চুরি হওয়া জিনিস ফিরে পাওয়ার তদবির । আমল | সমাধান ও টিপস

Share this post

চুরি হওয়া জিনিস হারানোর কষ্ট অনেক সময় আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে দেয়। সেটা টাকা-পয়সা হোক বা কোনো প্রিয় সামগ্রী—এমন পরিস্থিতি হতাশা, রাগ ও উদ্বেগ তৈরি করে। তবে ইসলামে আমাদের শিখানো হয়েছে, কোনো কষ্ট বা সমস্যা এলে প্রথমে আল্লাহর উপর ভরসা করতে এবং হালাল উপায়ে সমাধান খুঁজতে। চুরি হওয়া জিনিস ফিরে পাওয়ার জন্য কিছু দোয়া, আমল ও তদবির রয়েছে যা আলেমরা উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি কিছু বাস্তবধর্মী পদক্ষেপও নেওয়া জরুরি, যাতে আমাদের হারানো জিনিস ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এই ব্লগপোস্টে আমরা ইসলামী দৃষ্টিকোণ, কার্যকর দোয়া ও বাস্তব পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করব, যা একজন মুমিনের জন্য আশা ও ধৈর্যের পথ খুলে দিতে পারে।

চুরি হওয়া জিনিসের জন্য বিশেষ দোয়া

রাসূল ﷺ শিখিয়েছেন, হারানো বা চুরি হওয়া জিনিস খুঁজতে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে। এক সুন্দর দোয়া হলো:

اللَّهُمَّ رَادَّ الضَّالَّةِ، هَادِيَ الضَّلَالَةِ، أَنْتَ تَهْدِي مِنَ الضَّلَالَةِ، ارْدُدْ عَلَيَّ ضَالَّتِي بِقُدْرَتِكَ وَسُلْطَانِكَ، فَإِنَّهَا مِنْ عَطَائِكَ وَفَضْلِكَ

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা রাদ্দা-দ্দ্বাল্লাতি, হাদিয়াদ-দ্বোলালাতি, আন্তা তাহ্দি মিনাদ-দ্বোলালাতি, র্দুদ আলাইয়া দ্দ্বাল্লাতি বিকুদরাতিকা ওয়া সুলতানিকা, ফা-ইন্নাহা মিন আ’তা-ইকা ওয়া ফাদলিকা।

অর্থ: “হে আল্লাহ! হারানো জিনিস ফিরিয়ে দেওয়ার মালিক, পথভ্রষ্টকে হিদায়াত দানকারী, তুমি পথভ্রষ্টকে হিদায়াত দাও। তোমার ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের দ্বারা আমার হারানো জিনিস ফিরিয়ে দাও, নিশ্চয়ই তা তোমার দান ও অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত।”

দোয়া করার আদব ও সময়

  • তাহাজ্জুদ বা রাতের শেষ অংশে এই দোয়া করা উত্তম।
  • অযু অবস্থায় ও কিবলামুখী হয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করা।
  • আগে দরুদ শরিফ পাঠ করে শুরু করা এবং শেষে আবার দরুদ পাঠ করে দোয়া শেষ করা।
  • অন্তর থেকে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা যে আল্লাহই ফিরিয়ে দিতে সক্ষম।

দোয়ার সাথে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল

দোয়া করার পর মনে রাখতে হবে, ফলাফলের মালিক আল্লাহ। তাই যদি জিনিস ফিরে না আসে, তবুও মনে করতে হবে যে এতে কোনো কল্যাণ আছে। আল্লাহ আমাদের জন্য উত্তমটাই নির্ধারণ করেছেন।

৩. আমল ও তদবির

নামাজ ও দু’আ দ্বারা সাহায্য চাওয়া

  • সালাতুল হাজত পড়ে বিশেষভাবে দোয়া করা।
  • দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা।

সুরা ইয়াসিন, সুরা ফাতিহা ইত্যাদি নির্দিষ্ট আমল

  • সুরা ইয়াসিনের ৮৩ নম্বর আয়াত পাঠ করে দোয়া করা।
  • সুরা ফাতিহা বারবার পড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা।

সালাতুল হাজত পড়ে চুরি হওয়া জিনিস ফেরত চাওয়া

সালাতুল হাজতের পদ্ধতি:
১. সুন্দর করে অযু করা।
২. দুই রাকাত নফল নামাজ পড়া।
৩. নামাজ শেষে আন্তরিকভাবে দোয়া করা।

