ইসলামে পবিত্রতা কিছু ইবাদতের পূর্বশর্ত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মুসলমানদের জন্য ইবাদত শুরুর আগে পবিত্রতার আদেশ দিয়েছেন। আর ওযু এমন একটি ইবাদত, যা শুধু দেহকে নয়, আত্মাকেও পরিশুদ্ধ করে। নামাজ, তাওয়াফ, কুরআন তিলাওয়াতসহ অনেক ইবাদতের জন্য ওযু অপরিহার্য। এই পোস্টে আমরা ওযু শব্দের অর্থ, সংজ্ঞা, বৈধতার দলিল এবং এর ফজিলত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
পবিত্র কুরআন, হাদিস ও ইসলামি স্কলারদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ওযু ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান। ওযু মানুষকে দৈনন্দিন জীবনের ছোট-ছোট গুনাহ মুছন করে, তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে এবং জান্নাতের পথে নিয়ে যায়।
ওযু শব্দের অর্থ কি?
ওযু শব্দের অর্থ: পরিচ্ছন্নতা ও উজ্জ্বলতা। আরবিতে “الوضوء” (ওজু) শব্দটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়:
- (الوُضوء – উওজু): কাজ বা প্রক্রিয়া।
- (الوَضوء – আল-ওয়াদু): ওজুর জন্য ব্যবহৃত পানি।
দুটি আলাদা শব্দ হলেও কখনো কখনো একই অর্থ প্রকাশ করে। এটি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যা পবিত্রতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয়।
ওজুর পারিভাষিক সংজ্ঞা
শরীয়তের পরিভাষায়: ওজু হল নির্দিষ্ট অঙ্গসমূহে (মুখমণ্ডল, দুই হাত, মাথা, এবং দুই পা) পানি ব্যবহার করা। এর দ্বারা এমন বিষয় দূর করে যা নামাজ বা এ ধরনের ইবাদতে বাধা সৃষ্টি করে।
ওজুর বৈধতার প্রমাণ
কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমা দ্বারা ওজুর বৈধতা প্রমাণিত।
(ক) কুরআন থেকে প্রমাণ: আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلاةِ فاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوا بِرُؤُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَينِ
“হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নামাজের জন্য প্রস্তুত হবে, তখন তোমাদের মুখমণ্ডল এবং কনুই পর্যন্ত দুই হাত ধুয়ে নাও এবং মাথা মাসাহ করো এবং দুই টাখনু পর্যন্ত পা ধুয়ে নাও।” (সূরা মায়িদাহ: ৬)
(খ) সুন্নাহ থেকে প্রমাণ
১. আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“তোমাদের কেউ অপবিত্র (হাদাস) হলে, তার নামাজ কবুল হবে না, যতক্ষণ না সে ওজু করে।” (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)
২. ইবনে উমর (রা.) বলেন:
“আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) – কে বলতে শুনেছি: ‘আল্লাহ পবিত্রতা ছাড়া নামাজ গ্রহণ করেন না এবং চুরির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ থেকে কোনো দান-সদকা গ্রহণ করেন না।’ (সহীহ মুসলিম)
৩. ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“ নামাজে দাঁড়ানোর সময় আমাকে ওজু করার জন্য আমাকে আদেশ দেওয়া হয়েছে।” (সহীহ মুসলিম)
৪. আবু সাঈদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন:
“নামাজের চাবি হল পবিত্রতা, নামাজ শুরু হয় তাকবির দিয়ে এবং শেষ হয় সালামের মাধ্যমে।” (সহীহ আবু দাউদ)
ওযুর ফজিলত
পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক
আবু মালিক আশআরী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“পবিত্রতা হল ঈমানের অর্ধেক….”(সহীহ মুসলিম)
ওজু ছোট গুনাহ মোচন করে
১. আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যখন কোনো মুসলিম বা মুমিন বান্দা ওজু করে, তখন সে তার মুখমণ্ডল ধোয়ার সাথে সাথে তার চোখ দিয়ে করা প্রতিটি গুনাহ পানি বা পানির শেষ ফোঁটার সাথে বের হয়ে যায়। যখন সে তার হাত ধোয়, তখন তার হাত দিয়ে করা প্রতিটি গুনাহ পানি বা পানির শেষ ফোঁটার সাথে বের হয়ে যায়। যখন সে তার পা ধোয়, তখন তার পা দিয়ে চলা প্রতিটি গুনাহ পানি বা পানির শেষ ফোঁটার সাথে বের হয়ে যায়। এভাবে সে গুনাহ থেকে সম্পূর্ণ পরিশুদ্ধ হয়ে যায়।” (সহীহ মুসলিম)
২. উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি এইভাবে ওজু করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হয়, এবং তার নামাজ ও মসজিদে যাওয়া তার জন্য অতিরিক্ত সওয়াব নিয়ে আসে।” (সহীহ মুসলিম)
৩. এই ফজিলত বিশেষভাবে প্রযোজ্য যখন কেউ এই ওজুর পরে ফরজ বা নফল নামাজ আদায় করে।
উসমান (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি আমার মতো ওজু করে, তারপর দুই রাকাত নামাজ পড়ে এবং তাতে নিজের মনোযোগ বিঘ্নিত না করে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হয়।” (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)
ওজু বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করে
