আল্লাহু নুরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ ” (الله نور السماوات والأرض) – এর আয়াতের ফজিলত বিষয়ক একটি ব্লগপোস্টে আমরা এখানে পাবলিশ করছি।
পবিত্র কুরআন আল্লাহর গুণাবলী ও সিফত বর্ণনায় অনন্য। এর মধ্যে এক অসাধারণ আয়াত হলো –
“اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ”
“আল্লাহ আসমান ও জমিনের নূর।” (সূরা নূর, আয়াত ৩৫)
এই আয়াত কেবল শব্দের সৌন্দর্যেই নয়, অর্থের গভীরতায়ও হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আল্লাহকে “নূর” বলা মানে শুধু আলো নয়, বরং হেদায়াত, জ্ঞান, সত্তার অস্তিত্বের উৎস – সবকিছুর সমষ্টি। এ আয়াত তাফসিরকারগণ বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর মহানত্ব ও করুণা আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি।
বিশেষত, এই আয়াত পাঠ, আমল ও এর উপর চিন্তাভাবনা মানুষের অন্তরে আলোকিত বিশ্বাস সৃষ্টি করে, অন্ধকার দূর করে, জীবনে হেদায়াতের পথ দেখায়। এ আয়াতের ফজিলত ও তাৎপর্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, অনেক আলিম এই আয়াতের বিশেষ আমলের কথাও উল্লেখ করেছেন।
আজকের এই ব্লগপোস্টে আমরা জানব –
✅ “আল্লাহু নূরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ” আয়াতের ফজিলত,
✅ এর গভীর তাফসির ও ব্যাখ্যা,
✅ এবং আমাদের জীবনে এর প্রভাব ও উপকারিতা।
আসুন, আল্লাহর এই “নূর”-এর আলোয় নিজেদের অন্তর আলোকিত করি।
আল্লাহু নূরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ এর ফজিলত
কুরআনের আলোয় আল্লাহর নূর
আয়াতের আরবি ও বাংলা উচ্চারণ
“ আল্লাহু নুরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ “বাংলা উচ্চারণ এবং বাংলা অর্থ দিলাম —
” আয়াতের আরবি লেখা, বাংলা উচ্চারণ এবং বাংলা অর্থ দিলাম —
✅ আরবি:
اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ
✅ বাংলা উচ্চারণ: “আল্লাহু নূরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ।”
✅ বাংলা অর্থ: “আল্লাহ আসমান ও জমিনের নূর।”
পবিত্র কুরআনের প্রতিটি আয়াত যেমন জ্ঞানের আলো, তেমনই আল্লাহর মহিমা ও করুণার ঘোষণা। সূরা নূরের এক অনন্য আয়াত—
اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ
“আল্লাহ আসমান ও জমিনের নূর।” (সূরা নূর, আয়াত ৩৫)
এই আয়াতকে বলা হয় “আয়াতুন নূর”। শুধু শব্দের সৌন্দর্যেই নয়, এর অর্থের গভীরতায়ও এটি মুসলিম হৃদয়ে আলাদা স্থান করে নিয়েছে। আল্লাহকে নূর বলা মানে একদিকে জাগতিক আলো, আবার আধ্যাত্মিক হেদায়াতের মূল উৎস। এই আয়াত পাঠ, আমল ও এর উপর গভীর চিন্তাভাবনা মানুষের অন্তরকে আলোকিত করে, জীবনের পথে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়।
আয়াতের বিশ্লেষণ : “আল্লাহ নূর” মানে কী?
