সুদ সম্পর্কে কুরআনের আয়াত । আরবি, অর্থ, ব্যাখ্যা ও মতামত

Share this post

সুদ (আরবি: ربا) ইসলামে একটি অত্যন্ত জগণ্য হারাম বিষয়। কুরআন মাজীদে সুদ গ্রহণ এবং প্রদান উভয়কে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা সুদ সম্পর্কে কুরআনের আয়াত, আরবি, বাংলা অর্থ, ব্যাখ্যা, এবং এর উপর ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

১. সুদের ইতিহাস

সুদের ধারণা মানব সমাজে প্রাচীন কাল থেকেই বিদ্যমান। প্রাচীন ব্যাবিলন, মিশর এবং গ্রিসের সভ্যতায় সুদের প্রচলন ছিল। তখন এটি সমাজের ধনী গোষ্ঠীর দ্বারা গরিবদের উপর শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হত। ইসলাম এর বিরোধিতা করেছে এবং এ থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে। ইসলামে সুদকে হারাম ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে মানবজাতিকে শোষণমুক্ত একটি আর্থিক ব্যবস্থার দিকে আহ্বান জানানো হয়েছে।

২. সুদ সম্পর্কে কুরআনের আয়াত

কুরআনে সুদ সম্পর্কে কয়েকটি আয়াত বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ তাআলা সুদ গ্রহণের নিষিদ্ধতা, এর শাস্তি এবং প্রকৃত ব্যবসার মধ্যে পার্থক্য ব্যাখ্যা করেছেন।

সূরা আল-বাকারা: আয়াত ২৭৫ (আরবি ও অর্থ)

لَّذِیۡنَ یَاۡكُلُوۡنَ الرِّبٰوا لَا یَقُوۡمُوۡنَ اِلَّا كَمَا یَقُوۡمُ الَّذِیۡ یَتَخَبَّطُهُ الشَّیۡطٰنُ مِنَ الۡمَسِّ ؕ ذٰلِكَ بِاَنَّهُمۡ قَالُوۡۤا اِنَّمَا الۡبَیۡعُ مِثۡلُ الرِّبٰوا ۘ وَ اَحَلَّ اللّٰهُ الۡبَیۡعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا ؕ فَمَنۡ جَآءَهٗ مَوۡعِظَۃٌ مِّنۡ رَّبِّهٖ فَانۡتَهٰی فَلَهٗ مَا سَلَفَ ؕ وَ اَمۡرُهٗۤ اِلَی اللّٰهِ ؕ وَ مَنۡ عَادَ فَاُولٰٓئِكَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ

“যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, বেচা-কেনা সুদের মতই। অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হল, যা গত হয়েছে তা তার জন্যই ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাওলায়। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে” (সূরা আল-বাকারা: ২৭৫)

সুদ সম্পর্কে কুরআনের আয়াত
সুদ সম্পর্কে কুরআনের আয়াত

সূরা আল-বাকারা: আয়াত ২৭৮-২৭৯

يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اتَّقُوا اللّهَ وَذَرُوا مَا بَقِيَ مِنَ الْرُّبَا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ فَإِنْ لَمْ تَفْعَلُوا فَأْذِنُوا بِحَرْبٍ مِنَ اللّهِ وَرَسُولِهِ

“হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা কিছু বাকি আছে তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মুমিন হও। আর যদি তা না কর, তবে জেনে রাখ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা।” (সূরা আল-বাকারা: ২৭৮-২৭৯)

সূরা আলে ইমরান: আয়াত ১৩০

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا الرِّبَا أَضْعَافًا مُضَاعَفَةً وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

“হে মুমিনগণ, তোমরা সুদ খাবে না বহুগুণ বৃদ্ধি করে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফল হও।” (সূরা আলে ইমরান: ১৩০)

৩. সুদ ইসলামে হারামের কারণ

ইসলামে সুদকে হারাম ঘোষণা করার পেছনে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং নৈতিক কারণ রয়েছে।

৩.১. ধনী-গরিবের ব্যবধান বৃদ্ধি

সুদের মাধ্যমে ধনী ব্যক্তিরা আরও ধনী হয়ে ওঠে এবং গরিবেরা আরও গরিব হয়ে পড়ে। এটি সমাজে আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি করে।

৩.২. শোষণমূলক ব্যবস্থা

সুদের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতার উপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি হয়, যা অনেক সময় অসহনীয় হয়ে ওঠে। সুদের বোঝা অনেক পরিবারকে দারিদ্র্যের চক্রে ফেলে দেয়।