৪. ফিকহি পরামর্শ

চুরি প্রমাণিত হলে শরীয়ত অনুযায়ী করণীয়

চোর ধরা পড়লে প্রমাণসহ শরীয়তের বিধান প্রয়োগ করা উচিত। ইসলামে চুরি একটি বড় গুনাহ, এর শাস্তি কড়া।

সন্দেহ হলে অন্যকে কষ্ট না দেওয়া

যে ব্যক্তি সম্পর্কে প্রমাণ ছাড়া সন্দেহ হয়, তাকে অপমান বা দোষারোপ করা উচিত নয়। এটি গীবত ও অন্যায় হবে।

হারানো জিনিসের উপর হক কার

যদি কোনো জিনিস মালিককে খুঁজে না পায়, শরীয়তের নিয়ম অনুসারে ঘোষণা দেওয়া উচিত এবং মালিক না পেলে দান করে দেওয়া যেতে পারে।

বাস্তবিক করণীয় পুলিশের কাছে অভিযোগ করা প্রতিবেশী বা এলাকার লোকজনকে জানানো সিসিটিভি বা প্রযুক্তি ব্যবহার করে খোঁজা ৬. সতর্কতা তদবিরে কুসংস্কার, ঝাড়ফুঁক বা শির্ক থেকে বিরত থাকা জাদু-টোনা বা হারাম পদ্ধতির আশ্রয় না নেওয়া।

বাস্তবিক করণীয়

পুলিশের কাছে অভিযোগ করা

চুরি হলে প্রথমেই নিকটস্থ থানায় লিখিত অভিযোগ (GD বা FIR) করতে হবে। এটি প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে এবং পুলিশের সহায়তায় জিনিস ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।

প্রতিবেশী বা এলাকার লোকজনকে জানানো

প্রতিবেশী, দোকানদার বা এলাকার সকলে যদি খবর পায়, তারা খোঁজ রাখতে পারে। অনেক সময় হারানো জিনিস কেউ পেয়ে থাকলে খবর দেওয়া সহজ হয়।

সিসিটিভি বা প্রযুক্তি ব্যবহার করে খোঁজা

বর্তমানে অনেক রাস্তা বা দোকানে সিসিটিভি থাকে। সময়মতো সিসিটিভি ফুটেজ দেখলে চোর বা হারানোর স্থান চিহ্নিত করা সম্ভব। এছাড়া স্মার্টফোন ট্র্যাকিং বা লোকেশন ফিচার ব্যবহার করেও হারানো জিনিসের অবস্থান জানা যেতে পারে।

৬. সতর্কতা

তদবিরে কুসংস্কার, ঝাড়ফুঁক বা শির্ক থেকে বিরত থাকা

চুরি হওয়া জিনিস ফেরত পাওয়ার জন্য ঝাড়ফুঁক, কবজ বা কোনো তাবিজ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এগুলো শির্ক বা বিদআতের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, যা ঈমানের জন্য ক্ষতিকর।

জাদু-টোনা বা হারাম পদ্ধতির আশ্রয় না নেওয়া

হারানো জিনিস ফেরত পাওয়ার জন্য জাদু-টোনা, ভবিষ্যৎবাণীকারী বা জ্যোতিষীর কাছে যাওয়া ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এসব কাজে গিয়ে ঈমান ঝুঁকিতে ফেলা উচিত নয়। বরং বৈধ উপায়ে চেষ্টা করা ও আল্লাহর উপর ভরসা রাখা জরুরি।

মানসিক দিক

ধৈর্য ধারণ করা

চুরি বা হারানোর ঘটনা মানসিকভাবে কষ্টদায়ক। তবে একজন মুমিনের উচিত ধৈর্য ধরা এবং রাগ বা হতাশায় না ভেঙে পড়া। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, “নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের সাথেই আল্লাহ আছেন।” (সূরা বাকারা: ১৫৩)

আল্লাহর হিকমতের উপর বিশ্বাস রাখা

যা কিছু ঘটে আল্লাহর ইলম ও হিকমতের মধ্যে হয়। হয়তো হারানো জিনিস ফিরে না পাওয়ার মধ্যেই কোনো কল্যাণ আছে, যা আমরা বুঝতে পারি না।

হারানো জিনিস না পাওয়া গেলে সন্তুষ্ট থাকা

সর্বোচ্চ চেষ্টা ও দোয়ার পরও যদি জিনিস ফিরে না আসে, তখন সন্তুষ্ট থাকা উত্তম। এটাই প্রকৃত তাওয়াক্কুল – নিজের চেষ্টা করে ফলাফলের উপর আল্লাহর উপর ভরসা করা।

