আল্লাহু সামাদ এর ফজিলত । কুরআন ও হাদিসে যা রয়েছে।

পোস্টটি শেয়ার করুন

আল-কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার যে সকল গুণবাচক নাম রয়েছে, তার প্রতিটি নামের বিশেষ ফজিলত ও মর্যাদা রয়েছে। এই নামগুলো কেবল আল্লাহর মহিমা ও গুণাবলিই বর্ণনা করে না, বরং বান্দার ঈমান ও আমলের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ বহন করে। আল্লাহর ৯৯টি নামের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম হলো “আস-সামাদ” (الصمد)। এই ব্লগপোস্টে আমরা আলোচনা করবো আল্লাহু সামাদ নামের অর্থ, ব্যাখ্যা, এর ফজিলত ও আমাদের জীবনে এর প্রয়োগ কীভাবে হতে পারে।

আস-সামাদ শব্দটি সূরা ইখলাসের দ্বিতীয় আয়াতে এসেছে—

اللَّهُ الصَّمَدُ

“আল্লাহু সামাদ” (আল্লাহ হলেন নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল)।

এই নামের তাৎপর্য বিশাল। এটি আমাদের শেখায় যে, আল্লাহই সকল সৃষ্টির একমাত্র নির্ভরযোগ্য অবলম্বন, যিনি কারো মুখাপেক্ষী নন, বরং সবকিছু তাঁর ওপর নির্ভরশীল। এই নামে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ তাওয়াক্কুল (ভরসা) ও দাসত্ববোধ সৃষ্টি হয়।

আল্লাহু সামাদ এর ফজিলত

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনে নিজেকে “আস-সামাদ” (الصمد) নামে পরিচিত করেছেন, যার অর্থ— তিনি নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল, যিনি কারো মুখাপেক্ষী নন বরং সবকিছু তাঁর ওপর নির্ভরশীল। এই নামের গভীর তাৎপর্য ও ফজিলত রয়েছে, যা একজন মুমিনের ঈমান ও জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। নিচে “আল্লাহু সামাদ” নামের কিছু ফজিলত উল্লেখ করা হলো—

১. আল্লাহর একত্ব ও অমুখাপেক্ষীতার প্রমাণ

আল্লাহু সামাদ হওয়ার অর্থ হলো, তিনি সম্পূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং কাউকে তাঁর সাহায্যের প্রয়োজন নেই। বরং সমস্ত সৃষ্টিজগত তাঁর ওপর নির্ভরশীল। এটি তাওহিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা আমাদেরকে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা ও নির্ভরতা শেখায়।

২. যে ব্যক্তি সূরা ইখলাস পড়ে, সে তাওহিদে দৃঢ় হয়

রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন—

“সুরা ইখলাস কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমতুল্য।” 📖 (সহিহ বুখারি: ৫০১৩, সহিহ মুসলিম: ৮১১)

যে ব্যক্তি সূরা ইখলাস পড়ে, সে আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য দেয় এবং তাঁর “আস-সামাদ” নামের মাধ্যমে আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা স্থাপন করে। এটি তাওহিদের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক।

৩. আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরতা গঠনের শিক্ষা

আস-সামাদ নামের মূল শিক্ষা হলো, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভর করা। তিনি ছাড়া অন্য কেউ প্রকৃত উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না। হাদিসে এসেছে—

“যদি তোমরা আল্লাহর ওপর যথাযথ ভরসা কর, তবে তিনি তোমাদের এমনভাবে রিজিক দেবেন, যেমন পাখিদের দেন; তারা সকালবেলা ক্ষুধার্ত বের হয় এবং সন্ধ্যায় তৃপ্ত হয়ে ফিরে আসে।” 📖 (তিরমিজি: ২৩৪৪, ইবনে মাজাহ: ৪১৬৪)

৪. দুঃসময় ও বিপদে আল্লাহর সাহায্য লাভের উপায়

যখন কেউ কঠিন বিপদে পড়ে, তখন তাকে একমাত্র আল্লাহর দ্বারস্থ হতে হয়। “আল্লাহু সামাদ” নামটি আমাদের শেখায় যে, সকল প্রয়োজনের একমাত্র পূরণকারী আল্লাহ। যারা এই বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করে, তারা তাঁর সাহায্য লাভ করে।