৩.৩. সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব

সুদভিত্তিক অর্থনীতি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিঘ্নিত করে এবং দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক সংকটের কারণ হয়।

৩.৪. নৈতিক অবক্ষয়

সুদ নৈতিক মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি আত্মকেন্দ্রিকতা এবং লোভকে উৎসাহিত করে।

৪. সুদ বনাম ব্যবসা

কুরআনে ব্যবসাকে হালাল করা হয়েছে এবং সুদকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। ব্যবসা একটি ন্যায্য লেনদেন প্রক্রিয়া যেখানে উভয় পক্ষ লাভবান হয়। বিপরীতে, সুদ হলো একতরফা লাভের পদ্ধতি। ব্যবসা সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখে, কিন্তু সুদ কেবলমাত্র কিছু ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষা করে।

৫. সুদ থেকে বাঁচার উপায়

সুদ থেকে বাঁচার জন্য ইসলাম আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছে।

  • হালাল ব্যবসা এবং বিনিয়োগে অংশগ্রহণ: লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে ব্যবসায় অংশগ্রহণ করা।
  • ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা গ্রহণ করা: সুদমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থার ব্যবহার।
  • প্রয়োজন অনুসারে ঋণ নেওয়া: অতিরিক্ত ঋণ এড়িয়ে চলা।
  • সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা: অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে সঞ্চয়ের মাধ্যমে আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জন।

৬. ইসলামিক ব্যাংকিং: সুদের বিকল্প

ইসলামিক ব্যাংকিং এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে সুদের পরিবর্তে লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে লেনদেন করা হয়। এর মাধ্যমে আর্থিক শোষণ বন্ধ হয় এবং একটি ন্যায্য আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

৭. সুদ বিষয়ে হাদিস

রাসুলুল্লাহ (সা.) সুদ সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন:

“আল্লাহ সুদ গ্রহণকারী, প্রদানকারী, লেখক এবং সাক্ষী সকলের উপর অভিশাপ দিয়েছেন।” (সহীহ মুসলিম)

এই হাদিসে সুদের সাথে জড়িত সকল পক্ষের জন্য কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে।

৮. সুদের শাস্তি

কুরআন ও হাদিসে সুদের শাস্তি অত্যন্ত কঠোরভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সমতুল্য।

৯. আধুনিক প্রেক্ষাপটে সুদের প্রভাব

বর্তমান সময়ে সুদভিত্তিক অর্থনীতি বৈষম্য বৃদ্ধি এবং আর্থিক অস্থিতিশীলতার অন্যতম কারণ। ঋণগ্রস্ত দেশ ও ব্যক্তি উভয়ই সুদের কারণে বড় ধরনের আর্থিক সংকটে পড়ে। সুদমুক্ত আর্থিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এই সমস্যাগুলোর সমাধান হতে পারে।

১০. উপসংহার

সুদ ইসলামি অর্থনীতির মূল শত্রু। কুরআন ও হাদিসে সুদকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে এবং এটি থেকে বিরত থাকার কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো আল্লাহর আদেশ মেনে চলা এবং সুদ থেকে নিজেকে এবং সমাজকে মুক্ত রাখা। সুদমুক্ত অর্থনীতি শুধু ব্যক্তি নয়, বরং সমাজের সামগ্রিক কল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারে।

সাধারণ প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১: সুদ কীভাবে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করে?

উত্তর: সুদ ধনীদের আরও ধনী করে এবং গরিবদের ঋণগ্রস্ত করে, যা আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি করে।

প্রশ্ন ২: সুদ ও ব্যবসার মধ্যে কী পার্থক্য?

উত্তর: ব্যবসায় লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে লেনদেন হয়, যেখানে উভয় পক্ষ উপকৃত হয়। সুদে একপক্ষ লাভবান হয় এবং অপর পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

প্রশ্ন ৩: ইসলামে সুদ গ্রহণ বা প্রদানকারীর শাস্তি কী?

উত্তর: কুরআনে বলা হয়েছে, যারা সুদ গ্রহণ বা প্রদান করে তারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে।

প্রশ্ন ৪: ইসলামিক ব্যাংকিং কীভাবে কাজ করে?

উত্তর: ইসলামিক ব্যাংকিং মুনাফা-লোকসানের ভিত্তিতে কাজ করে এবং সুদকে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলে।

প্রশ্ন ৫: কুরআনে সুদের বিরুদ্ধে এত কঠোর নির্দেশ কেন?

উত্তর: সুদ শোষণমূলক এবং এটি সমাজের ন্যায্যতা ও সাম্য নষ্ট করে।


Share this post