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“আমি কি তোমাদের এমন কাজ সম্পর্কে জানাব, যা আল্লাহ গুনাহ মোচন করেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করেন?” তারা বললেন: ‘অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসূল, তিনি বললেন: ‘কষ্টকর অবস্থায় পরিপূর্ণ ওজু করা, মসজিদে যাওয়ার জন্য বেশি বেশি পদক্ষেপ নেওয়া, এবং এক নামাজের পর আরেক নামাজের অপেক্ষায় থাকা। এটিই হলো দৃঢ় অবস্থান, এটিই দৃঢ় অবস্থান, এটিই দৃঢ় অবস্থান।’ (সহীহ মুসলিম)
ওজু জান্নাতের পথ প্রদর্শক
১. আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বিলাল (রা.) – কে বললেন,
*“হে বিলাল, আমাকে তোমার এমন কোনো কাজের কথা বলো, যা তুমি ইসলামে সবচেয়ে আশাবাদী মনে করো। আমি জান্নাতে তোমার জুতো পড়ার শব্দ শুনেছি।”
বিলাল (রা.) বললেন:
“আমি যেকোনো সময় রাতে বা দিনে পবিত্রতা অর্জন করলে, ওই পবিত্রতা দিয়ে আমি যতটুকু সম্ভব নামাজ পড়ে নিই।” (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)
এটি জান্নাতের পথে নিয়ে যায়
১. আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বিলাল (রা.)-কে বললেন,
“হে বিলাল, আমাকে তোমার এমন কোনো কাজ সম্পর্কে বলো, যা তুমি ইসলামে সবচেয়ে আশাবাদী মনে করো। কেননা আমি জান্নাতে তোমার জুতোর শব্দ শুনেছি।” বিলাল (রা.) বললেন: “আমি যেকোনো সময় দিনে বা রাতে পবিত্রতা অর্জন করলে, সেই পবিত্রতা দিয়ে যতটুকু সম্ভব নামাজ আদায় করি।” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
২. হউকবা ইবনে আমির (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি:
“যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওজু করে, তারপর মনোযোগ সহকারে দুই রাকাত নামাজ সম্পন্ন করে, তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে যায়।” (সহীহ মুসলিম)
ওজু এই উম্মতের পরিচায়ক
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) একবার কবরস্থানে গিয়ে বললেন:
“হে মুমিনদের বাসস্থান, তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আমরাও অচিরেই তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব, ইনশাআল্লাহ। আমি আশা করতাম, যদি আমাদের ভাইদের দেখতে পারতাম।”
সাহাবারা বললেন: “আমরা কি আপনার ভাই নই, হে আল্লাহর রাসূল?”
তিনি বললেন: “তোমরা আমার সাহাবি; কিন্তু আমার ভাইরা হলো তারা, যারা এখনো আসেনি।”
তারা বলল: “হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কীভাবে আপনার উম্মতের মধ্যে থেকে তাদের চিনবেন, যারা এখনও আসেনি?”
তিনি বললেন: “একজন মানুষের কাছে সাদা মুখ এবং পায়ের ঘোড়া থাকলে কি সে সহজেই তার ঘোড়া চিনতে পারবে না?” তারা বলল: “অবশ্যই চিনতে পারবে, হে আল্লাহর রাসূল।”
তিনি বললেন: “আমার উম্মত ওজুর কারণে মুখমণ্ডল ও হাত-পায়ের আলো দ্বারা আলোকিত হয়ে আসবে। আমি তাদেরকে হাউজে স্বাগত জানাবো। কিন্তু কিছু মানুষকে হাউজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে, যেমন পথহারা উট তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তখন আমি বলব: ‘তোমরা এগিয়ে আসো।’ কিন্তু বলা হবে: ‘তারা তোমার পরে পথ পরিবর্তন করেছে।’ তখন আমি বলব: ‘ধ্বংস হোক তারা, ধ্বংস হোক!’” (সহীহ মুসলিম)
গুররাহ: ঘোড়ার কপালে যে সাদা উজ্জ্বল দাগ থাকে, তাকে গুররাহ বলা হয়। এখানে গুররাহ বলতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের মুখমণ্ডলের সেই আলোকিত অবস্থাকে বোঝানো হয়েছে, যা ওজুর কারণে কিয়ামতের দিন হবে।
তাহজিল: ঘোড়ার তিনটি পায়ে থাকা সাদা দাগকে তাহজিল বলা হয়। এখানে তাহজিল দ্বারা উদ্দেশ্য, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মতের হাত-পা ওজুর কারণে যে আলোকিত হবে, সেটি।
কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য আলো হবে
আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, আমি আমার প্রিয় রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি:
‘(জান্নাতে) মুমিনের অলংকার অর্থাৎ- ওযুর চিহ্ন সে পর্যন্ত পৌঁছবে যে পর্যন্ত ওযুর পানি পৌঁছবে।” (সহীহ মুসলিম)
শয়তানের গাঁট খুলে দেয়
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
“তোমাদের কেউ যখন ঘুমায়, তখন শয়তান তার মাথার পেছনে তিনটি গাঁট বেঁধে দেয় এবং প্রতিটি গাঁটে বলে: ‘তোমার রাত দীর্ঘ, শুয়ে থাকো।’
যখন সে জেগে উঠে আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন একটি গাঁট খুলে যায়। যখন সে ওজু করে, আরেকটি গাঁট খুলে যায়। যখন সে নামাজ আদায় করে, তখন বাকি গাঁটও খুলে যায়। ফলে সে সকালের শুরুতে উদ্যমী ও চাঙ্গা থাকে। আর যদি তা না করে, তবে সে অলস ও বিষণ্ন অবস্থায় সকাল শুরু করে।” (সহীহ বুখারি ও মুসলিম)