ঘুমানোর আগে কিছু বিশেষ আমল ও দোয়া রয়েছে, যা আমাদের রাতকে নিরাপদ ও প্রশান্তিময় করে তোলে। ইসলাম আমাদের প্রতিটি কাজেই সওয়াব অর্জনের সুযোগ দিয়েছে, এমনকি ঘুমানোর মধ্যেও। প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘুমানোর আগে কিছু সুন্নত আমল ও দোয়া শিখিয়ে গেছেন, যা আমাদেরকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করে এবং আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায় করে তোলে।
এই আমলগুলো শুধুমাত্র নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য নয়, বরং পরকালের সঞ্চয় হিসেবেও কাজ করে। তাই, ঘুমানোর আগে কিছু সময় নিয়ে যদি আমরা এই আমলগুলো পালন করি, তাহলে আমাদের রাত শুধু বিশ্রাম নয়, বরং ইবাদতের অংশে পরিণত হবে। আসুন, আমরা ঘুমানোর আগে আমল করার অভ্যাস গড়ে তুলি এবং জীবনকে আরও বরকতময় করি।
ঘুমানোর আগে আমল
১. ঘুমানোর সুন্নত দোয়া পড়া
নবী ﷺ ঘুমানোর আগে বিশেষ কিছু দোয়া পড়তেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো:
اللهم أسلمت نفسي إليك، وفوضت أمري إليك، ووجهت وجهي إليك، وألجأت ظهري إليك، رغبة ورهبة إليك، لا ملجأ ولا منجأ منك إلا إليك، آمنت بكتابك الذي أنزلت، وبنبيك الذي أرسلت
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আসলামতু নাফসী ইলাইকা, ওয়া ফাওওয়াদ্তু আমরী ইলাইকা, ওয়া ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহী ইলাইকা, ওয়া আলজাআতু যাহরী ইলাইকা, রাগবাতাওঁ ওয়া রাহবাতাওঁ ইলাইকা, লা মালজা ওয়া লা মানজা মিনকা ইল্লা ইলাইকা, আমানতু বিকিতাবিকাল্লাযী আনযালতা, ওয়া বিনাবিয়্যিকাল্লাযী আরসালতা।
অর্থ: “হে আল্লাহ, আমি আমার প্রাণ তোমার কাছে সমর্পণ করলাম, আমার সব কাজ তোমার উপর ছেড়ে দিলাম, আমার মুখ তোমার দিকে ফিরিয়ে দিলাম, আমার পিঠ তোমার কাছে সমর্পণ করলাম, তোমার প্রতি আশা ও ভয় নিয়ে। তোমার শাস্তি থেকে বাঁচার কোনো জায়গা নেই এবং তোমার আযাব থেকে রক্ষার কোনো স্থান নেই, কেবল তোমার কাছেই। আমি তোমার সেই কিতাবে (কুরআন) বিশ্বাস স্থাপন করলাম, যা তুমি অবতীর্ণ করেছ এবং তোমার সেই নবীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম, যাকে তুমি পাঠিয়েছ।” (সহিহ বুখারি: ২৪৭)
২. আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া বলা
اللهم بسمك أموت وأحيا
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া।
অর্থ: “হে আল্লাহ! তোমার নামে আমি মারা যাই এবং তোমার নামে জীবিত হই।” (সহিহ বুখারি: ৬৩২৪)
৩. আয়াতুল কুরসি পড়া
নবী ﷺ বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঘুমানোর আগে আয়াতুল কুরসি পড়বে, সে রাতে আল্লাহর নিরাপত্তায় থাকবে এবং শয়তান তার কাছে আসতে পারবে না।” (সহিহ বুখারি: ৩২৭৫)
৪. সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস তিনবার করে পড়া
📜 হাদিস:
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: “أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ كَانَ إِذَا أَوَى إِلَى فِرَاشِهِ كُلَّ لَيْلَةٍ جَمَعَ كَفَّيْهِ ثُمَّ نَفَثَ فِيهِمَا فَقَرَأَ فِيهِمَا: قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ، وَقُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ، وَقُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ، ثُمَّ يَمْسَحُ بِهِمَا مَا اسْتَطَاعَ مِنْ جَسَدِهِ، يَبْدَأُ بِهِمَا عَلَى رَأْسِهِ وَوَجْهِهِ، وَمَا أَقْبَلَ مِنْ جَسَدِهِ، يَفْعَلُ ذَٰلِكَ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ
বাংলা অনুবাদ: আয়িশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন— “রাসুলুল্লাহ ﷺ রাতে ঘুমানোর সময় তাঁর দুই হাত একত্র করতেন, তাতে ফুঁ দিতেন এবং সূরা ইখলাস, সূরা আল-ফালাক ও সূরা আন-নাস পাঠ করতেন। তারপর হাত দিয়ে শরীরের যেখানে পৌঁছাতে পারতেন সেখানে মুছতেন। এটি তিনি তিনবার করতেন।”