চুরি হওয়া জিনিস হারানোর সময় করণীয় প্রথম ধাপ

১️⃣ শান্ত থাকা ও ধৈর্য ধরা – আতঙ্কিত না হয়ে আগে মন শান্ত করতে হবে।
২️⃣ সঠিকভাবে খোঁজা – নিজের আশেপাশে ভালোভাবে খুঁজে দেখা, হয়তো কোথাও ভুলে রেখে গেছেন।
৩️⃣ দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া – নিশ্চিত হলে সাথে সাথে পরিবারের সদস্য বা কাছের মানুষকে জানান।
৪️⃣ সিকিউরিটি ব্যবস্থা দেখা – যদি বাসা বা দোকানে সিসিটিভি থাকে, তৎক্ষণাৎ ফুটেজ দেখে নেওয়া।
৫️⃣ দোয়া করা শুরু করা – প্রথমেই আল্লাহর কাছে হারানো জিনিস ফিরে পাওয়ার জন্য দোয়া করা।

অন্যের হারানো জিনিস পেলে করণীয়

ইসলামী শরীয়তে একে বলা হয় লুকটা (পাওয়া জিনিস)। এর নিয়ম হলো—

  • ঘোষণা দেওয়া: মালিককে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা এবং প্রকাশ্যে ঘোষণা দেওয়া।
  • নিজের কাছে রাখা: মালিক পাওয়া না গেলে তা নিরাপদে নিজের কাছে রাখা।
  • দান করা: দীর্ঘ সময় মালিক না পেলে আলেমদের পরামর্শ নিয়ে দান করে দেওয়া যেতে পারে।
    রাসূল ﷺ বলেছেন, “যে লোক হারানো জিনিস পাবে, সে এক বছর পর্যন্ত ঘোষণা করবে। এরপর মালিক না পেলে তা নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারে।” (সহীহ বুখারি, হাদিস ২৪৩৬)

সাধারণ ভুল ও কুসংস্কার

  • জাদু-টোনা বা তাবিজের আশ্রয় নেওয়া – এটি হারাম ও ঈমানের জন্য ক্ষতিকর।
  • জ্যোতিষী বা ভাগ্য গণকের কাছে যাওয়া – এটি রাসূল ﷺ কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।
  • অন্যকে মিথ্যা অভিযোগ করা – প্রমাণ ছাড়া কাউকে দোষারোপ করা গীবত ও গুনাহ।
  • ধৈর্য হারিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া – যেমন মারামারি করা বা গালাগালি করা।

সাধারণ প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন: হারানো জিনিসের জন্য দোয়া কতবার পড়তে হবে?

উত্তর: নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই, তবে বারবার ও আন্তরিকভাবে পড়তে হবে।

প্রশ্ন: হারানো জিনিস ফিরে পেলে কি সদকা দিতে হবে?

উত্তর: এটা বাধ্যতামূলক নয়, তবে শোকরানা হিসেবে সদকা দিলে ভালো।

প্রশ্ন: হারানো টাকা না পেলে দান করলে কি সওয়াব হবে?

উত্তর: হ্যাঁ, আল্লাহর জন্য দান করলে সওয়াব হবে এবং বিপদের বদলে কল্যাণ আসতে পারে।

প্রশ্ন: অন্যের হারানো জিনিস নিজের কাছে রাখা কি গুনাহ?

উত্তর: যদি ঘোষণা না দিয়ে নিজের জন্য রেখে দেয়, তবে গুনাহ হবে। মালিককে খুঁজে দেওয়া ফরজ।

উপসংহার

তাওয়াক্কুল, দোয়া ও প্রচেষ্টা একসাথে করা

চুরি হওয়া জিনিস ফেরত পাওয়ার জন্য দোয়া, আমল এবং বাস্তবিক চেষ্টা—সবগুলো একসাথে করা উচিত। শুধুমাত্র চেষ্টা করেও নয়, আবার শুধু দোয়া করেও নয়। বরং আল্লাহর উপর ভরসা রেখে চেষ্টা করতে হবে।

পাঠকদের জন্য কল টু অ্যাকশন

আপনি কি কখনও চুরি হওয়া কোনো জিনিস ফেরত পেয়েছেন? আপনার অভিজ্ঞতা নিচের কমেন্টে শেয়ার করুন। আর যদি আপনি এই পোস্টের দোয়া বা আমলগুলো উপকারী মনে করেন, আপনার প্রিয়জনদের সঙ্গে শেয়ার করুন, যেন তারাও উপকৃত হয়।


Share this post
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x