি মৃত ব্যক্তির অঙ্গদান করা হয় তাহলে তার নিজের ওসিয়ত বা তার ওয়ারিসদের সম্মতিতে হতে হবে। কেননা জীবিত অবস্থায় সে নিজে আর মৃত্যুর পর তার ওয়ারিসগণ শরীরের হেফাজতের দায়িত্বপ্রাপ্ত।

দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তির অঙ্গদান

যদি এমন ব্যক্তি অঙ্গদান করে যে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত বা তার মৃত্যু নিশ্চিত তাহলে তার দুরারোগ্য ও মৃত্যুও নিশ্চয়তা বিজ্ঞ ও সত্যবাদী ডাক্তারের কথা দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। সাথে সাথে এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে যতোদিন সে বাঁচবে সে দিনগুলোতে অঙ্গদানের ফলে যেন ইবাদত বা অন্য স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে অসুবিধা সৃষ্টি না হয়।

ক্ষতির কম-বেশি

অঙ্গদান করতে গেলে যদিও কাটা ছেঁড়া করতে হয় যা নিষিদ্ধ ও ক্ষতি, কিন্তু তার চেয়েও বড় ক্ষতি হলো এই অঙ্গের অভাবে একটি জীবন নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। আর শরিয়তের একটি মূলনীতি হলো, দু’টি ক্ষতি একত্রিত হয়ে গেলে অপেক্ষাকৃত বড় ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে ছোট ক্ষতিকে গ্রহণ করে নেওয়া বৈধ। তাছাড়া এর মধ্যে অন্যের উপকার ও বিপদে সাহায্য করার মতো ফযিলত নিহিত রয়েছে।

وبالله التوفيق، وصلى الله على نبينا محمد وآله وصحبه وسلم


পোস্টটি শেয়ার করুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x