হাদিস নাম্বার:
- সহিহ বুখারি: ৫০১৭)
৫. সূরা আল-হাশরের শেষ তিন আয়াত পড়া
নবী ﷺ বলেছেন, “যে ব্যক্তি রাতে সূরা আল-হাশরের শেষ তিন আয়াত পড়বে, আল্লাহ তার জন্য নিরাপত্তা দেবেন এবং শয়তান তার কাছ থেকে দূরে থাকবে।” (সুনান আবু দাউদ: ৪২৭৩)
৬. সূরা আল-মুলক পড়া
নবী ﷺ বলেছেন, “সূরা আল-মুলক কবরের শাস্তি থেকে রক্ষা করে।” (ইবনে মাজাহ: ৩৮৪৬)
৭. সূরা আল-বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়া
নবী ﷺ বলেছেন, “যে ব্যক্তি রাতে সূরা আল-বাকারার শেষ দুই আয়াত (আমানার রাসুলু) পড়বে, তা তার জন্য রাত্রে পর্যাপ্ত হবে।” (সহিহ বুখারি: ৪০০৮, সহিহ মুসলিম: ৮০৭)
৮. তাসবিহ ও যিকির পড়া
নবী ﷺ ফাতিমা (রা.) কে ঘুমানোর আগে নিম্নের তাসবিহ পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন:
- ৩৩ বার: “সুবহানাল্লাহ” (سبحان الله)
- ৩৩ বার: “আলহামদুলিল্লাহ” (الحمد لله)
- ৩৪ বার: “আল্লাহু আকবার” (الله أكبر)
📖 (সহিহ বুখারি: ৩১১৩, সহিহ মুসলিম: ২৭২৭)
৯. ওজু করে ঘুমানো
নবী ﷺ বলেছেন, “যে ব্যক্তি পবিত্র অবস্থায় ঘুমায়, রাতে যখনই সে জাগে এবং আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করে, তা কবুল হয়।” (সুনান আবু দাউদ: ৫০৪২)
১০. ডান কাতে শোয়া
নবী ﷺ ডান কাতে শুতে পছন্দ করতেন এবং সাহাবাদেরকেও এভাবে শোয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। (সহিহ বুখারি: ২৪৭, সহিহ মুসলিম: ২৭১০)
১১. বিছানা ঝেড়ে নেওয়া
নবী ﷺ বলেছেন, “যখন তোমাদের কেউ তার বিছানায় যেতে চায়, সে যেন তার বিছানাকে ঝেড়ে নেয়, কারণ সে জানে না যে সেখানে আগে কী ছিল।” (সহিহ বুখারি: ৬৩২০, সহিহ মুসলিম: ২৭১৪)
১২. বাতি নিভিয়ে দেওয়া
নবী ﷺ বলেছেন, “যখন রাতে ঘুমাতে যাও, তখন বাতি নিভিয়ে দিও, কারণ ইঁদুরের মতো কোনো প্রাণী আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে এবং ঘরে অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে পারে।”(সহিহ বুখারি: ৬২৯৬, সহিহ মুসলিম: ২০১২)
🔹 সংক্ষেপে ঘুমানোর সুন্নত আমলসমূহ
১. বিশেষ দোয়া পড়া।
২. আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া বলা।
৩. আয়াতুল কুরসি পড়া।
৪. সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস তিনবার করে পড়া।
৫. সূরা আল-হাশরের শেষ তিন আয়াত পড়া।
৬. সূরা আল-মুলক সম্পূর্ণ পড়া।
৭. সূরা আল-বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়া।
৮. তাসবিহ ও যিকির পড়া।
৯. ওজু করে ঘুমানো।
🔟. ডান দিকে কাত হয়ে শোয়া।
১১. বিছানা ঝেড়ে নেওয়া।
১২. বাতি নিভিয়ে দেওয়া।
ঘুমানোর সুন্নত সময়
🔹 এশার নামাজের পর তাড়াতাড়ি ঘুমানো
- নবী ﷺ সাধারণত এশার নামাজের পর অপ্রয়োজনীয় কথা ও কাজ এড়িয়ে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তেন।
- এটি রাতের তাহাজ্জুদ ও ফজরের জন্য সহজ করে এবং শরীরকে বিশ্রাম দেয়।
📖 হাদিস:
“নবী ﷺ এশার আগে ঘুমানো অপছন্দ করতেন এবং এশার পর বেশি কথা বলা অপছন্দ করতেন।” (সহিহ বুখারি: ৫৬৮, সহিহ মুসলিম: ৬৪৭)
🔹 ফজরের আগে বা পরে ঘুম না করা
- নবী ﷺ সাধারণত ফজরের পর ঘুমাতেন না, বরং তিনি সাহাবিদের সাথে কিছু সময় কাটাতেন বা ইবাদত করতেন।
📖 হাদিস: “হে আল্লাহ! আমার উম্মাহর জন্য তাদের সকালকে বরকতময় করে দাও।”
(সুনান আবু দাউদ: ২৬০৬, ইবনে মাজাহ: ২২৩৬)
🔹 দুপুরে কিছুক্ষণ ঘুমানো (কায়লুলা)
- নবী ﷺ ও সাহাবারা দুপুরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন, যা “কায়লুলা” নামে পরিচিত।
- এটি রাতের তাহাজ্জুদ ও ফজরের জন্য উপকারী।
📖 হাদিস: “তোমরা দুপুরের ঘুম (কায়লুলা) নাও, কারণ শয়তান তা করে না।”
(সুনান তাবরানি: ৮৬২)
সংক্ষেপে
- ✅ এশার পর দ্রুত ঘুমানো – সুন্নত।
- ✅ ফজরের পর জাগ্রত থাকা – সুন্নত।
- ✅ দুপুরে কিছুক্ষণ ঘুমানো (কায়লুলা) – সুন্নত।
- ❌ সকাল ও আসরের পর