৫. অন্তরের প্রশান্তি ও দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্তি

যে ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে “আল্লাহু সামাদ” বুঝতে পারে, সে মানুষের ওপর নির্ভর করা বাদ দিয়ে একমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভর করতে শিখে। ফলে তার অন্তর প্রশান্ত হয়, দুনিয়ার মোহ তাকে আর তেমন প্রভাবিত করতে পারে না।

আরো পড়ুন:

আল্লাহু সামাদ: তাফসিরমূলক বিশ্লেষণ

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা কুরআনে সূরা ইখলাসে বলেছেন—

اللَّهُ الصَّمَدُ

“আল্লাহু সামাদ” (আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, সকল সৃষ্টির একমাত্র আশ্রয়স্থল)। 📖 (সূরা ইখলাস: ২)

এই আয়াত সংক্ষেপে হলেও অত্যন্ত গভীর তাৎপর্য বহন করে। উলামায়ে কিরাম এই আয়াতের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত তাফসির করেছেন। আসুন, আমরা “আস-সামাদ” নামের অর্থ, এর বিশ্লেষণ, এবং এর উপর ভিত্তি করে আমাদের করণীয় সম্পর্কে জানি।

১. “আস-সামাদ” শব্দের ভাষাগত বিশ্লেষণ

ক. সামাদ শব্দের শাব্দিক অর্থ

আরবি ভাষায় “الصمد” (আস-সামাদ) শব্দের মূল অর্থ হলো—

  • অমুখাপেক্ষী, যিনি কারও উপর নির্ভরশীল নন।
  • অভিজাত নেতা, যিনি সবকিছুর মালিক ও নিয়ন্ত্রক।
  • আশ্রয়স্থল, যার কাছে মানুষ তার প্রয়োজন নিয়ে যায়।

খ. আরবি অভিধানে সামাদের অর্থ

ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন:

“আস-সামাদ” অর্থ— যিনি চিরস্থায়ী ও মহাপরাক্রমশালী, যিনি কারো মুখাপেক্ষী নন।

মুজাহিদ (রহ.) বলেন:

“সামাদ” হলেন সেই সত্তা, যিনি চিরস্থায়ী এবং যিনি খাওয়া-দাওয়া, পান করা বা কোনো প্রয়োজনের মুখাপেক্ষী নন।

ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন:

“আস-সামাদ” অর্থ— যিনি সম্পূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং যার কাছে মানুষ তাদের প্রয়োজন নিয়ে যায়।

২. কুরআন ও হাদিসের আলোকে “আস-সামাদ”

(ক) আল্লাহর একত্ব ও পরিপূর্ণতা প্রমাণ করে

  • “আল্লাহু সামাদ” বলার অর্থ হলো, আল্লাহর কোনো ঘাটতি নেই এবং তিনি সবকিছুর উপরে ও নিয়ন্ত্রক। এর দ্বারা বুঝা যায়—
  • আল্লাহর কোনো শরীক নেই।
  • আল্লাহর কোনো সীমাবদ্ধতা নেই।
  • আল্লাহর ক্ষমতা, জ্ঞান ও নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ।

এ কারণেই সূরা ইখলাসকে তাওহিদের মূলসূত্র বলা হয়। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:

“সূরা ইখলাস কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমতুল্য।” 📖 (সহিহ বুখারি: ৫০১৩, সহিহ মুসলিম: ৮১১)

(খ) দুনিয়ার সবকিছু ধ্বংসশীল, আল্লাহ ব্যতীত

আল্লাহ বলেন—

“আল্লাহ ছাড়া সবকিছু ধ্বংসশীল, তিনিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তদাতা।” 📖 (সূরা কাসাস: ৮৮)

যেহেতু আল্লাহই “সামাদ”, তাই তিনি একমাত্র অমর ও চিরস্থায়ী। সবকিছু একদিন শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আল্লাহর অস্তিত্ব ও ক্ষমতা চিরন্তন।