“আল্লাহু নুরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ” আয়াতের অর্থ শুধু ‘আলো’ নয়। ইসলামী তাফসিরকারগণ ব্যাখ্যা করেছেন—
- অস্তিত্বের নূর : আল্লাহ ছাড়া কোনো সৃষ্টিই অস্তিত্ব লাভ করতে পারে না। তিনিই সব সৃষ্টির মূল।
- হেদায়াতের নূর : তিনি মানুষের অন্তরকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসেন।
- জ্ঞান ও চেতনার নূর : আল্লাহর নূর মানুষকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করে।
- আধ্যাত্মিক প্রশান্তির নূর : অন্তরকে শান্তি ও দৃঢ়তা দান করে।
ইমাম ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন, “আল্লাহর নূর এমন, যা দিয়ে তিনি সমস্ত আসমান ও জমিনকে জ্ঞান, হিকমত ও হেদায়াতের আলোয় আলোকিত করেছেন।”
৩. এই আয়াতের ফজিলত
এই আয়াতের অনেক ফজিলত বিভিন্ন বুজুর্গ ও আলেমের কাছ থেকে জানা যায়, যেমন—
- অন্তরের অন্ধকার দূর করে ঈমানের আলো সৃষ্টি করে।
- ভয়, দুশ্চিন্তা ও বিপদে পড়লে শান্তি এনে দেয়।
- হৃদয়ে হেদায়াতের আলো ছড়িয়ে দেয়।
- গুনাহের প্রতি ঘৃণা ও নেক আমলের প্রতি ভালোবাসা জাগায়।
- দোয়া কবুলের ক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে (যদিও নির্দিষ্ট সহিহ হাদিস নেই, তবে বহু অভিজ্ঞতায় মুসলিমগণ উপকার পেয়েছেন)।
তবে সরাসরি সহিহ হাদিসে নির্দিষ্ট কোনো ফজিলত কম পাওয়া যায়। তবুও বহু মুসলিমের আত্মিক জীবনে এই আয়াত বিশেষ প্রভাব ফেলেছে।
জীবনে এই আয়াতের আমল ও উপকারিতা
এই আয়াতের আমল জীবনে অনেক উপকার করতে পারে। যেমন—
✅ নিয়মিত তেলাওয়াত : প্রতিদিন অন্তত কয়েকবার আয়াতটি পড়লে অন্তর প্রশান্ত হয়।
✅ দোয়ার মধ্যে সংযুক্তি : দোয়া করার সময় এই আয়াত পড়ে আল্লাহর নূরের সাহায্য চাওয়া যায়।
✅ কষ্ট বা বিপদে পাঠ : মানসিক অশান্তি, ভয় বা দুশ্চিন্তায় আয়াতটি পড়া উপকারী।
✅ স্মরণে রাখা : আল্লাহই নূর—এ ভাবনা অন্তরে আধ্যাত্মিক শক্তি জাগায়।
অনেক বুজুর্গ বলেছেন, “যার অন্তর অন্ধকারে ঢাকা, সে যেন আল্লাহর নূরের দিকে ফিরে আসে। আয়াতুন নূর পড়া সেই পথে এক শক্তিশালী সেতু।”
শানে নুযূল (নাজিলের প্রেক্ষাপট) সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
- সূরা নূর মূলত সমাজের নৈতিকতা, পবিত্রতা, পর্দা, এবং পরিবার-সংক্রান্ত বিধান নিয়ে নাজিল হয়েছে। এর আগে সূরায় মিথ্যা অপবাদ, ব্যভিচারের শাস্তি, গিবত থেকে বাঁচার নির্দেশনা ইত্যাদি এসেছে।
- এসব গুণাহ ও অন্ধকার থেকে মুসলিম সমাজকে আলোর পথে আনার জন্য আল্লাহ নিজের পরিচয় দিয়েছেন “নূর” হিসেবে। এভাবে বোঝানো হয়েছে যে, সব সত্য, পবিত্রতা, এবং হেদায়াতের মূল উৎস আল্লাহই।
- অনেক মুফাসসির বলেছেন, এই আয়াত সমাজের অশ্লীলতা ও অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করার কুরআনের লক্ষ্যকে স্পষ্ট করে।
- তাফসির ইবনে কাসীর, তাফসির যালালাইনসহ বিভিন্ন তাফসিরে বলা হয়েছে, এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ নিজের সিফত (গুণাবলী) বর্ণনা করেছেন, যেন মানুষ তাঁর দিকে ফিরে আসে এবং সত্যের আলো গ্রহণ করে।
সরাসরি কোনো ঘটনা কেন্দ্র করে এ আয়াত নাজিল হয়নি, বরং এটি একটি সাধারণ আধ্যাত্মিক ও নৈতিক নির্দেশনা।
✅ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক:
অনেক মুফাসসির বলেছেন, আল্লাহর “নূর” হওয়ার বিষয়টি আধ্যাত্মিক অর্থ বহন করে। যেমন:
- আল্লাহ সমস্ত সৃষ্টিকে জ্ঞান ও হেদায়াতের আলো দেন।
- আল্লাহর নূর অন্তরের অন্ধকার দূর করে।
- সমাজে ন্যায়, পবিত্রতা, ও সত্য প্রতিষ্ঠার উৎস আল্লাহর নূর।
✅ বিখ্যাত তাফসিরকারদের ব্যাখ্যা থেকে উদ্ধৃতি
ইমাম ইবনে কাসীর (রহ.)
“আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টির জন্য হেদায়াতের নূর, যেমন তিনি আসমান ও জমিনের নূর। তিনি সবকিছুকে জানেন, তাঁর নূরেই সবকিছু প্রকাশিত হয়, এবং তাঁর আলোয় মানুষ সত্য ও মিথ্যা চিনতে পারে।”
(তাফসির ইবনে কাসীর, সূরা নূর, আয়াত ৩৫)
ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী (রহ.)
“আল্লাহর নূর মানে তাঁর অস্তিত্ব, যিনি সমস্ত সৃষ্টিকে আলোকিত করেন। যেমন সূর্য দুনিয়াকে আলো দেয়, আল্লাহর নূর তেমনি অন্তরকে হেদায়াতের আলোয় ভরে দেয়। তিনি এমন এক আলো, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অন্তরে অনুভূত হয়।” (তাফসিরে কবীর, সূরা নূর, আয়াত ৩৫)
ইমাম কুরতুবী (রহ.)
“আল্লাহর নূর বলতে বুঝায় হেদায়াত, ইলম, এবং এমন এক শক্তি যা মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসে। আসমান ও জমিনের সমস্ত আলোক ও শৃঙ্খলা আল্লাহর ইচ্ছায় টিকে আছে।”
(তাফসিরে কুরতুবী, সূরা নূর, আয়াত ৩৫)
✅ আমলে নির্দিষ্ট সময়ের পরামর্শ
যদিও এই আয়াতের নির্দিষ্ট আমলের জন্য কোনো সহিহ হাদিস নেই, তবে অনেক আলেম ও বুজুর্গগণ তাদের অভিজ্ঞতা বা নসিহত থেকে কিছু সময় উল্লেখ করেছেন, যা মুসলিম সমাজে প্রচলিত:
- ফজর নামাজের পর ৩, ৫ বা ৭ বার পড়া
→ দিন শুরু হয় আল্লাহর নূরের বরকত নিয়ে। - রাতের নিস্তব্ধতায় তাসবীহের মতো পড়া
→ অন্তর প্রশান্ত হয়, দুশ্চিন্তা কমে। - বিপদ বা ভয় পেলে পাঠ করা
→ আল্লাহর নূরের সাহায্য চাওয়া যায়। - দোয়ার মধ্যে আয়াতটি সংযুক্ত করা
→ বিশেষভাবে হেদায়াত ও রাহমত প্রার্থনার সময়। - অন্তরের অন্ধকার দূর করতে
→ যখন মনে হয় ঈমান দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, তখন এ আয়াতের তেলাওয়াত অন্তর আলোকিত করতে পারে।
✅ সতর্কতা: এগুলো সরাসরি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত আমল নয়। বরং আলেমদের পরামর্শ বা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রচলিত। তাই এগুলোকে ফরজ বা ওয়াজিব মনে করা যাবে না। বরং নফল ইবাদতের মতো নিয়তে পড়তে পারো।
আল্লাহর নূরের আলোয় আলোকিত হই
আল্লাহু নূরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ—এই আয়াত আমাদের শিখিয়ে দেয়, আল্লাহই সব সৃষ্টির আলোকের উৎস, হেদায়াতের মূল। জীবনের অন্ধকার, দুঃসময়, হতাশা—সবকিছু আল্লাহর নূরের আলোয় দূর হতে পারে। কুরআন ও এই আয়াত আমাদের সেই আলোয় আলোকিত করে, যাতে আমরা সঠিক পথ চিনতে পারি, শান্তি পাই, এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারি।
আসুন, আমরা এই আয়াতের আলোয় নিজেদের অন্তরকে আলোকিত করি এবং আল্লাহর নূরের তলে শান্তি ও হেদায়াত লাভ করি।
আপনার আরো ভালো লাগতে পারে এমন কিছু পোস্ট।