(গ) সকল সৃষ্টির একমাত্র আশ্রয়স্থল

আল্লাহ বলেন—

“তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।” 📖 (সূরা গাফির: ৬০)

কেউ বিপদে পড়লে, দুঃখ-দুর্দশায় থাকলে— সে আল্লাহর দিকেই ফিরে যায়, কারণ একমাত্র তিনিই “আস-সামাদ”। এমনকি কাফেররাও দুঃসময়ে আল্লাহকে ডাকে।

৩. আমাদের জীবনে “আস-সামাদ” নামের প্রভাব ও শিক্ষা

(ক) একমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভর করা

“আল্লাহু সামাদ” আমাদের শিক্ষা দেয় যে, মানুষ নয়, বরং একমাত্র আল্লাহই আমাদের প্রয়োজন পূরণ করতে পারেন। তাই কোনো সমস্যায় আমরা মানুষের কাছে না গিয়ে, সরাসরি আল্লাহর কাছে দোয়া করব।

(খ) দুনিয়ার চাওয়া-পাওয়া থেকে মুক্ত থাকা

যে ব্যক্তি “আস-সামাদ” নামের অর্থ বুঝবে, সে দুনিয়ার লোভে পতিত হবে না। সে জানবে, একমাত্র আল্লাহই রিজিকদাতা, মানুষ নয়।

(গ) আল্লাহর ইবাদতে দৃঢ় হওয়া

যেহেতু আল্লাহই চিরস্থায়ী ও শক্তিশালী, তাই আমাদের উচিত একমাত্র তাঁরই ইবাদত করা এবং তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া।

আল্লাহু সামাদ এর ফজিলত ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর

১. “আল্লাহু সামাদ” এর অর্থ কী?

📌 উত্তর: “আল্লাহু সামাদ” অর্থ হলো— আল্লাহ অমুখাপেক্ষী ও চিরস্থায়ী আশ্রয়স্থল। তিনি নিজে কারো ওপর নির্ভরশীল নন, বরং সমস্ত সৃষ্টিজগত তাঁর ওপর নির্ভরশীল।

২. “আস-সামাদ” নামটি কুরআনের কোথায় এসেছে?

📌 উত্তর: এই নামটি সূরা ইখলাসের দ্বিতীয় আয়াতে এসেছে—

اللَّهُ الصَّمَدُ

📖 (সূরা ইখলাস: ২)

৩. “আস-সামাদ” নামের ব্যবহারিক শিক্ষা কী?

📌 উত্তর: এই নাম থেকে আমাদের শিক্ষা হলো—

  • ✅ একমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভর করা।
  • ✅ মানুষের পরিবর্তে আল্লাহর কাছে দোয়া করা।
  • ✅ দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্ত থাকা।

৪. “আল্লাহু সামাদ” বলা কি দোয়ার অংশ হতে পারে?

📌 উত্তর: হ্যাঁ, আমরা দোয়ার মধ্যে আল্লাহর এই নাম ব্যবহার করতে পারি, যেমন:

اللهم يا صمد، اقض حاجتي

“হে আল্লাহ, যিনি সামাদ, আপনি আমার প্রয়োজন পূরণ করুন।”

৫. “আস-সামাদ” নামের সঙ্গে তাওহিদের সম্পর্ক কী?

📌 উত্তর: “আস-সামাদ” নামটি আল্লাহর একত্ববাদের (তাওহিদের) শক্তিশালী প্রমাণ। কারণ এটি প্রমাণ করে যে,

  • আল্লাহর কোনো শরীক নেই।
  • তিনিই একমাত্র প্রয়োজন পূরণকারী।
  • সবকিছু ধ্বংসশীল, কিন্তু আল্লাহ চিরস্থায়ী।

৬. “আল্লাহু সামাদ” বোঝার মাধ্যমে আমাদের আমলে কী পরিবর্তন আসতে পারে?

📌 উত্তর: এই নাম বোঝার মাধ্যমে—

  • 🔹 আমরা সব সমস্যায় মানুষের পরিবর্তে আল্লাহর ওপর নির্ভর করব।
  • 🔹 আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করব।
  • 🔹 দুনিয়ার লোভ-লালসা থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করব।

পোস্টটি শেয়ার করুন